৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

৩১ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহারে কয়েকটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শনের পর বলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে খুবই হইচই হচ্ছে। বাংলাদেশকে কেন স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না, বহুবার এ কথা বলা হয়েছে। ভারত সরকার যে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনকে কাজ করতে দিয়েছে, এটা কি এক অর্থে স্বীকৃতি নয়? তিনি বলেন, ‘আমি স্বীকৃতির বিরোধী নই।’ তবে তিনি বলেন, এখনই স্বীকৃতি দিয়ে সস্তা বাহবা পাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশকে ঠিক সময়েই স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এখন প্রয়োজন বাংলাদেশের জনগণকে উদ্ধার করা। তাদের সাহায্য করা। কারণ, জয় তাদের হবেই। সমগ্র দেশের জনগণই তাদের পেছনে।


বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন উর্দু দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকেরা এদিন মুম্বাইয়ে পাকিস্তানের উপহাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ দেখান। সেখানে একটি স্মারকলিপিও দেন।
ব্রিটেনের সাবেক মন্ত্রী ও কমন্স সভায় লেবার পার্টির এমপি পিটার শোর দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে এখন ঘটছে পুরোনো পাকিস্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা এবং একটি নতুন জাতির জন্মের প্রসববেদনা। এখন বিশ্বের কাছে প্রশ্ন, এই নবজাতকটিকে নিদারুণ দুঃখকষ্টে ফেলে রাখা হবে, নাকি গণতন্ত্র ও শান্তির পথে কিছু ব্যবস্থা করা হবে। পিটার শোর জানান, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ আরও দুজন মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তাঁরা স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো সমাধানে রাজি নন।


যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অনুরোধে ব্রিটেনপ্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের নেতা মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু ৩১ আগস্ট রোমানিয়ায় বিজ্ঞান ও বিশ্ব শান্তি শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্য জেরি স্মিথের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র প্রেরণ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানান। এরপর তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে যথাসাধ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।


মোহাম্মদ হোসেন পরে সম্মেলনের সভাপতি সুইডেনের খ্যাতনামা অধ্যাপক অ্যালভেনের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ–সম্পর্কিত দলিলপত্র ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি চিঠি তাঁর হাতে দেন। অধ্যাপক অ্যালভেন পরদিন সম্মেলনের মূল অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।


রাওয়ালপিন্ডিতে ঘোষণা করা হয়, অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের পরিবর্তে বেসামরিক গভর্নর হিসেবে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিককে এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেছেন। টিক্কা খান একই সঙ্গে গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক—দুই পদেই ছিলেন। বলা হয়, বেসামরিক গভর্নর নিয়োগ করা হলেও সেনাবাহিনী আগের মতো কাজ করবে।


ব্রিটিশ হাইকমিশন ঘোষণা করে, বিদেশি পত্রপত্রিকার ওপর পাকিস্তান সরকার সেন্সর বিধি প্রয়োগ করায় হাইকমিশন সব ব্রিটিশ পত্রপত্রিকার বণ্টন স্থগিত রেখেছে। পাকিস্তান সরকার যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দূতাবাসকে পাকিস্তানবিরোধী রচনাসংবলিত পত্রপত্রিকা বিলি না করার জন্য অনুরোধ করেছে।


পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল এবং কিছু রাজাকারকে এদিন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থেকে কয়েকটি নৌকায় ছিরামিসি বাজারে যায়। রাজাকারদের মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের ছিরামিসি উচ্চবিদ্যালয়ে জমায়েত করা হয়। এরপর সমবেত গ্রামবাসীকে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে কোনো কোনো দলকে নিকটবর্তী পুকুরপাড়ে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। এভাবে পাকিস্তানি সেনারা ছিরামিসি গ্রামের ১২৬ জন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। এ ছাড়া তারা জনশূন্য ছিরামিসি গ্রাম ও বাজারে লুটতরাজ চালায় এবং দোকান ও ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।


মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এদিন কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালান। একটি দল ঢাকার সূত্রাপুর থানায় বোমা নিক্ষেপ করলে পাকিস্তান–অনুগত কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়। আরেকটি গেরিলা দল কলাবাগানে পাকিস্তান–অনুগত পুলিশের ওপর হামলা করলে তিন-চারজন হতাহত হয়। আরও দুটি দল যথাক্রমে কালিগঞ্জ-ডেমরা এবং কালিগঞ্জ-টঙ্গীর মধ্যবর্তী বিদ্যুৎ পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে। নরসিংদীতে অন্য গেরিলারা শিবপুর থানায় হামলা করলে থানা ও রাজস্ব অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের ভাটেরচরের কাছে সড়ক সেতুতে অবস্থানরত গেরিলারা পাকিস্তানিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কিছু পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারকে হতাহত করে। গেরিলারা সেতুটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়।


শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়ণখোলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৫০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদেরও বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

 

৩১ আগস্ট ১৯৭১: ঢাকার একটি গেরিলা দল সূত্রাপুর থানা আক্রমণ করে

 

গেরিলারা পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ফাইল ছবি

গেরিলারা পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এদিন ঢাকার একটি গেরিলা দল সূত্রাপুর থানা আক্রমণ করে। এতে ২ জন পুলিশ নিহত ও ২ জন আহত হয়। ঢাকার কলাবাগানে পাকিস্তানী পুলিশের উপর আকস্মিক আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদল। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়।

এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কালিগঞ্জ- ডেমরা এবং অপর আরেক দল কালিগঞ্জ-টংগী-র মাঝে ৪টি বিদ্যুৎ পাইলন ধ্বংস করে দেয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল নরসিংদীর শিবপুর থানা আক্রমণ করে থানা ও রাজস্ব অফিস জ্বালিয়ে দেয়। গেরিলারা থানা থেকে ৮টি রাইফেল, ৫টি শর্টগান ও ৪০ রাউন্ড গুলি দখল করে। এ খবর পেয়ে নরসিংদী থেকে পাকসেনাদের একটি কোম্পানী ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হলে আরেকটি গেরিলা দল পুটিয়রের কাছে তাদের অ্যামবুশ করে। চারঘন্টা সংঘর্ষের পর গেরিলাদের চাপের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নরসিংদীর দিকে পালিয়ে যায়। এক সংঘর্ষে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সেলিমসহ ৩৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। 

রাত ২টার দিকে পাকসেনা ও রাজাকারদের দুটো কোম্পানী সিলেটের টাকাইকোনা, বঘা এবং খড়মপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ করে। কিন্তু মুক্তিফৌজের প্রবল প্রতিরোধের মুখে হানাদাররা ভোর ৪:৩০ এর দিকে ফিরে যায়। এ সময় মাইন বিস্ফোরণে শত্রুদের ৬ জন নিহত হয়ে। দুপুর ১টার দিকে শত্রুরা একই দিক থেকে আবারো মরনপণ আক্রমণ করে, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর ৩” মর্টারের সফল গোলাবর্ষণের ফলে তারা আবারো পিছাতে বাধ্য হয় বিকেল ৪ টার দিকে। হানাদারদের ৭ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়। গেরিলাদের মধ্যে দুজন বুলেটের আঘাতে এবং ২ জন গোলার আঘাতে আহত হয়।

সকাল ৯-১০ টায় পাকহানাদার বাহিনী সুনামগঞ্জের কিছু রাজাকার, আলবদর নিয়ে জগন্নাথপুর হতে ৮-৯টি নৌকায় ছিরামিসি বাজারে আসে। রাজাকাররা গ্রামবাসীকে শান্তি কমিটির মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার জন্য ছিরামিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে জমায়েত হতে নির্দেশ দেয়। আগত সবাই স্কুল হল রুমে আলোচনা আরম্ভ করার জন্য অপেক্ষা করবার সময় বর্বররা শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী ও যুবকদের আলাদা রুমে ডেকে নিয়ে পেছন দিক দিয়ে হাতগুলো বেঁধে ১৫-১৬ জনের এক একটি দল করে নদীর পারে নৌকায় নিয়ে নির্বিবাদে গুলি চালায়। কোন কোন দলকে নিকটবর্তী পুকুরপাড়ে সারবেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পানিতে পড়ে বাঁচার চেষ্টা চালালে পুকুরপাড় থেকে পাক বর্বররা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে। এভাবে পাক জল্লাদরা ছিরামিসি গ্রামের ১২৬ জন নিরীহ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করে। হত্যাযজ্ঞের পর শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। ছিরামিসি বাজারের ২৫০টি দোকান কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে পাক হানাদাররা। সেখান থেকে হানাদাররা জনশূন্য গ্রামে গিয়ে লুটতরাজ চালায় ও ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

মেজর আবদুল হালিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল ধোপাখালী বিওপি থেকে কয়েক মাইল ভিতরে বাঘছড়া থানা হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করে। কিন্তু রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন সংবাদ পেয়ে পালিয়ে যায়। ফেরার পথে মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির একজন সদস্যের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৪টি বন্দুকসহ চারজন রাজাকারকে বন্দী করে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। শেরপুরের নকলায় নারায়ণখোলা যুদ্ধে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ অর্ধশতাধিক মানুষ শহিদ হন। এ যুদ্ধে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের ৫০-৬০ জন সদস্য নিহত হয়।

ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তার ভাটেরচরের কাছে সড়ক সেতুতে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের ওপর গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকসেনা এবং রাজাকার নিহত হয়। গেরিলারা সেতুটির ৬০ ফুট লম্বা স্প্যান উড়িয়ে দেয়। এতে পাকসেনাদের ঢাকা-কুমিল্লা সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়।

সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতনের বদলে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যবস্থা না করা হলে পাকিস্তানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ডা. এ এম মালিক ও লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজীকে যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তবে, সরকারীভাবে বলা হয়, বেসামরিক গভর্নর নিয়োগ করা হলেও সেনাবাহিনী আগের মতোই কাজ করবে। গোলাম আযম করাচীতে সংবাদ সম্মেলনে ন্যাপ (ভাসানী), আতাউর রহমান খানের ন্যাশনাল লীগ, ন্যাপ (ওয়ালী) সহ অন্যান্য ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও জাতীয় পরিষদ বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবী জানান।