২৮ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৮ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন সুইডেনে পাকিস্তান দূতাবাসে নিরাপত্তা বিভাগে নিযুক্ত কর্মচারী মহাম্মদ শফিউল্লাহ পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে দূতাবাসের চাকরি থেকে পদত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন জানিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য সুইডেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। পদত্যাগ শেষে স্টকহোমে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'দূতাবাসে আমিই একমাত্র বাঙালি। দেশের এই অবস্থায় যারা কিনা নিজের ভাইদের ওপর এমন বর্বর আচরণ করতে পারে, নির্মমতা ছাড়িয়ে যেতে পারে, গোটা বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করতে পারে, তাদের সঙ্গে আমরা আর এক থাকতে পারি না। আমরা এখন সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন একটি দেশ। আমাদের বিষয়টি কেবল আমরাই ভেবে দেখব।'
২৮ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম বলেন, 'শ্লোগান আওড়িয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবিলা করা যাবে না। আপনারা সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করুন। অতিসত্বর রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিন। শান্তি কমিটিতে নিবন্ধন করুন।'
ভারতে এদিন
২৮ আগস্ট দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করার পর এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন রিপাবলিকান দলের সিনেটর চার্লস পার্সি বলেন, 'মার্কিন সরকারের উচিত হবে না পাকিস্তানকে কোনো ধরনের সমরাস্ত্র সহায়তা দেওয়া এবং পাকিস্তানকে যেন আর প্রশ্রয় না দেওয়া হয়। এর ফলে ভারতের মতো দেশের বন্ধুত্ব আমরা হারাতে পারি। যারা আমাদের পুরনো পরীক্ষিত বন্ধু। একইসঙ্গে জাতিসংঘেরও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। পাকিস্তান যে ধরনের আচরণ করছে তা চরম অগ্রহণযোগ্য। তাদেরকে সহায়তা করা মানে এই অঞ্চলে একদিকে চরম বিপর্যয় ডেকে আনা, অন্যদিকে মানবিক বিপর্যয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকেও জড়িয়ে ফেলা।
২৮ আগস্ট কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী ও লেবার পার্টির নেতা পিটার শোর বলেন, 'পূর্ব বাংলার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। যে রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশের মাধ্যমে। আর এ জন্য জাতিসংঘকেই এগিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে গোটা বিশ্ব সজাগ হয়েছে অসহায় মানুষের জন্য। গোটা বিশ্বে মানুষ যেভাবে মানবতার জন্য দাঁড়িয়েছে তা অবিস্মরণীয়। সুতরাং কাজটি জাতিসংঘের জন্যও সহজ হবে। ব্রিটিশ সরকারও চায় পূর্ববঙ্গে স্থায়ী একটি রাজনৈতিক সমাধান আসুক। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা নিজ গৃহে ফিরে যাক।'
পাকিস্তানে এদিন
২৮ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে দাঁড়ানো প্রখ্যাত আইনজীবী এ কে ব্রোহি বলেন, 'গত ২১ আগস্ট আমার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা হয়েছে। তিনি সুস্থ আছেন। লায়ালপুর কারাগারে তাকে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
২৮ আগস্ট মার্কিন সিনেটের শরণার্থী বিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোন্স এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারে দণ্ড প্রদান করা হলে পাকিস্তানকে সব ধরনের মার্কিন সহায়তা বন্ধ করতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। এদিন তারা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য একটি প্রচার অভিযান শুরু করার ঘোষণা দেন।'
২৮ আগস্ট ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদ্য খোলা বাংলাদেশ মিশনকে বিদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, 'ব্রিটিশ সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কখনোই এই দূতাবাসের স্বীকৃতি দেবে না।'
২৮ আগস্ট প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় পাকিস্তান সরকারের আবেদনে কমিশনের সদস্যপদ থেকে আবু সাঈদ চৌধুরীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়। এরপর আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রবাসী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য মনোনীত করা হয়।
২৮ আগস্ট জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ ডব্লিউ বুশ জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এসময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য সমন্বয়ের জন্য মার্কিন সরকারের উদ্যোগে একটি 'মার্কিন টাস্ক ফোর্স' গঠন করেন।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
পাকুরিয়া গণহত্যা
২৮ আগস্ট সকালে নওগাঁর পশ্চিমে আত্রাই নদী তীরবর্তী মান্দা এলাকার পাকুড়িয়া গ্রামে ঢুকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একটি মিটিংয়ের কথা বলে রাজাকারদের মাধ্যমে গ্রামবাসীকে স্থানীয় স্কুল মাঠে জড়ো করে বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়ে ৩৫০ জনের মতো গ্রামবাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এরপর বয়োবৃদ্ধ ও শিশু কিশোরকে ছেড়ে দিয়ে বাকিদের আটকে রেখে পার্শ্ববর্তী বাঁশঝাড় থেকে চিকন কঞ্চি এনে গোটা শরীরে বেত্রাঘাত করে পৈশাচিক নির্যাতনের পর সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে ১২৮ জনকে হত্যা করে। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কয়েকদিনের মধ্যেই শহীদ হন।
২৮ আগস্ট মুক্তিবাহিনী সিলেটের জগন্নাথপুর থানার দিরাই ও শাল্লা এলাকা হানাদারমুক্ত করে সেখানে মুক্তিবাহিনীর শাসনব্যবস্থা চালু করে। এই দুই অঞ্চলে ক্যাপ্টেন সালেহ চৌধুরীকে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২৮ আগস্ট কুমিল্লার ময়ানপুরে ৫০ জন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যকে নিয়ে আসা তিনটি নৌকা পশ্চিম দিক থেকে নয়ানপুরের দিকে যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল তিনটি নৌকাকেই ডুবিয়ে দিলে নৌকায় থাকা সব হানাদার সৈন্য পানিতে ডুবে মারা যায়।
২৮ আগস্ট কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল ব্রাহ্মণপাড়া থেকে পাঁচটি নৌকায় শালদা নদী দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাঁচটি নৌকার ওপর অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর পাঁচটি নৌকাই পানিতে ডুবে যায়। এসময় একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। এর ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নদীপথে সব ধরনের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।
২৮ আগস্ট ২ নম্বর সেক্টরে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের 'এ' কোম্পানির অধীন মুক্তিবাহিনীর একটি টহলদার দল মাধবপুর গ্রামের বাইরে কাঁচা রাস্তায় অতর্কিত আক্রমণের জন্য ওঁত পেতে থাকে। এদিন বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি জীপ ও একটি ট্রাক মুক্তিবাহিনীর সীমানার মধ্যে ঢুকলে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়।
এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার বাহিনীর সৈন্য নিহত হয় এবং ছয় জন আহত হয়।
২৮ আগস্ট চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের কাছে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা নিজামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একটি রেলওয়ে ট্র্যাকে মাইন স্থাপন করে।
এদিন সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে একটি হানাদার সৈন্য ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন যাওয়ার সময় বিস্ফোরণ হলে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। এ ছাড়া, বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য ও রাজাকার আহত হয়।
২৮ আগস্ট চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের হাসনাবাদে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১০-১২টি নৌকায় করে আসার সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি বড় দলের অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন শহীদ হন এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ১০ জন সেনা নিহত হয়।
২৮ আগস্ট নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে মহেশপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের একটি দল আসার খবর শুনে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মহেশপুর গ্রামের চারপাশ ঘিরে ফেললে চার জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বাকি সেনারা পালিয়ে যায়।
২৮ আগস্ট খুলনার আশাশুনি থানা আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল। এসময় তারা টানা দুই রাত থানা অবরোধ করে রাখে। দ্বিতীয়দিন রাতে সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি দল ও হানাদারদের নৌবাহিনী আশাশুনি এসে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে ১৪ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং দুই জন মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হন।
অন্যদিকে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর তিন জন মিলিশিয়া ও ১৬ জন রাজাকার নিহত হয়।
২৮ আগস্ট চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের রাওয়াল গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল অতর্কিত হামলা চালালে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ১০ জন আহত হয়। এ আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২৮ আগস্ট সিলেটের শাহবাজপুর রেলস্টেশন ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল তাজপুরের দিকে অগ্রসর হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে তাজপুরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় চার জন রাজাকারসহ এক হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়।
২৮ আগস্ট দিনাজপুরে ক্যাপ্টেন দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অমরখানা অবস্থানের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন এবং বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য হতাহত হয়।
২৮ আগস্ট কুমিল্লার মুক্তিবাহিনী মাইজবার গ্রামে হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় প্রায় ৩৬ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
২৮ আগস্ট ১৯৭১: নওগাঁ শহরতলীতে ১২৮ জন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদাররা
লাইনে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের গুলিতে মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করে ১২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। ফাইল ছবি
১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট দিনটি ছিল শনিবার। এদিন নওগাঁ শহরতলী থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, আত্রাই নদীর তীরবর্তী মান্দা এলাকার পাকুরিয়া গ্রামে সকালে পাকহানাদার বাহিনী পায়ে হেঁটে প্রবেশ করে। মিটিংয়ের কথা বলে গ্রামবাসীকে ধরে আনে স্কুল মাঠে। একই সঙ্গে বাড়িঘর লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রায় ৩০০-৪০০ গ্রামবাসীকে স্কুল মাঠে জিজ্ঞাসাবাদ করে, বাচ্চা ও বয়স্কদের ছেড়ে দেয়। বাঁশের ঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে এনে বাকিদের প্রথমে বেধড়ক পেটায় তারপর সবাইকে কালেমা পড়তে বলে। এরপর পাক হানাদাররা লাইনে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের গুলিতে মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করে ১২৮ জনকে।
এদিন ৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে নিয়ে ৩টি নৌকা পশ্চিম দিক থেকে নয়ানপুরের দিকে আসবার পথে মুক্তিফৌজ তিনটি নৌকাকেই ডুবিয়ে দেয় এবং ঐ ৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্য ঘটনাস্থলেই মারা যায়। মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীকে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে পাঁচটি নৌকায় শালদা নদী দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে পাকসেনাদের পাঁচটি নৌকা পানিতে ডুবে যায়। একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের নদী পথে অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে সরবরাহ পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
নোয়াখালী অঞ্চলে ফরিদগঞ্জ থানার রাওয়াল গ্রামে হানাদারদের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলাদল অতর্কিত হামলা চালালে বেশ ক’জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং ১০জন আহত হয়। এ আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। ২ নম্বর সেক্টরে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানির অধীন মুক্তিসেনাদের টহলদার দল মাধবপুর গ্রামের বাইরে কাঁচারাস্তায় অ্যামবুশ পেতে অপেক্ষায় থাকে। এগারোটার সময় পাকসেনাদের একটি জীপ এবং একটি ট্রাক অ্যামবুশের আওতায় এলে আক্রমণ চালিয়ে গাড়ি দুটির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এই অ্যামবুশে কয়েকজন পাকসেনা নিহত এবং ৬ জন আহত হয়।
মুক্তিযোদ্ধা নিজামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের কাছে একটি রেলওয়ে ট্র্যাকে মাইন স্থাপন করে। সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে একটি পাকসেনা ও রাজাকারবাহী ট্রেন সেখান দিয়ে যাবার সময় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে বেশ কিছু হানাদার নিহত হয়।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে রাজাকার ও পাকসৈন্যের একটি বড় দল মহেশপুরে আসবার খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী পুরো গ্রামের চারদিক থেকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। পাকসেনাদের একটি দল শাহবাজপুর রেলস্টেশন ঘাঁটি থেকে তাজপুরের দিকে অগ্রসর হলে তাদের ওপর আক্রমণ চালায় সিলেটের তাজপুরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা দল। এ আক্রমণে ৪ জন রাজাকার ও একজন পাকসৈন্য নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়।
খুলনায় একদল গেরিলা আশাশুনি থানা আক্রমণ করে এবং একদিন দুই রাত থানা অবরোধ করে রাখে। দ্বিতীয়দিন সাতক্ষীরা থেকে একদল পাকিস্তানী সৈন্য ও খুলনা থেকে পাকিস্তানী নৌবাহিনী আআশুনি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা চালায়। গেরিলারা ১২/১৪ ঘন্টা আক্রমণ প্রতিহত করে। এ যুদ্ধে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২জন বন্দি হন পক্ষান্তরে পাকিস্তানী ৩ জন মিলিশিয়া ও ১৬ জন রাজাকার নিহত হয়।
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ অন্তর্গত এলাকা হাসনাবাদে এদিন জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে ১০-১২টি নৌকাযোগে আগত পাকিস্তানী সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। ফলে ৫-৭ মিনিট মুক্তিযোদ্ধারা একতরফা আক্রমণ চালানোর পর পাকিস্তানীরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানীদের দূরবর্তী অবস্থান থেকেও গোলা গোলাবর্ষণ করা হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ অব্যাহত রাখে। মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন যুদ্ধের একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার মিলে ৯-১০ জন নিহত ও অনেকে আহত হয়।
দিনাজপুরে ক্যাপ্টেন দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একদল গেরিলা পাকিস্তানী সৈন্যদের অমরখানা অবস্থানের উপর ঝটিকা আক্রমণ চালায়। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। বেশ ক’জন পাকিস্তানী হতাহত হয়। সিলেটের শাহবাজপুর ষ্টেশনের কাছে তাজপুর গ্রামে একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নিয়ে টহলরত পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের আক্রমণ করে। এতে ৪ জন রাজাকার নিহত ও আরও কয়েজন রাজাকার এবং ১ জন পাকিস্তানী সৈন্য আহত হয়।
কুমিল্লা জেলায় মুক্তিবাহিনী মাইজবার গ্রামে পাকসেনা তল্লাসী অভিযান চালায়। এই অভিযানে ৩৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। অভিযান শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে রাজাকার ও পাকসৈন্য মিলে ১৫০ জনের একটি দল মহেশপুর লুটপাট করতে আসে। খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী পুরো গ্রামের চারদিকে অ্যামবুশ করে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকী সৈন্যরা পালিয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনী সিলেটের জগন্নাথপুর থানার দিরাই ও শাল্লা এলাকা শত্রুমুক্ত করে সেখানে বেসামরিক প্রশাসন চালু করে। সালেহ চৌধুরী ঐ এলাকার আঞ্চলিক অধিনায়ক নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ফলে পাকিস্তান সরকারের আবেদনে যে কমিশনের সদস্যপদ থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য মনোনীত হন।
জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশ মহাসচিব উ’ থান্টের সাথে সাক্ষাৎ করে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের মার্কিন সাহায্য সমন্বয়ের জন্য ‘মার্কিন টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোন্স বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে শাস্তি দেয়া হলে পাকিস্তানের সব ধরনের মার্কিন সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে প্রচার অভিযান শুরু করেন।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযম বলেন, শ্লোগান আওড়িয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলা করা যাবে না। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করুন। রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিন।