৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল চৌদ্দগ্রামে পাকহানাদার বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের ওপর মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৩০/৪০ জন পাকসৈন্য হতাহতহয়। পাকসেনারা কামানের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে গুলি চালালে কিছু বেসামরিক লোক নিহত হয়। 


২নং সেক্টরের বেলুনিয়ায় পাকহানাদার বাহিনী মহুরী নদী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড কামান আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা সমস্ত দিন যুদ্ধের পর পাকসেনাদের এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।


২নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী নয়াপাড়ার পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ে অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে।


ময়মনসিংহে পাকহানাদার বাহিনী খাদ্য সম্ভার বোঝাই করে পাঁচটি বড় বড় নৌকায় ভালূকার দিকে অগ্রসর হলে কোম্পানি কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল ঝালপাজা গ্রামে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ৪ জন পাকসেনা নিহত ও অনেক আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাসহ ৫৭০ মণ আটা ও ২০ মণ চিনি হস্তগত করে। এই আটা ও চিনি পরে রাজৈর ইউনিয়নের গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।


চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গেরিলা যোদ্ধারা পাকসেনাদের দু’দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে পর্যুদস্ত করে। এতে ৩০ জন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং বাকী সৈন্য অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলা যোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে।


ঢাকায় সামরিক আদালত রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, অননুমোদিত অস্ত্র বিতরণ, রাষ্ট্রবিরোধীদের ট্রেনিং প্রদান প্রভৃতি অভিযোগে আওয়ামী লীগের ১৪৫ জন এম.পি.এÑকে সামরিক আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়।


লে. জেনারেল নিয়াী গাজীপুর অস্ত্র তৈরির কারখানা পরিদর্শন করে অস্ত্রের প্রথম চালান তৈরি করার জন্য কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এতো শ্রমের তৈরি অস্ত্র দেশের শত্র“দের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে।


প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ২১নং সামরিক আদেশের পুনর্গঠন করে ২৪নং সামিরক আদেশ জারি করেন।

 

১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: পূর্ববঙ্গের ৮০ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে

 

এরা দুর্ভিক্ষের শরণার্থী নয় বরং তারা দমন এবং আতঙ্কের শরণার্থী। ফাইল ছবি

এরা দুর্ভিক্ষের শরণার্থী নয় বরং তারা দমন এবং আতঙ্কের শরণার্থী। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার। মতিগঞ্জে গেরিলাবাহিনী পাকসেনাদের একটি ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে একজন অফিসারসহ ১১ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দুটি মোটর সাইকেল, ৩টি রেডিও এবং ৩ বাক্স ওষুধ উদ্ধার করে। মুক্তিফৌজের ১ জন যোদ্ধা এই সংঘর্ষে শহিদ হন।

মুক্তিফৌজের অপর একটি গেরিলা দল ফেনীর কাছে ফতেপুর রেলসেতু ডিমোলিশন লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ৫০ ফুটের একটি খাদের সৃষ্টি হয় এবং লাকসাম-ফেনীর মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফেনী শহরেও মুক্তিফৌজের গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পাকসেনাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গেরিলারা ফেনী থেকে ফুলগাজী পর্যন্ত পাকসেনাদের টেলিফোন লাইন কেটে তাদের টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

ফেনী থেকে পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোতে ট্রলির সাহায্যে রসদ সরবরাহ করত। তাদের এই সরবরাহ বন্ধ করবার জন্য চিতলিয়ার কাছে ঘানিমোড় রেলসেতুটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য মুক্তিফৌজের পাইওনিয়ার প্লাটুন পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি অতি কষ্টে মুহুরী নদী সাঁতরে রাতের অন্ধকারে সেতুটির নিচে ডিমোলিশন লাগিয়ে গুরুত্তপূর্ণ সেতুটি উড়িয়ে দেয়। ফলে ফেনী এবং বিলুনিয়াতে পাকসেনাদের ট্রলির সাহায্যে সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদল চৌদ্দগ্রামে পাকহানাদারবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের ওপর মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৩০/৪০ জন পাকসৈন্য হতাহত হয়। পাকসেনারা কামানের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে গুলি চালালে কিছু বেসামরিক লোক নিহত হয়। ২ নম্বর সেক্টরের বেলুনিয়ায় পাকহানাদার বাহিনী মুহুরী নদী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড কামান আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা সমস্ত দিন যুদ্ধের পর পাকসেনাদের এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।

২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী নয়াপাড়ার পাকসেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ে অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। ময়মনসিংহে পাকহানাদার বাহিনী খাদ্য সম্ভার বোঝাই করে পাঁচটি বড় বড় নৌকায় ভালুকার দিকে অগ্রসর হলে কোম্পানি কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল ঝালপাজা গ্রামে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ৪ জন পাকসেনা নিহত ও অনেক আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাসহ ৫৭০ মণ আটা ও ২০ মণ চিনি হস্তগত করে। এই আটা ও চিনি পরে রাজৈর ইউনিয়নের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

‘ডি’ কোম্পানীর ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে কামালপুরের ১ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ঘাসিপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। শত্রুপক্ষের দুই কোম্পানী সৈন্য মর্টার নিয়ে ঘাসিপুর আক্রমণ করে। ‘ডি’ কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এ আক্রমণ প্রতিরোধ করে ও তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। শত্রুপক্ষের প্রায় ৪০ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিফৌজের পক্ষে ৩ জন শহীদ এবং ৮ জন আহত হন।

মুক্তিযোদ্ধারা পটিয়া থানার মালিয়া পাড়া গ্রামে ১১ জন মুসলিম লীগের দালাল ও রাজাকারকে হত্যা করে। চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল পাকবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গেরিলা যোদ্ধারা পাকসেনাদের দু’দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে পর্যুদস্ত করে। এতে ৩০ জন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং বাকী সৈন্য অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলা যোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে।

ঢাকায় সামরিক আদালত রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, অননুমোদিত অস্ত্র বিতরণ, রাষ্ট্রবিরোধীদের ট্রেনিং প্রদান প্রভৃতি অভিযোগে আওয়ামী লীগের ১৪৫ জন এমপিএ-কে সামরিক আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। লে. জেনারেল নিয়াজী গাজীপুর অস্ত্র তৈরির কারখানা পরিদর্শন করে অস্ত্রের প্রথম চালান তৈরি করার জন্য কারখানার শ্রমিক কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এতো শ্রমের তৈরি অস্ত্র দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে।
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ২১ নম্বর সামরিক আদেশের পুনর্গঠন করে ২৪ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করেন।

দৈনিক নিউ স্টেটসম্যানে ‘বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই হবে’ শিরোনামের সংবাদে বলা হয়, পিটার শোর যিনি সদ্যই ভারত সফর করে ফিরেছেন তিনি বলেন, বাংলার গুরুতর সঙ্কটের মূলে রয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন। দুঃখজনক হলেও সত্য, গত বছরের নির্বাচন, যেটিতে বাংলা-ভিত্তিক আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয় এবং এর পরবর্তীকালে সুদুর-পরাহত স্বায়ত্ত্বশাসন নিয়ে শেখ মুজিব এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মধ্যকার আলোচনা, একক পাকিস্তান রক্ষার একটি শেষ সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এই সুযোগটি নষ্ট হয়ে যায় শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য নয় বরং এর আগেই প্রেসিডেন্টের তার সামরিক বাহিনীকে দেয়া আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার নির্দেশ এবং যা তারা জীবনেও ভুলতে পারবে না। 

টিক্কা খানের সৈন্যদের হিংস্রতা এমন এক শক্তিকে মুক্ত করেছে যা আজ হোক বা কাল শুধু ওদেরকেই নয় বরং পাকিস্তানকেই ধ্বংস করে দেবে। এখন বিশ্বের কাছে মূল প্রশ্ন, এটা নয় যে পাকিস্তান কিভাবে টিকে থাকবে বরং কিভাবে, অন্যান্য পরাশক্তির সঙ্গে বিরোধের ইন্ধন না জুগিয়ে এবং বাংলার উপর আরো অসহ্য দুর্দশা না হেনে, বাংলায় তার শাসনের অবসান ঘটাবে। দমনপীড়ন এমন নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এবং এতো দীর্ঘ সময় ধরে চালানো হয়েছে যে মানুষ পালিয়ে গেছে, শুধু তাদের বাড়িঘর থেকে নয় বরং তাদের দেশ থেকে অবিশ্বাস্য হারে গত ৫ মাস ধরে প্রতিমাসে ১৫ লক্ষ করে এবং এখনো যা কমার কোনো লক্ষণ নেই। 

পাকিস্তান সীমান্তের অনেক বাইরেও এক ক্রমবর্ধমান চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে বিশেষ করে ভারত, অপেক্ষা করছে এবং নজর রাখছে অস্বাভাবিক নিবিড়তার সাথে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে পাকিস্তানের সরকারী প্রচারণা বাংলার পুরো সমস্যাটিকে গুটিকয়েক বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকের অপচেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। 

এরইমধ্যে ভারতকে নজিরবিহীন সংখ্যক শরণার্থী আগমনের কষ্ট এবং খরচ এবং অসংগতি মেনে নিতে হচ্ছে, যা প্লাবিত করছে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম এবং পুরো ভারতীয় অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে ম্লান করে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে এরকম মনে হচ্ছে যেন তারা ভয়াবহ এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে এটাই প্রতিষ্ঠা করতে যে পাকিস্তানের আঘাত হানার ক্ষমতা ভারতের যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতার চেয়ে বেশি না কম। এখন পর্যন্ত ভারত নিজেকে রক্ষা করে আসছে এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সরাসরি আক্রমণের আশঙ্কা কিছুটা কমে গেছে ভারত-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর। কিন্তু প্রতিযোগিতা এখনও শেষ হয়নি। যে ৮০ লাখ মানুষ প্লাবিত করেছে পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশকে তারা দুর্ভিক্ষের শরণার্থী নয় বরং তারা দমন এবং আতঙ্কের শরণার্থী। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যখন পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব ছড়িয়ে পড়বে তখন মানুষের দ্বিতীয় ঢল, এবার দুর্ভিক্ষের শরণার্থীরা, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এমন সংখ্যায় আসতে পারে যা কল্পনা করাও কঠিন।