৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৯ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে

এদিন ঢাকায় সামরিক আইন প্রশাসক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগের ২৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।

তারা হলেন আবদুল মমিন, আবদুল হামিদ, জিল্লুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মৌলভী হুমায়ুন খালিদ, শামসুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আলী আজম, আবদুস সামাদ আজাদ, মোহাম্মদ আবদুর রব, মোস্তফা আলী, এ কে লতিফুর রহমান চৌধুরী মানিক, দেওয়ান ফরিদ গাজী, মোহাম্মদ ইলিয়াস, ফজলুর রহমান, এ কে শামসুজ্জোহা, আবদুল করিম ব্যাপারী, এ ভুঁইয়া, শামসুল হক, কে এম ওবায়দুর রহমান, মোল্লা জালাল উদ্দিন, শামসুদ্দিন মোল্লা, এম এ গফুর, শেখ আবদুল আজিজ, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এ মান্নান হাওলাদার, আবদুর রব সেরানিয়াবাত এবং এনায়েত হোসেন খান।

১৯ আগস্ট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত বিশ্ব জনমত অনুষ্ঠানে বলা হয়, 'পাকিস্তানের সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে প্রহসনের তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক চক্রকে এই বলে হুঁশিয়ার করেছেন যে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশে যা করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে প্রহসনে মেতে যা করতে যাচ্ছে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এর ফলে পাকিস্তানটাই তাসের ঘরের মতো এক মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে। দু' সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানি জাহাজ আল-আহমাদী মার্কিন সমরাস্ত্র বহনের জন্য ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু সেখানে পাকিস্তানি জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং বিক্ষোভকারীরা ছোট ছোট নৌযান দিয়ে পাকিস্তানি জাহাজের সম্মুখে অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে পাকিস্তানি জাহাজটিকে ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে বাল্টিমোরের দিকে অগ্রসর হয়।'

ঢাকায় এদিন

১৯ আগস্ট মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় হাবিব ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সামনে সকাল ১১টার দিকে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা মাহবুব আহমদ শহীদের নেতৃত্বে একটি টয়োটা গাড়ি ১০ পাউন্ড বিস্ফোরকসহ বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় বেশ কিছু গাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়।

ভারতে এদিন

১৯ আগস্ট কলকাতায় বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানো অপারেশন ওমেগার অন্যতম সদস্য ড্যানিয়েল গ্রোটা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের আটক করে যে ধরনের স্বৈরাচারের পরিচয় দিয়েছে তাতে আমরা মর্মাহত। এ মুহূর্তে সাধারণ মানুষের ত্রাণ প্রয়োজন। আমাদের এই যাত্রা সফল না হলেও আমরা অনেকখানি এগিয়ে গেছি। বাংলাদেশে আমাদের আটক করার আগে আমরা দেখেছি সীমান্তের পর থেকে গ্রামের পর গ্রাম কীভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে।'

১৯ আগস্ট লোকসভার সদস্য ও ভারতীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম সুলেমান সাইফ এক বিবৃতিতে বলেন, 'ভারত সরকার যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায় তবে মুসলিম লীগ ও ভারতে বসবাসকারী আমরা ৮ কোটির বেশি মুসলমান দৃঢ়ভাবে সরকারকে সমর্থন করবো। পূর্ব বাংলায় যা হচ্ছে তা পৈশাচিক ও বর্বরতার সীমা বহু আগেই ছাড়িয়ে গেছে।

১৯ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ শান্তি সংসদ আয়োজিত এক সভায় গায়ানার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছেদি জগন বলেন, 'পূর্ব বাংলার মানুষ এখন স্বাধীনতার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। এছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। কোনো দেশের স্বৈরশাসক ও স্বৈরাচারই জনগণের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। যুগের পর যুগ ধরে তাদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে তা ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না।'

পাকিস্তানে এদিন

১৯ আগস্ট পাকিস্তান সরকার এক ঘোষণায় বলে, 'পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত ৯৪ জন সদস্যের সদস্যপদ ব্যক্তিগত পর্যায়ে বহাল থাকবে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৯ আগস্ট ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রবার্ট ম্যাকক্লক্সি বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে বলে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি যে অভিযোগ করেছেন তাতে মার্কিন সরকার তার মতের সঙ্গে একমত নয়।'

১৯ আগস্ট ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন সরকার যে দুটো বোয়িং বিমান পাকিস্তানকে লিজ দিয়েছে সেগুলো পূর্ব পাকিস্তানে সেনা পরিবহনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে বলে যে অভিযোগ সম্প্রতি একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে সে ব্যাপারে পূর্ণ তদন্ত করছে মার্কিন সরকার। এই দুটো বোয়িং বিমান দেয়া হয়েছিল যাত্রী পরিবহনের জন্য। সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের জন্য নয়।'

১৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া কর্তৃপক্ষের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'সম্প্রতি একটি পাকিস্তানি জাহাজ থেকে পালানো ছয় জন বাঙালি নাবিক ফিলাডেলফিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন।'

এরই মধ্যে জাহাজটি বন্দর ছেড়ে করাচির উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার পর তারা রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। তাদের পক্ষে মূলত ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের মুখপাত্র রিচার্ড টেইলার আবেদনটি করেছেন।

১৯ আগস্ট নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হৃষিকেশ শাহ এক বিবৃতিতে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার শুরু ন্যায় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ নীতির বিরোধী এবং বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বাধাস্বরূপ। এর ফলে শরণার্থী সমস্যাটা আরো প্রকট হয়ে উঠবে।' এর আগে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চেয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন করেছিলেন হৃষিকেশ শাহ।

১৯ আগস্ট জাতিসংঘের একটি কূটনৈতিক সূত্র বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনার জন্য ঘোর বিরোধী। জাতিসংঘে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ভিকটর ইসরায়েলিয়ান জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে সোভিয়েত ইউনিয়নের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন সমস্ত সমস্যার উদ্ভব হয়েছে পাকিস্তান থেকেই। পাকিস্তানই মূলত আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করলেই পূর্ব বাংলার দুঃসহ অবস্থার অবসান হবে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন

১৯ আগস্ট দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় 'ইরানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান ও আলোচনার জন্য ইসলামাবাদ ও তেহরানে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এই উদ্যোগের পক্ষে নিজেদের সমর্থন ঘোষণা করেছে। আলোচনার জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান মোহাম্মদ খান ইতিমধ্যেই তেহরান এসেছেন।'

১৯ আগস্ট ইন্ডিয়া নিউজ এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাই না। অন্যদিকে তিনি একই সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি চার দফার দাবি তথা অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম ঘোষণা, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ক্ষতিপূরণ এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

১৯ আগস্ট নিউ টাইমস পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে বলা হয় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহান ইয়াহিয়া খানের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের বিষয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারের মুখোমুখি করলে পুরো পাকিস্তানের ভবিষ্যৎই সুতায় ঝুলবে। তার বিচার জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।' চিঠিতে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিষয়টি মানবিক দিক থেকে ভেবে দেখার অনুরোধ করেন।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় কুড়িগ্রামের চিলমারীতে মেজর জামিলের নেতৃত্বে থার্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাঙ্কারের ভিতরে ঢুকে চার হানাদার সৈন্যকে হত্যা করে। রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠে। এসময় হানাদার বাহিনীর আর্টিলারি হামলার পরেও মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পিছু নেয়। এদিন চিলমারী থেকে পালাতে পারে মাত্র ১ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য।

ভোররাতে ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি বাঙ্কারে, পজিশনে, ডিফেন্স লাইনে। প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটতে গিয়ে প্রায় ৭০০ হানাদার সৈন্য ৭/৮ মাইল দূরে চিলমারী রেলওয়ের স্টেশনের দিকে গেলে পুনরায় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশের শিকার হয়। এসময় বহু হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

১৯ আগস্ট মুক্তিবাহিনী সাঁটুরিয়া থানায় অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর এই অপারেশনে ৪ জন হানাদার সেনা ও ৫ জন পুলিশ নিহত হয়। এসময় ১৪ জন হানাদার সেনাকে আটক করে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়।

এসময় থানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেন।

১৯ আগস্ট ময়মনসিংহ-সিলেট- মৌলভীবাজার সেক্টরে কামালপুরের কাছাকাছি একটি সেতু উড়িয়ে দেয় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাহারারত রাজাকারদের হত্যা করে।

১৯ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি নৌকা শালদা নদী অবস্থান থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনী ছোট নাগাইশের কাছে নৌকাগুলোর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাকবাহিনীর দুটি নৌকা পানিতে ডুবে যায় ও ২০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। পিছনের নৌকাটি দ্রুত পাড়ে ভিড়লে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা দ্রুত পাড়ে উঠে মুক্তিবাহিনীর উপর পাল্টা হামলা চালায়। প্রায় চার ঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধের পর হানাদার সেনারা পিছু হটে।

১৯ আগস্ট কুমিল্লায় বেলা ১টার সময় মুক্তিবাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে হানাদার বাহিনীর শালদা নদী গুদামের একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। এসময় বাঙ্কারে থাকা ৮ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

১৯ আগস্ট খুলনার পাইকগাছায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চকে অ্যামবুশ করে। এ সময় লঞ্চে থাকা ২৬ হানাদার সেনা নিহত হয়।

 

শাফী ইমাম রুমী: আর ফিরে আসেনি
মুক্তিযুদ্ধ

শাফী ইমাম রুমী: আর ফিরে আসেনি

“স্বাধীনতা তুমি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি”

জেমসের এই গান শুনে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়নি কিংবা রক্তে আগুন ধরে যায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। আবেগী বাঙালির জন্য আবেগপূর্ণ এই গান। এই গানে বাংলাদেশের অসংখ্য মহাপ্রাণ মানুষের কথা বলা হয়েছে।ওপরের লাইনটিতে বলা হয়েছে জাহানারা ইমামের কথা। আমাদের আজকের গল্প, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র শাফী ইমাম রুমীকে নিয়ে।

জাহানারা ইমামের করা দুটি প্রশ্নের জবাবে সেদিন হয়তো অজিত নিয়োগী মিথ্যা বলেছিলেন অথবা তার করা ভবিষ্যৎ বাণী ভুল হয়েছিল। বলছি ১৯৭১ সালের ১৭ ই মার্চের কথা। অজিত নিয়োগী ছিলেন একজন এস্ট্রোলজার। সেদিন জাহানারা ইমামের বাসায় গেলে জাহানারা ইমাম তাকে দুটি প্রশ্ন করেছিল। এক নম্বর প্রশ্ন-দেশের রক্তস্রোত হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কিনা? দুই নম্বর প্রশ্ন- তার কপালে পুত্রশোক আছে কিনা? জাহানারা ইমামের করা দুটি প্রশ্নেই বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলেন অজিত নিয়োগী। তিনি এটি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাহানারা ইমামের জোরের মুখে অজিত নিয়োগী বললেন রক্তস্রোতের সম্ভাবনা খুবই ছিল। অল্পের জন্য ভয়াবহ রক্তস্রোতের সম্ভাবনা এড়ানো গেছে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে বললেন “না আপনার কপালে পুত্রশোক নেই। তবু রুমীকে একটু সাবধানে রাখবেন।” সেদিন হয়তো অজিত নিয়োগী ভবিষ্যদ্বাবাণী করার ক্ষেত্রে ভুল করেছিলেন অথবা জেনেও মিথ্যে বলেছিলেন। কেননা পরবর্তীতে জাহানারা ইমামকে পুত্রশোকে কাতর হতে হয়েছিল। ১৯৭১ এর ২৯ আগস্ট পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে রুমী। পরবর্তীতে শহীদ হন রুমী। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার মৃত্যুর জন্য জাহানারা ইমাম শহীদ জননী উপাধি পান।

শাফী ইমাম রুমী: আর ফিরে আসেনি
ছবি: newsviews.media

প্রারম্ভিক জীবন

শাফী ইমাম রুমী ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠপুত্র। ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ রুমীর জন্ম। দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা গর্ভধারিনী মাকে কষ্ট দিয়ে বেলা বারোটার দিকে পৃথিবীর আলো দেখেন তিনি। রুমীর জন্ম হয় তার বাবা শরিফ ইমামের বন্ধু ডা. এ. কে খানের তত্ত্বাবধায়নে। বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছিল বলে সদ্যভূমিষ্ঠ রুমী সম্পর্কে ডাক্তার তার মাকে বলেছিল, “এটি ১৯৫১ সাল। ২০ বছর পরে ১৯৭১ সালে এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে।” পিতা শরীফ ইমাম ও মাতা জাহানারা ইমাম প্রিয় কবি জালালউদ্দিন রুমীর মত জ্ঞানী ও দার্শনিক হবে ভেবে ছেলের নাম রেখেছিল রুমী। আজিমপুরের একটি কিন্ডারগার্টেন এ পড়াশোনার মাধ্যমে রুমীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে আদমজী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ হতে মেট্রিকুলেশন পাশ করে রুমী। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডের তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে স্টারমার্ক নিয়ে আই এস সি পাশ করেন রুমী। ১৯৭০ এর অক্টোবরে ভর্তি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তথা বুয়েটে। কিন্তু সেখানে ক্লাস শুরুর কথা ছিল মার্চ থেকে। তাই অবসর সময় কাজে লাগাতে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স বিভাগের প্রধানের অনুমতি নিয়ে সেখানে ক্লাসও করেন রুমী। আর এর মাঝেই সুযোগ পান আই.আই.টি তে। সেখানে ক্লাস শুরুর কথা ছিল ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরে।

শাফী ইমাম রুমী: আর ফিরে আসেনি
ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন

রুমী ছিলেন বেশ অদ্ভুত ধরনের। তার সাথে কথায় কেউ পারত না। কখনও বাংলা, কখনও ইংরেজি কবিতা কিংবা উপন্যাসের যুক্তি দিয়ে মা-বাবাকে কথায় হারিয়ে দিতেন, কখনো বা হৃদয়-গলানো হাসি। বেঁচে থাকলে উদ্দাম এই তরুণ হয়তো বিশ্বজয় করতে পারতেন। পিতা-মাতার মতোই রুমী ছিল রাজনীতি সচেতন। তবে রুমী কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিল না। সদস্য না থাকা সত্ত্বেও একাত্তরের উত্তাল সময়ে প্রতিটি মিছিল-মিটিংয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল তার। মা জাহানারা ইমাম যখন জানতে চায়, “তুইতো কোন দলের মেম্বার নস। তোর এত সব মিটিংয়ে যাওয়া কেন?” জবাবে রুমী বলেন, “এখন কি আর ব্যাপার দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে নাকি আম্মা? এখনতো এ আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে।” মা অন্তঃপ্রাণ ছেলে রুমী। একদিন তার যুদ্ধে যাবার সুযোগ এসে গেল। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রুমী হয়তো পারতেন বিদেশে গিয়ে নিজের জন্য কিছু করতে। আর দশজন বাঙালি যুবকের মতো সদ্য তারুণ্যে পা রাখা রুমী ইমামের মনে নাড়া দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে যাবার আহ্বান । বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ভাষণ,

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

যারা দেশকে ভালোবাসে, এ ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা ছিল না তাদের। রুমীও পারেননি সেই ডাককে অবহেলা করতে। ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ এর রাতে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষী হয়ে যারা সেই রাত্রেই দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে যাওয়ার সংকল্প করেছিলেন তাদের মধ্যে রুমীও ছিলেন একজন। এপ্রিল থেকেই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মাকে রাজি করানোর চেষ্টায় থাকে রুমী। কিন্তু মা জাহানারা ইমাম চেয়েছিলেন তাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিতে। কেননা সেপ্টেম্বর থেকে তার আই.আই.টিতে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। তখন কাতরভাবে রুমী বলেছিল, “আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রী নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব, কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তা চাও আম্মা?” ছেলের এমন অটল দেশপ্রেম দায়িত্ববোধ দেখে মা জাহানারা ইমাম তাকে আর না করতে পারেননি। তিনি বলে উঠলেন, “না তা চাইনে। ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।”

শাফী ইমাম রুমী: আর ফিরে আসেনি
ছবি: সংগৃহীত

২১ এপ্রিল মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ৭ ই মে রুমী সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা চালায়। কিন্তু রুমীসহ তার দল যে পথ দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিবে ঠিক করে তা ততদিনে পাক বাহিনীর দখলে চলে যায়। ১১ই মে পুনরায় ঢাকা ফিরে আসেন রুমী। ১৪ই জুন দৃঢ়চেতা রুমী আবার চেষ্টা চালান। এবার মেলাঘরের উদ্দেশ্যে। সফল হন তারা। ভারতে রুমী ২ নং সেক্টরে যোগ দেয়। সেখানে প্রায় দুই মাসের মত গেরিলা ট্রেনিং সহ সুপার এক্সপ্লোসিভ বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন রুমী। আগষ্টের ৮ তারিখে রুমী অন্য গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে ঢাকায় ফিরে আসেন। কাজী কামাল উদ্দিন ছিলেন সেই দলের প্রধান। তাদের দায়িত্ব ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ধ্বংস করে দেয়া। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এ হেভি সিকিউরিটির কারণে তাদের অ্যাকশনে যেতে সময় লাগছিল। এরমধ্যে রুমীদের দল বেশ কয়েকটি অপারেশন করে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ধানমন্ডিতে দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশন। ২৫ শে আগস্ট রুমী সহ আরো পাঁচজন গেরিলা যোদ্ধা ধানমন্ডিতে তিনটি অপারেশন করে। প্রথমটি ছিল ১৮ নম্বর রোডে। দ্বিতীয় টি ছিল ৫ নম্বর রোডে। প্রথম দুটি অপারেশন সফল ভাবে সম্পন্ন করার পর রুমীদের গাড়ি যখন গ্রীনরোড দিয়ে এগোচ্ছিল তখন রুমী লক্ষ করে পাকিস্তানি আর্মির একটি জীপ তাদের অনুসরণ করছে। জিপ দেখামাত্রই রুমী তার হাতের স্টেনগানের বাট দিয়ে গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে ফায়ার শুরু করে। এতে গাড়ির চালক গুলিবিদ্ধ হয়। জিপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোড়ে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খায় এবং সঙ্গে সঙ্গে উল্টে যায়। এই অপারেশনের পর রুমী তার সহযোদ্ধাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা গ্রেফতার ও পরিণতি

এই অপারেশনের পর ২৯ আগস্ট আনুমানিক রাত বারোটার দিকে রুমীসহ তার বাবা, ভাই জামি, বন্ধু হাফিজ ও চাচাতো ভাই মাসুমকে তাদের বাসভবন কনিকা থেকে গ্রেফতার করে পাক হানাদার বাহিনী। সেই দিন কোনো এক অজ্ঞাতনামা উৎস থেকে হানাদার বাহিনী আরো বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধাদের আটক করে। তাদের মধ্যে ছিলেন বদি, চুল্লু, সামাদ, জুয়েল, বাশার, আজাদ, আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারক সহ আরো অনেকে। এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলে নেওয়ার পর রুমী তার বাবা ভাই কে বলেছিল, “তোমরা কেউ কিছু স্বীকার করবে না, তোমরা কেউ কিছু জানো না, আমি তোমাদের কিছু বলিনি।” ভয়ঙ্কর অত্যাচারেও একটি তথ্য ও রুমী থেকে বের করা যায় নি। অনিবার্য পরিণতির কথা জেনেও অন্য সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষার জন্য সহ্য করে যান অমানুষিক নির্যাতন। একই সময় ধরা পড়া রুমীর সহযোদ্ধা মাসুদ সাদেক জানান, “চরম অত্যাচার সহ্য করেও রুমী কারো নাম প্রকাশ করেনি।” দুদিন অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর রুমীর পরিবারের বাকিদের ছেড়ে দেয়া হলেও রুমীকে ছাড়া হয়নি। ফিরে আসার সময় বাবা শরীফ ইমাম রুমীর কথা জিজ্ঞেস করলে পাকিস্তানি কর্নেল জানায়, রুমী যাবে এক দিন পরে, ওর জবানবন্দি নেওয়া শেষ হয়নি। পরের সেই দিনটি আর আসেনি। ৩০ আগস্টের পর রুমী ও তার সহযোগী বদিকে আর কখনো দেখা যায়নি। ৫ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, সেটা পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেরই পছন্দ ছিল না। তাই এর আগের রাতে অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর তাড়াহুড়ো করে শ খানেক বন্দীকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। ধারণা করা হয়, ৪ সেপ্টেম্বর রুমী শহীদ হন।

শাফী ইমাম রুমী: আর ফিরে আসেনি
ছবি: সংগৃহীত

ধরা পড়ার আগে ২৮ আগস্ট মা জাহানারা ইমাম রুমী কে বলেছিলেন, “রুমী, রুমী। এত কম বয়স তোর, পৃথিবীর কিছুই দেখলিনা। জীবনের কিছুই তো জানলি না।” জবাবে এক বেদনা হাসি হেসে রুমী বলেছিল, “যদি চলেও যাই কোন আক্ষেপ নিয়ে যাব না। হয়তো জীবনের পুরোটা তোমাদের মত জানিনা, তবু জীবনের যত রস, মাধুর্য, তিক্ততা, বিষ সব কিছুর স্বাদ আমি এর মধ্যে পেয়েছি।” সেদিন সেই বিষণ্ণ বিকেলে রুমী তার মাকে বলেছিল তার জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেম-বিরহ-মিলন-বিচ্ছেদের এক অনুক্ত কাহিনী। একটি পরমা সুন্দরী মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তারচেয়ে দু ক্লাস সিনিয়র ছিল। সেই মেয়ে তাকে হাতে ধরে প্রেমের আনন্দ বেদনার রাজ্যে প্রবেশ করিয়েছিল। শেষে মেয়েটি ছলনার শিকার হয়েছিলেন তিনি, রুমী তাতে প্রচন্ড দুঃখও পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে মেয়েটির ওপর তার কোন রাগ ছিল না। কারণ মেয়েটি তার কাছে তখন আর কোন রক্তমাংসের মানবী ছিল না। তখন সে তার মনের মধ্যে হয়ে উঠেছিল বিশুদ্ধ প্রেমের প্রতীক স্বরূপিনী।