০৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এই দিনে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অধিনায়কদের সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে তিনি বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তার কোনো বিকল্প নজির নেই। পৃথিবীর আর কোথাও জনগণ এভাবে সংঘবদ্ধ হতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, ভারত এখন এক কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, অন্যদিকে ভারতে বহিঃশত্রুর হুমকি। এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারতকে তৈরি থাকতে হবে। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সেই দায়িত্ব বিশেষভাবে নিতে হবে।
ভারত সফররত যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির সাংসদ কেনেথ বেকার পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি শরণার্থী পরিদর্শনের পর দিল্লি রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের ইঙ্গিত দেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের উদ্যোগ যাতে বন্ধ হয়, সে জন্য তাঁদের সরকার পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
নেপালের রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব এবং প্রধানমন্ত্রী কীর্তিনিধি বিস্তা কাঠমান্ডুতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার সরণ সিংয়ের সঙ্গে আলোচনার সময় বলেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশের ব্যাপারে নেপাল ভারতকে সমর্থন জানাবে।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে কাজী সব্যসাচী কবির জন্য পাকিস্তান সরকারের আবার মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, লাখ লাখ মানুষের রক্তমাখা টাকা তিনি স্পর্শ করবেন না। পাকিস্তান কবিকে ভাতা দেওয়া বন্ধ করলে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি কবিকে ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর পাকিস্তান আবার কবিকে মাসিক ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কাজী সব্যসাচী এদিন দিল্লিতে এক বিবৃতিতে বলেন, কবিকে নতুন করে মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব পাকিস্তানের ঔদ্ধত্য।
প্যারিসে আন্তসংসদীয় সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি আলোচনার জন্য সদস্যদের ভোটে আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হলেও বিষয়টি স্ট্যান্ডিং অর্ডারের বিধিবহির্ভূত বলে সম্মেলনের চেয়ারম্যান ফ্রান্সের অ্যাকিলি পেরেসি রায় দেন, বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হবে না। এর আগে সম্মেলনের আলোচ্যসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য ৪৯৮-৭৪ ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ১৯৫ জন ভোটদানে বিরত থাকেন। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন ভারতের প্রতিনিধিদলের প্রধান এবং ভারতের লোকসভার স্পিকার ড. জি এস ধীলন। আপত্তি করেছিলেন মূলত আরব ও মুসলমান সাংসদেরা।
নরওয়ে সফররত যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এদিন অসলোর মেয়রের সঙ্গে দেখা করেন। মেয়র বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানান। আবু সাঈদ চৌধুরীকে অসলো শহরের আলোকচিত্র–সংবলিত একটি বই উপহার দেওয়ার সময় তাঁকে তিনি বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেন।
আবু সাঈদ চৌধুরী বিকেলে নরওয়ের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্টলটেনবার্গ বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে নরওয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি পেশ করবে।
ব্রিটেনের দ্য টাইমস পত্রিকা এদিন দেশটির সাবেক মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির নেতা পিটার ডেভিড শোরের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পিটার শোর বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আবার বাণিজ্যিক বা আর্থিক সাহায্যের সূচনা করা যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত হবে না। পাকিস্তানের সরকারকে বুঝতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। সেখানে ক্ষমতা থেকে তাদের সরে আসতে শুরু করতে হবে। যুক্তরাজ্য সরকার এ পর্যন্ত একটি সন্তোষজনক সীমারেখা গ্রহণ করেছে। তবে অক্টোবরে আবার বাণিজ্য সুবিধা শুরু করার ঔচিত্য নিয়ে ভাবতে হবে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর হিসেবে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক এদিন শপথ নেন। শপথবাক্য পাঠ করান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজীসহ উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সামরিক কর্তৃপক্ষ পাকিস্তান জাতীয় লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। ধামরাইয়ের গ্রামের বাড়ি থেকে ১৪ জুন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ৩ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালান। এতে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং দুজন আহত হয়।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধারা হামলা করলে কয়েকজন সশস্ত্র রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ভোমরা সীমান্তঘাঁটিতে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করেন। তাঁদের আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
ভালুকার ভরাডুবা গ্রামে ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের ওপর হামলা করলে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।