৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে

২নং সেক্টরে পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর চালনা ও শীতলা অবস্থানের ওপর দু’দিক থেকে আক্রমণ চালায়।

মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। সমস্তদিন যুদ্ধের পর মক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে পাকসেনা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরাজয়ের গ্লানিতে পশ্চাদপসরণকারী পাকসেনা তীব্র আক্রোশে ব্রাহ্মণপাড়া, ছোট চাঁদলা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয় এবং নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে।


সিলেটে আমলসিদ মুক্তিঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর দুই প্লাটুন যোদ্ধার ওপর পাকহানাদাররা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে তীব্র আক্রমণ চালায়। এতে পাকবর্বরদের শেলিংয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক ও আকমল আলী শহীদ হন এবং একজন বীর যোদ্ধা আহত হন।


মুক্তিবাহিনীর গেরিলা সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর নেতৃত্বে ৬ জন পাকপুলিশকে নদী পথে বগুড়া থেকে সরিয়াকান্দি খাদ্য নিয়ে যাওয়ার পথে ফুলবাড়ি ঘাটে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে দুইজন পুলিশ নিহত হয়। বাকী চারজন পুলিশ পালাতে গিয়ে জনসাধারণের হাতে ধরা পড়ে ও নিহত হয়। গেরিলারা কিছু অস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী দখল করে।


৬নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী সুবেদার মেজর আরব আলীর নেতৃত্বে পাকসেনাদের নাগেশ্বরী অবস্থানের ওপর ঝাটিকা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৫জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কোন ক্ষতি ছাড়াই নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।


৮নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ইছাখালী বিওপি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ৩ জন সৈন্য নিহত হয়।


পাকিস্তান সরকার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পেনশন বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ সরকার আবার তা চালু করেন। কবির কলকাতার বাসভবনে অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশের হাই কমিশনার এম. হোসেন আরী কবিকে ২১০০ রুপির একটি চেক প্রদান করেন।


রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয় : প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সকলের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক গোলযোগের সময় গত ১ মার্চ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যারা অপরাধ করেছেন অথবা যাদের প্রতি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েচে তাদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়েছে। আগামীকাল থেকে কার্যকর এই সাধারণ ক্ষতা সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, পুলিশম, মুজাহিদ ও আনসারসহ সকলের প্রতি প্রযোজ্য হবে।

৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: হেলিকপ্টার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ চালায় পাকসেনারা

 

হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে পেরে উঠছিল না। ফাইল ছবি

হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে পেরে উঠছিল না। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল শনিবার। রংপুরের শঠিবাড়ি বন্দরে আগেরদিন থেকে চলে আসা যুদ্ধ সকাল থেকে তীব্র আকার নেয়। হারেসউদ্দিন সরকার ৩১৫ জন সাহসী সাথীকে নিয়ে হানাদারদের সম্মুখে পর পর কয়েকটি বাঙ্কার পার হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে হানাদার বাহিনীর মেইন পজিশন শঠিবাড়ি স্কুলের ভেতরের বাঙ্কারে এলএমজির নিখুঁত আঘাত হানে। দুপুর ১২টার দিকে চাঞ্চল্য দেখা গেল হানাদারদের বাঙ্কার ও ডিফেন্স পজিশনে। 

হারেসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে যেতে লাগল সম্মুখপানে। প্রতিটি বাঙ্কারে মুক্তিযোদ্ধাদের বৃষ্টির মতো গুলি হানাদারবাহিনীকে তাদের ডিফেন্স লাইন ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য করে, থেমে যায় তাদের গোলন্দাজ আক্রমণ। এমন সময় হানাদাররা এলো আকাশ পথে। শঠিবাড়ি বন্দরে পশ্চিমাকাশে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে ঠিক তেমন সময় গর্জন করতে করতে এলো দুটি হেলিকপ্টার। হারেসউদ্দিন ও তার বাহিনীর পজিশনে প্রায় ২০ মিনিট ধরে বোমা বর্ষণ করে হেলিকপ্টার দুটো চলে গেল। বোমার আঘাতে আহত হন কমান্ডার হারেসউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত আহতদের ব্যান্ডেজ ও ফার্স্ট এইড দেয়া হল। 

মুক্তিযোদ্ধাদের ৬ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার এবং ডিফেন্স থেকে গুলি বন্ধ হওয়ায় হানাদার বাহিনী নতুন উদ্যমে গুলিবর্ষণ শুরু করল। সেই অসহায় অবস্থায় রাতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা যখন হতাশ হয়ে পড়েছিল তখন ৭ নম্বর কোম্পানী কমান্ডার হারেসউদ্দিন চিৎকার করে বললেন ‘যুদ্ধ চলবে মৃত্যু পর্যন্ত। যুদ্ধ চলবে, কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। কাউকে যদি পেছনে তাকাতে দেখি, এই আহত অবস্থায় তার ওপর আমি গুলি চালাব। জন্মভূমির বুকে বীরের মতো লড়ে প্রাণ দাও সবাই। হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা তিনশজন বিচ্ছিন্ন, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ধরে নাও আমরা সবাই মরে গেছি।’ তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বললেন ‘মৃত্যুর আগে একবার শেষ লড়াই করে যাও।’ মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ ফিরে পেল। আবার ফিরে গেল বাঙ্কারে। হাতে তুলে নিল থ্রি নট থ্রি। এমনভাবে পার হয়ে গেল ৪ তারিখ রাত।

২ নম্বর সেক্টরে পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর চাঁদলা ও শীতলা অবস্থানের ওপর দু’দিক থেকে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। সমস্তদিন যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে পাকসেনা ব্যাপক ক্ষতি শিকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরাজয়ের গ্লানিতে পশ্চাদপসারণকারী পাকসেনা তীব্র আক্রোশে ব্রাহ্মণপাড়া, ছোট চাঁদলা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয় এবং নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে।
ময়নসিংহের ভালুকা থেকে ভরাডুবা ও মেদুয়ালী এলাকায় ২ শতাধিক রাজাকার ও পাকবাহিনীর একটি দল বাজার ও বাড়িঘর লুট করে এবং বাংলাদেশের সমর্থক ৭৬ জনকে গ্রেফতার করে তাদের মাথায় লুট করা মালের বোঝা চাপিয়ে ভালুকায় ফিরতে থাকে। খবর পেয়ে প্লাটুন কমান্ডার মো. হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন, দিলদার আহমেদ, মো. আবদুল মোতালেব, মনিরউদ্দিন ও আবদুল মান্নানসহ মোট ১৪ জন মুক্তিসেনা ৪ মাইল রাস্তা দৌড়ে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ১২ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। গ্রেফতারকৃত সমস্ত লোক ও লুট করা জিনিসপত্র ফেলে পাকসেনারা ভালুকা ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা ছাতক ও সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মধ্যে রেলওয়েট্র্যাক উড়িয়ে রেল যোগাযোগ নষ্ট করে। ময়মনসিংহ-সিলেট সেক্টরের নওগ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৩ জন পাকসৈন্যকে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী পূর্ব গোদাগাড়ী-বড়খাঁটা এলাকায় চলন্ত যানে আক্রমণ চালিয়ে ৮ জন পাকসেনা হত্যা করে। দিনাজপুর জেলার পারলিয়া এবং আমারকিয়ানায় অভিযান চালিয়ে ৬জন পাকসেনা হত্যা করে।

সিলেটে আমলসিদ মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর দুই প্লাটুন যোদ্ধার ওপর পাকহানাদাররা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে তীব্র আক্রমণ চালায়। এতে পাকবর্বরদের শেলিংয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক ও আকমল আলী শহিদ হন এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। গেরিলা সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ৬ জন পাক পুলিশকে নদী পথে বগুড়া থেকে সরিয়াকান্দি খাদ্য নিয়ে যাওয়ার পথে ফুলবাড়ি ঘাটে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ২ জন পুলিশ নিহত হয়। বাকী ৪ জন পুলিশ পালাতে গিয়ে জনসাধারণের হাতে ধরা পড়ে ও নিহত হয়। গেরিলারা কিছু অস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী দখল করে।

৬ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী সুবেদার মেজর আরব আলীর নেতৃত্বে পাকসেনাদের নাগেশ্বরী অবস্থানের ওপর ঝাটিকা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কোন ক্ষতি ছাড়াই নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ইছাখালী বিওপি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ৩ জন সৈন্য নিহত হয়।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জেষ্ঠ্য পুত্র কাজী সব্যসাচী কবিকে দেয়া পাকিস্তান সরকারের মাসিক ভাতা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে মাসিক ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এদিন কবির কলকাতার বাসভবনে অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশের হাই কমিশনার এম হোসেন আলী কবিকে ২১০০ রুপির একটি চেক প্রদান করেন।

রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা করা হয়, প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সকলের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক গোলযোগের সময় গত ১ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত যারা অপরাধ করেছেন অথবা যাদের প্রতি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের সবাইকে ক্ষমা করা হয়েছে। আগামীকাল থেকে কার্যকর এই সাধারণ ক্ষমা সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ ও আনসারসহ সকলের প্রতি প্রযোজ্য হবে।