৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৫ জুন ১৯৭১ এই দিনে

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা অস্বীকার করে আসছে যে তারা বেছে বেছে গণহত্যা চালাচ্ছে। কিন্তু একের পর এক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে তারা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করছে সংখ্যালঘু হিন্দু, বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদী, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র মোটকথা যারাই একটি স্বতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে ৫০ লাখ পূর্ব পাকিস্তানি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আসার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে এসেছে। এই ক্ষুধাপীড়িত, কলেরা-আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিদিন আরও এক লাখ করে আতঙ্কিত শরণার্থী যোগ হচ্ছে। যদি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে থাকে, তাহলে কেন নতুন নতুন শরণার্থীরা ভারতকে প্লাবিত করছে এবং আগে যারা এসেছে তারা কেন বাড়ি ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে? অন্যান্য দেশের পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র ও শরণার্থীদের জন্য ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠাচ্ছে। আমাদের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে জাতিসংঘ পরিচালিত একটি ত্রাণ কার্যক্রম পাঠানোরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর কঠোর ব্যবস্থার কারণে ধানের চাষ ব্যাহত হয়েছে এবং লাখ লাখ বাঙালি অনাহারে পড়বে যদি বাইরে থেকে খাদ্য সরবরাহ করা না হয়। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া খানের সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ‘একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থান’-এ আসতে আকুল আবেদন জানিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন বলতে চাইছে যে পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বায়ত্তশাসন দিতে যার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিয়েছে। এটা কি ওয়াশিংটনের জড়িত হওয়ার মতো কোনো বিষয়? আমরা তাই মনে করি। এই দেশটি বিগত দুই দশক ধরে কোটি কোটি ডলারের অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। যার বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সাহায্য পশ্চিম পাকিস্তান নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে এবং সামরিক সাহায্য ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালিদের নিষ্পেষিত করতে। দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ঠেকাতে পাকিস্তানের এখন প্রতি বছর ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার করে প্রয়োজন হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানকে অনুরোধ করেছে এই অর্থের সংস্থান করতে। ওয়াশিংটনের কি এই রকম সাহায্য চালিয়ে যাওয়া উচিত? আমরা বলি- না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইয়াহিয়া খান তার সামরিক খুনিদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের দাবি মেনে নিচ্ছে। নইলে, তার জান্তাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে, আমরাও বাঙালি জনতার ওপর চালানো গণহত্যা এবং দাসত্বের নৈতিক অংশীদার হয়ে যাব। এই পদক্ষেপ, আমরা স্বীকার করি, আমাদের পররাষ্ট্র নীতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে কিন্তু কোনো গণহত্যার পক্ষে মৌনসম্মতি দেয়ার চেয়ে এই মূল্য কিছুই নয়।'

ঢাকায় এদিনঃ

১৫ জুন সামরিক কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ পুস্তকের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে- আবদুল জলিলের যুগসঙ্গীত, শংকর প্রসাদ ঘোষ ও অরুণ দাশগুপ্তের অভিযাত্রী, পূর্ববঙ্গের লীগ সরকারের এক বছর, যাযাবরের ঝিলাম নদীর তীরে, প্রবোধ কুমার সান্যালের হাসুবানু, নূরে আলম সিদ্দিকীর রক্তাক্ত পথ, বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, মুজাহিদের আলাদা হাওয়াই মুক্তির পথ।

১৫ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন জিল নাইট, জেমস এ কিলফেডার ও জেমস টিন।

ভারতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এদিনঃ

১৫ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্য সভায় পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্যের জবাব দেন। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী এই আলোচনায় ইন্দিরা গান্ধী তার বক্তব্যে বলেন, বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যদি পাকিস্তানের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতো এবং চাপ দিতো তবে পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি আজ এতোটা খারাপ হতো না। কিন্তু এখন রাজনৈতিকভাবে যে মীমাংসার আশা ছিল তাও ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। পূর্ব বাংলার মানুষ কেবল তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছে। তারা গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের জন্য যুদ্ধে নেমেছে। ভারত সাময়িকভাবে শরণার্থীদের রাখছে, কিন্তু তাদেরকেও তো দেশে ফিরতে হবে। রাজ্যসভার এক সদস্য বহির্বিশ্বে ভারতের অবস্থান ও সাহায্য প্রত্যাশা নিয়ে সমালোচনা করলে, ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আমাদের দূতেরা কিন্তু ভিক্ষা করতে যাননি গেছেন পূর্ব বাংলার বিষয়ে বিশ্বে জনমত গড়ে তুলতে।

১৫ জুন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ ও বয়রা সীমান্তে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। এসময় বনগাঁয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তাকে একটি স্মারকলিপি দেন। শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পর প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান সাংবাদিকদের বলেন, 'শরণার্থীরা পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে আদৌ নিরাপদ থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। তবে শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি শিগগিরই হয়তো তৈরি হবে, যদিও এর কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। অনুকূল পরিবেশ পাকিস্তানকেই সৃষ্টি করতে হবে। বাইরের কোনো শক্তির পক্ষে এ কাজ কষ্টসাধ্য।'

১৫ জুন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সর্বভারতীয় সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও সাংবাদিকদের বলেন ' কেন্দ্রের উচিত শরণার্থীদের দায়িত্ব গ্রহণে সব রাজ্যকে বাধ্য করা। কারণ, এটি একটি জাতীয় সংকট। এটি কেবল পশ্চিমবঙ্গ ও এই অঞ্চলের মানুষের দায়িত্ব নয়।'

১৫ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ আর মল্লিকের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী–শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত ৭ জনের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের চলমান অবস্থা সম্পর্কে জানাতে আলীগড় থেকে দিল্লি যান।

আন্তর্জাতিক মহলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার ও বিবৃতিঃ

১৫ জুন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্নিনান্দ ই মার্কোস ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠির জবাবে ফিরতি চিঠিতে লেখেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক কারণে সেখানকার বাঙালি জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় ফিলিপাইন সরকার ও ফিলিপাইনের জনগণ গভীরভাবে মর্মাহত।'

১৫ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংহ পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। 

বৈঠকের পর সরদার শরণ সিং সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব বাংলার সামগ্রিক বিষয় ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমি জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে সবকিছু বলেছি। একই সঙ্গে ভারত শরণার্থীদের কারণে যে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তাও বলেছি। এই সমস্যাটি এখন কেবল ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। এটি পুরো বিশ্বের অন্যতম একটি সমস্যা। জাতিসংঘের মহাসচিব বললেন, তারা এ ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ করছেন।'

১৫ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সাংবাদিকদের বলেন, 'ভারত যে সময় উল্লেখ করেছে সেই সময়ের মধ্যে যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমাধান না হয় তবে ভারত তার নিরাপত্তার স্বার্থে কঠিন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।'

১৫ জুন খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কালান্তর পত্রিকা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয় 'সোভিয়েত সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্থানান্তর করার কাজে সাহায্যের জন্য আজ ভারত সরকারের অনুরোধে দুটি বৃহদাকার এএন১২ পরিবহন বিমান পাঠিয়েছে। বিমান দুটি আজ বিকেলে মস্কো থেকে দিল্লি হয়ে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছায়। পাক সেনাদের বর্বরতম আক্রমণের ফলে লাখ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন ভারতের রাজ্যসমূহে চলে আসে। সীমান্ত রাজ্যগুলো থেকে অত্যধিক শরণার্থী চাপ সরাতে তাদের অধিকতর সুষ্ঠু আশ্রয় ব্যবস্থার জন্য ভারতের অন্যত্র উদ্বাস্তু শিবিরে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারত সরকার এই কাজে সাহায্যের জন্য সোভিয়েত সরকারকে অনুরোধ জানান। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে সোভিয়েত সরকার প্রথম দফায় এই দুটি বৃহৎ পরিবহন বিমান পাঠায়। দিল্লি থেকে বিমানে তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রাণ বিভাগের অফিসার শ্রী ভি পি বাইদাকভ কলকাতায় আসেন। বিমানবন্দরে স্বাগত জ্ঞাপনকারীদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার সোভিয়েত কনস্যুলেটর শ্রী ভি দিউলিনসহ কন্সাল শ্রী ভি গুর্গেনভ, সোভিয়েত এয়ারোফ্লট ক্যাপ্টেন সেজকুলভ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের জয়েন্ট সেক্রেটারি শ্রী এস সি রায় ও অন্য কর্মকর্তারা। সোভিয়েত ওষুধ ও অন্যান্য সাহায্য নিয়ে আরও বিমান দু-এক দিনের মধ্যে এসে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।'

পাকিস্তানে এদিনঃ

১৫ জুন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, 'পাকিস্তানের মনোভাব ব্যক্ত করতে বিদেশি রাষ্ট্র সফরের জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আমাকে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় তার দেশ ত্যাগ করা উচিত নয়, কিন্তু যেখানে প্রেসিডেন্ট অনুরোধ করেন তখন তা বিবেচনা করা আমার কর্তব্য।'

১৫ জুন লাহোরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান সাংবাদিকদের বলেন, 'ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে আমার বক্তব্যের যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, তা ভ্রান্তিমূলক। এ বিষয়ে কেবল একমাত্র প্রেসিডেন্টই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’ 

১৫ জুন বিশ্বব্যাংকের এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের পরিচালক পিটার কারগিল এবং আইএমএফের মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ দূত গাম্বারও পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন।

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধযুদ্ধঃ

শ্রীপুর গণহত্যাঃ-

১৫ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দালাল রাজাকারেরা নোয়াখালীর সোনাপুরের শ্রীপুর গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন ১১৫ জন মানুষ। 

১৫ জুন দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এদিন দুপুরের খাবার খেয়ে গ্রামবাসী যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল ঠিক তখনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণ চালায় শ্রীপুর গ্রামে। শ্রীপুরে প্রবেশ করেই হানাদার বাহিনী সর্বপ্রথম আহম্মদিয়া হাই স্কুল মাঠে আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর স্কুলের পেছনে গিয়ে আলী হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার ভাই আলী করিম, আলী হায়দার ও বেড়াতে আসা এক মেহমানকেও গুলি করে হত্যা করে।

এ সময় আলী হোসেনের বাবা সৈয়দ মুন্সি গলায় কোরআন শরীফ তুলে নিয়ে ছেলেদের বাঁচাতে কাতর হয়ে প্রাণে না মারার অনুরোধ জানালে হানাদারেরা তাতে কর্ণপাত করেনি। তারা আলী হোসেনের বাবাকে লাথি মেরে বাবার সম্মুখেই ছেলেদের হত্যা করে। অতঃপর তারা বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে গান পাউডার দিয়ে গোটা ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এর পর হানাদার বাহিনী বাজারে প্রবেশ করে । এসময় হোমিও ডাক্তার আবু ফররার দোকানে এক মহিলা তার ২ মাস বয়সী অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে ওষুধ কেনার জন্য এসেছিল। তারা দোকানে ঢুকে ডাক্তার, সেই মহিলা ও তার শিশু কন্যাকে গুলি করে হত্যা করে। শ্রীপুর গ্রাম তো বটেই পার্শ্ববর্তী সোনাপুর ও মধ্য করিমপুর গ্রামে চালানো এই গণহত্যায় সেদিন শহীদ হয়েছিল ১১৫ জন নিরীহ মানুষ।

১৫ জুন সিলেট শাহাজীবাজারের কাছে রেল সেতুতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার সেনা বোঝাই একটি ট্রেনকে অ্যামবুশ করে। এতে ১৫০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

১৫ জুন সুনামগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর ধর্মপাশা ঘাঁটির ওপর ২ হাজার হানাদার সেনা ও মিলিশিয়ার একটি দল বারহাট্টা থানাধীন সিংধা- ধর্মপাশা রাস্তা ধরে, আরেক দল কংস নদীর পথে ও অন্য একদল মোহনগঞ্জ-ধর্মপাশা রাস্তা ধরে সম্মিলিতভাবে ত্রিধারায় আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর একজন মেজরসহ ২০ জন সৈন্য নিহত হয়। 

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই শহীদ হন। এ যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী ধর্মপাশা সদর দখল করে নেয় এবং নিরীহ মানুষদের ওপর নিপীড়ন, নৃশংস হত্যাকান্ড ও নারী নির্যাতন করে। হানাদারেরা ধর্মপাশা বাজার পুড়িয়ে দেয়।

১৫ জুন রংপুরের ভুরুঙ্গামারীতে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় । এতে হানাদার বাহিনীর বিপুল ক্ষতি হয়।

 

 

১৫ জুন, ১৯৭১:‘আমাকে পাঠানো হয়েছে সমাজবিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খতম করার জন্য’টিক্কা খান

 
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান। ফাইল ছবি

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান। ফাইল ছবি

দৈনিক কালান্তর পত্রিকার এক রিপোর্টে জানা যায় যে, সোভিয়েত সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্থানান্তর করার কাজে সাহায্যের জন্য আজ ভারত সরকারের অনুরোধে দুটি বৃহদাকার এ এন ১২ পরিবহন বিমান পাঠিয়েছে। বিমান দুটি আজ বিকেলে মস্কো থেকে দিল্লী হয়ে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছায়।

পাক সেনাদের বর্বরতম আক্রমণের ফলে লাখ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন ভারতের রাজ্যসমূহে চলে আসে। সীমান্ত রাজ্যগুলো থেকে অত্যধিক শরণার্থী চাপ সরাতে তাদের অধিকতর সুষ্ঠু আশ্রয় ব্যবস্থার জন্য ভারতের অন্যত্র উদ্বাস্তু শিবিরে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারত সরকার এই কাজে সাহায্যের জন্য সোভিয়েত সরকারকে অনুরোধ জানান। 

সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে সোভিয়েত সরকার প্রথম দফায় এই দুটি বৃহৎ পরিবহন বিমান পাঠায়। দিল্লী থেকে বিমানে তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রাণ বিভাগের অফিসার শ্রী ভি পি বাইদাকভ কলকাতায় আসেন। বিমানবন্দরে স্বাগত জ্ঞাপনকারীদের মধ্যে ছিলেন কলকাতার সোভিয়েত কনস্যুলেটর শ্রী ভি দিউলিনসহ কন্সাল শ্রী ভি গুর্গেনভ, সোভিয়েত এয়ারোফ্লট ক্যাপ্টেন সেজকুলভ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের জয়েন্ট সেক্রেটারি শ্রী এস সি রায় ও অন্য কর্মকর্তারা। সোভিয়েত ওষুধ ও অন্যান্য সাহায্য নিয়ে আরও বিমান দু-এক দিনের মধ্যে এসে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিলেট শাহাজীবাজারের কাছে রেল সেতুতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনা বোঝাই একটি ট্রেনকে এ্যামবুশ করে। এত ১৫০ জন পাকসেনা নিহত ও ট্রেনটি ধ্বংস হয়।

সুনামগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর ধর্মপাশা ঘাঁটির ওপর দুহাজার পাক আর্মি ও মিলিশিয়ার একটি দল বারহাট্টা থানাধীন সিংধা- ধর্মপাশা রাস্তা ধরে, আরেক দল কংস নদীর পথে ও অন্য একদল মোহনগঞ্জ-ধর্মপাশা রাস্তা ধরে সম্মিলিতভাবে ত্রিধারায় আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন মেজরসহ ২০ জন সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই শহীদ হন। এ যুদ্ধের পর পাকবাহিনী ধর্মপাশা সদর দখল করে নেয় এবং নিরীহ মানুষদের ওপর নিপীড়ন, নৃশংস হত্যাকান্ড ও নারী নির্যাতন করে। পাক বর্বররা ধর্মপাশা বাজার পুড়িয়ে দেয়।

রংপুরের ভুরুঙ্গমারীতে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় । এতে পাকবাহিনী বিপুল ক্ষতি স্বীকার করে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ এ মার্কোস ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এক পত্রের জবাবে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিবাদের ফলে সেখানকার বাঙালী জনগণের দুঃখ-দূর্দশায় ফিলিপাইন সরকার ও জনগণ গভীরভাবে মর্মাহত।

বৃটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন মিসেস জিল নাইট, জেমস এ কিলফেডার ও জেমস টিন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানের মনোভাব ব্যক্ত করতে বিদেশী রাষ্ট্র সফরের জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাকে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় তার দেশ ত্যাগ করা উচিত নয়, কিন্তু যেখানে প্রেসিডেন্ট অনুরোধ করেন তখন তা বিবেচনা করা তার কর্তব্য।

সামরিক কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ পুস্তকের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে: আবদুল জলিলের যুগসঙ্গীত, শংকর প্রসাদ ঘোষ ও অরুণ দাশগুপ্তের অভিযাত্রী, পূর্ববঙ্গের লীগ সরকারের এক বছর, যাযাবরের ঝিলাম নদীর তীরে, প্রবোধ কুমার সান্যালের হাসুবানু, নূরে আলম সিদ্দিকীর রক্তাক্ত পথ, বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, মুজাহিদের আলাদা হাওয়াই মুক্তির পথ।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান গভর্নর সম্মেলনে নিজের সফলতা বর্ণনা করে বলেন, আমাকে পাঠানো হয়েছে সমাজবিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খতম করার জন্য। আমি তা করেছি। প্রেসিডেন্ট যেকোনো দিন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন।

দি ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ-এর ‘পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ’ শিরোনামে সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি জনতার ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের খবর ফাঁস হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা অস্বীকার করে আসছে যে তারা বেছে বেছে গণহত্যা চালাচ্ছে। কিন্তু একের পর এক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে তারা ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করছে সংখ্যালঘু হিন্দু, বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র মোটকথা যারাই একটি স্বতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। 

সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে ৫০ লাখ পূর্ব পাকিস্তানী তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আসার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে এসেছে। এই ক্ষুধাপীড়িত, কলেরা-আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিদিন আরও এক লাখ করে আতঙ্কিত শরণার্থী যোগ হচ্ছে। যদি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন ‘স্বাভাবিক’ হয়ে থাকে, তাহলে কেন নতুন নতুন শরণার্থীরা ভারতকে প্লাবিত করছে এবং আগে যারা এসেছে তারা কেন বাড়ি ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে? অন্যান্য দেশের পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র ও শরণার্থীদের জন্য ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠাচ্ছে। আমাদের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে জাতিসংঘ পরিচালিত একটি ত্রাণ কার্যক্রম পাঠানোরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

সেনাবাহিনীর কঠোর ব্যবস্থার কারণে ধানের চাষ ব্যাহত হয়েছে এবং লাখ লাখ বাঙালি অনাহারে পড়বে যদি বাইরে থেকে খাদ্য সরবরাহ করা না হয়। সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া খানের সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ‘একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থান’-এ আসতে আকুল আবেদন জানিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন বলতে চাইছে যে পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বায়ত্তশাসন দিতে যার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিয়েছে। এটা কি ওয়াশিংটনের জড়িত হওয়ার মতো কোন বিষয়? আমরা তাই মনে করি। এই দেশটি বিগত দুই দশক ধরে কোটি কোটি ডলারের অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। যার বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সাহায্য পশ্চিম পাকিস্তান নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে এবং সামরিক সাহায্য ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালীদের নিষ্পেষিত করতে। 

দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ঠেকাতে পাকিস্তানের এখন প্রতি বছর ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার করে প্রয়োজন হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানকে অনুরোধ করেছে এই অর্থের সংস্থান করতে। ওয়াশিংটনের কি এই রকম সাহায্য চালিয়ে যাওয়া উচিত? আমরা বলি না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইয়াহিয়া খান তার সামরিক খুনীদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের দাবি মেনে নিচ্ছে। নইলে, তার জান্তাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে, আমরাও বাঙালি জনতার ওপর চালানো গণহত্যা এবং দাসত্বের নৈতিক অংশীদার হয়ে যাব। এই পদক্ষেপ, আমরা স্বীকার করি, আমাদের পররাষ্ট্র নীতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে কিন্তু কোনো গণহত্যার পক্ষে মৌনসম্মতি দেয়ার চেয়ে এই মূল্য কিছুই নয়।