৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২১ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে

এদিন ইরাকে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এ এফ এম আবুল ফতেহ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পদত্যাগ করেন।

এ এফ এম আবুল ফতেহ ছিলেন পদত্যাগকারী সর্বজ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি কূটনীতিবিদ। ১৯৭১ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে তাকে ইরাকের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর আগে তিনি প্যারিস, ওয়াশিংটন, প্রাগ, দিল্লি ও কলকাতায় কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাকিস্তান দূতাবাসের চ্যান্সেলর এবং পরে উপ রাষ্ট্রদূত। ইরাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি দুই বছর কলকাতায় উপ রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এফ এম আবুল ফতেহ এরপর লন্ডনে ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দূত আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের কাছে তারবার্তায় এই সংবাদ পাঠান।

ঢাকায় এদিন

২১ আগস্ট মধ্যরাতে এম এ আজিজের নেতৃত্বে গেরিলা আব্দুল্লাহ, মেহমুদ, মান্নান, দুলাল, ইন্ডিয়ান ফারুক, খালেদ গ্রীন রোডের মাঝামাঝি অংশে একতলা বিল্ডিং-এর ছাদের অবস্থান থেকে পূর্বে রাস্তায় বিছিয়ে রাখা মাইন, গ্রেনেড ও গুলি করে পাকিস্তানি হানাদারদের দুটি ট্রাক ও একটি জিপ ধ্বংস করে। পরদিন বিবিসি রেডিওর সংবাদে বলা হয় গেরিলাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর ২ জন কর্নেল, ২ জন মেজর, একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৩ জন নিহত ও ৪২ জন আহত হয়। অপারেশেন শেষে গেরিলারা নির্বিঘ্নে তাদের গোপন আস্তানায় ফিরে যায়।

২১ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার বন্ধের জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব উ' থান্টের বিবৃতিকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিষদ সমালোচনা করে বলে 'জাতিসংঘ মহাসচিব এ ব্যাপারে ক্ষমতা বহির্ভূত হস্তক্ষেপ করেছেন। পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার অনুষ্ঠান পাকিস্তান সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।'

২১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে মওলানা আবদুর রহিম জানান, সেনাবাহিনীর তৎপরতা যথেষ্ট নয়। যারা অপতৎপরতায় লিপ্ত হবে তাদের উপর ৬০ ও ৭৮ নং সামরিক বিধিকে আরো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হোক।

২১ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের এক আদেশে পুলিশ নিখিল পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব মাহমুদুল হক ওসমানিকে গ্রেপ্তার করে। এদিন তাকে সামরিক আদালতের মুখোমুখি করা হলে সামরিক আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়।

ভারতে এদিন

২১ আগস্ট দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব জার্মানির সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা ড. আর জিবার বলেন, পূর্ব বাংলার মানুষের দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে এর স্থায়ী সমাধান হয়ে পারে। এখন গণমানুষের দাবি অনুযায়ী সমাধানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়টি আসতে হবে। কারণ তাকে ছাড়া তারা কোনো বৈঠকে বসতে আগ্রহী নয়। আমরা শরণার্থী শিবিরগুলোতে যে ধরনের পৈশাচিক ও নির্মমতার অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো না। তারা যে ধরনের অবস্থার মধ্য দিয়ে এসেছেন তা একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কেউই অনুধাবন করতে পারবেন না।

পাকিস্তানে এদিন

২১ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন আনসার অধ্যাদেশ ১৯৪৮ বাতিল করে 'রাজাকার অধ্যাদেশ ১৯৭১' জারি করে। রাজাকার অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আনসার বাহিনীর এ্যাডজুট্যান্টদের পরিণত করা হয় রাজাকার এ্যাডজুট্যান্টে। ২১ আগস্ট রাজাকার অর্ডিন্যান্সের ব্যাখ্যায় বলা হয়, রাজাকার বাহিনীতে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের পূর্ব পাকিস্তান সরকার ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করবে। ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, অর্ডিন্যান্সের বিধান মতে প্রাদেশিক সরকার সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে সব রাজাকার অথবা নির্দিষ্ট সংখ্যক রাজাকারকে প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনীর অন্তর্ভূক্তির আদেশ দিতে পারবে।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২১ আগস্ট মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী সিনেটর রিপাবলিকান দলের চার্লস পার্সি মার্কিন সিনেটে বলেন, 'পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। আর কোনো অবস্থাতেই দ্বিখন্ডিত পাকিস্তানকে জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। বাঙালী জাতি আজ যে ইস্পাত কঠিন সংকল্প নিয়ে লড়াই করছে তা একটি বিরাট ও মহৎ সংকল্প। শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনে তারা যদি আর এক পা অগ্রসর হয় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। তারা যদি তথাকথিত বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড দেয়, তাহলে পৃথিবীর কেউ-ই তাদের ক্ষমা করবে না।'

২১ আগস্ট কানাডার টরেন্টোতে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম আয়োজিত একটি দক্ষিণ এশীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের ঘোষণায় পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পৃথিবীর সমস্ত দেশকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয় এবং একই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি জানিয়ে বলা হয় 'শেখ মুজিবুর রহমানকে যে ধরনের গোপন বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে তা মানবতাবিরোধী। এর ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।'

সম্মেলনে যোগ দেওয়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মার্কিন বুদ্ধিজীবীরা এদিন এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা দেয়ার তীব্র নিন্দা জানান। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি দাবি জানান। একই সঙ্গে পাকিস্তানকে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বন্ধে আহ্বান জানান। তারা বলেন, 'পাকিস্তানকে অবশ্যই পূর্ব বাংলায় নিপীড়ন ও নির্মমতা বন্ধ করতে হবে। তারা যে ধরনের গণহত্যা পূর্ব বাংলায় চালাচ্ছে তা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। পূর্ব বাংলার এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের জন্য একমাত্র পাকিস্তানই দায়ী। যেখানে প্রতিটি দেশের সামরিক বাহিনী নিজ দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়ার কাজে নিয়োজিত সেখানে তারা নাগরিকদের উপর পৈশাচিকতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি জনপদ এখন শূন্য, সাত মিলিয়ন মানুষ প্রাণ ভয়ে পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে অথচ তাদেরই কিনা দোষারোপ করছে সামরিক প্রশাসন।' একই সঙ্গে তারা ভারতের ভূমিকারও সমালোচনা করেন। তারা বলেন, 'ভারত যে ধরনের আক্রমণাত্মক কথা বলছে তা এই অঞ্চলের উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দেবে।'

এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ব্রিটিশ অধ্যাপক স্যার হিউ কিনলেসাইড। এছাড়া সম্মেলনে সহসভাপতি ছিলেন অধ্যাপক জন কেনেথ গ্যালবেথ। এই সম্মেলনে রেভারেন্ড ই জনসন, এন সি ডাল, জি পাপানেক, জে টি থরসন, জেনারেল জে এন চৌধুরী, প্যাট্রিক পি ডরমেট, নায়াল ডরমেট, চেস্টার রনিং, জেমস ব্যারিংটন, হানা পাপানেক, বেরনার্ড ব্র্যান, জন হোমস, অজিত ভট্টাচার্য, নুরুল হোসেন, রেভারেন্ড ইয়ন ই ম্যাকয়, জেনার্ড লেসে, থমাস এ ডাইন, রেভারেন্ড আর্নেস্ট লং, জুডিথ হার্ট, কর্নেলিয়া রোড, স্ট্যানলি উলপার্ট, রবার্ট ড্রফম্যান, হর্নার এ জ্যাক অংশ নিয়েছিলেন। টরেন্টো ডিকলারেশন নামে পরিচিত এই প্রস্তাবে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল।

২১ আগস্ট সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন পূর্ব বাংলায় চলমান গণহত্যা, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের তীব্র উত্তেজনা ও ভারতকে ক্রমাগত পাকিস্তানের হুমকি দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন 'ইয়াহিয়া খানের সরকার আজ পূর্ব বাংলাকে শ্মশান বানিয়েছে এরপরও তারা থামেনি এখন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর দুঃসাহস দেখাচ্ছে। সাবধান! ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো পাকিস্তানের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল হবে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২১ আগস্ট কুমিল্লার উত্তরে গাজীপুর রেলওয়ে সেতুর কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি টহলদার দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় একজন লেফটেন্যান্টসহ ৬ জন হানাদার নিহত হয় এবং অবশিষ্ট হানাদার সেনারা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা এসময় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।

২১ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সরবরাহ ঘাঁটির উপর হামলা চালায়। এসময় ৭০ জন হানাদার সেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি হানাদার অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ঘাঁটি ছেড়ে পালায়।

২১ আগস্ট নরসিংদীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলে পথিমধ্যে গেরিলা দল তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়।

এসময় দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলির পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনারা পিছু হটে।

২১ আগস্ট সুন্দরবনে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে হানাদারদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

 

কুষ্টিয়ায় মুক্তিফৌজদের আক্রমণে ৭০ পাকসেনা নিহত

 

মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর অ্যামবুশ করে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ দখল করে। ফাইল ছবি

মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর অ্যামবুশ করে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ দখল করে। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট দিনটি ছিল শনিবার। এদিন ইরাকে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, এ এফ এম আবুল ফতেহ বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ এফ এম আবুল ফতেহ এদিন পর্যন্ত পদত্যাগকারী সর্বজ্যেষ্ঠ পাকিস্তানী কূটনীতিক। তিনি আট মাস আগে বাগদাদের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন এবং তার আগে প্যারিস, ওয়াশিংটন, প্রাগ, নয়াদিল্লী ও কলকাতায় কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নয়াদিল্লীর চ্যান্সেলর এবং পরে ডেপুটি হাইকমিশনার। তারপরের দু’বছর কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন।

টরেন্টোতে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম আয়োজিত একটি বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। স্যার হিউ কিনলেসাইড এতে সভাপতিত্ব করেন এবং সহ-সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক জন কেনেথ গ্যাল্ব্রেথ। এই সম্মেলনে অংশ নেন রেভারেন্ড ই জনসন, এন সি ডাল, জি পাপানেক, জে টি থরসন, জেনারেল জে এন চৌধুরী, প্যাট্রিক পি ডরমেট, নায়াল ডরমেট, চেষ্টার রনিং, জেমস ব্যারিংটন, হানা পাপানেক, বেরনার্ড ব্র্যান, জন হোমস, অজিত ভট্টাচার্য, নুরুল হোসেন, রেভারেন্ড ইয়ন ই ম্যাকয়, জেনার্ড লেসে, থমাস এ ডাইন, রেভারেন্ড আর্নেষ্ট লং, জুডিথ হার্ট, কর্নেলিয়া রোড, ষ্ট্যানলি উলপার্ট, রবার্ট ড্রফম্যান, হর্নার এ জ্যাক। এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো সুবিখ্যাত ‘টরেন্টো ডিকলারেশন’ হিসেবে পরিচিত।

২১ আগস্ট মধ্যরাতে এম এ আজিজের নেতৃত্বে গেরিলা আব্দুল্লাহ, মেহমুদ, মান্নান, দুলাল, ইন্ডিয়ান ফারুক, খালেদ ৪টি ইন্ডিয়ান স্টেন, ১টি রিপিট ফায়ার এস এল আর, ২টি এস এল আর, ৪টি এন্টি পারসোনাল মাইন ও কয়েকটা গ্রেনেড নিয়ে গ্রীন রোডের মাঝামাঝি অংশে একতলা বিল্ডিং-এর ছাদের অবস্থান থেকে পূর্বে রাস্তায় বিছিয়ে রাখা মাইন বিস্ফোরণ, গ্রেনেড ও গুলি বর্ষণ করে পাকিস্তানী সেনাদের দুটি ট্রাক ও একটি জীপ ধ্বংস করে। পরদিন বিবিসি রেডিওর সংবাদে বলা হয় গেরিলাদের আক্রমণে ২ জন কর্নেল, ২ জন মেজর, ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ২৩ জন নিহত, ৪২ জন আহত হয়। গেরিলারা নির্বিঘ্নে তাদের গোপন আস্তানায় ফিরে যায়।

মুক্তিবাহিনীর একটি টহলদার দল কুমিল্লার উত্তরে গাজীপুর রেলওয়ে সেতুর কাছে পাকবাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। এই আক্রমণে একজন লেফটেন্যান্টসহ ৬ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অবশিষ্ট পাকসেনারা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ দখল করে।

মুক্তিফৌজ এদিন কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গার ২২ কিলোমিটার উত্তরে আলমডাঙ্গায় পাক বাহিনীর সরবরাহ ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে ৭০ জন পাকসেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। মুক্তিফৌজের আক্রমণে বেসামাল হয়ে পাকবাহিনী অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ঘাঁটি ত্যাগ করে। সরবরাহ ঘাঁটিটি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয় বলে খবরটি নিশ্চিত করে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা।

পাকবাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য নরসিংদির কাছে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলে পথিমধ্যে গেরিলা দল তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রায় একঘন্টা গোলাগুলির পর পাকসেনারা পিছু হটে। সুন্দরবনে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধে মুক্তিসেনাদের নেতৃত্ব দেন রাইফেলস-এর ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা।

মার্কিন সিনেটের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য রিপাবলিকান দলের চার্লস পার্সি মন্তব্য করেন, পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। আর কোন অবস্থাতেই দ্বিখন্ডিত পাকিস্তানকে জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। সিনেটর চার্লস পার্সি আরো বলেন, বাঙালি জাতি আজ যে ইস্পাত কঠিন সংকল্প নিয়ে লড়াই করছে তা একটি বিরাট ও মহৎ সংকল্প। তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনে তারা যদি আর এক পা অগ্রসর হয় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। তারা যদি তথাকথিত বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদন্ড দেয়, তাহলে পৃথিবীর কেউ-ই তাদের ক্ষমা করবে না।

পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন আনসার অধ্যাদেশ ১৯৪৮ বাতিল করে ‘রাজাকার অধ্যাদেশ ১৯৭১’ জারি করে। রাজাকার অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৫৮ সালের আনসার এ্যাক্ট বাতিল করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আনসার বাহিনীর এ্যাডজুট্যান্টদের পরিণত করা হয় রাজাকার এ্যাডজুট্যান্টে। ২১ আগষ্ট রাজাকার অর্ডিন্যান্সের ব্যাখ্যায় বলা হয়, রাজাকার বাহিনীতে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের পূর্ব পাকিস্তান সরকার ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করবে। ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, অর্ডিন্যান্সের বিধান মতে প্রাদেশিক সরকার সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে সকল রাজাকার অথবা নির্দিষ্ট সংখ্যক রাজাকারকে প্রাদেশিক পুলিশ বাহিনীর অন্তর্ভূক্তির আদেশ দিতে পারবে।

জাতিসংঘের মহাসচিব উ’ থান্ট আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার বন্ধ রাখার জন্য যে বিবৃতি দেন, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিষদ তার সমালোচনা করে বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব এ ব্যাপারে ক্ষমতা বহির্ভুত হস্তক্ষেপ করেছেন। পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার অনুষ্ঠান পাকিস্তান সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার নেই।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে মওলানা আবদুর রহিম জানান, হানাদার বাহিনীর তৎপরতা যথেষ্ট নয়। তিনি বাঙালীর ওপর ৬০ ও ৭৮ নং সামরিক বিধিকে আরো নির্মমভাবে প্রয়োগের সুপারিশ করেন।

সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সী কোসিগিন পাকিস্তানী ফ্যাসিবাদী সামরিক চক্রের এই ঘৃণ্য দুরভিসন্ধি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের নায়ক পাকিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, সাবধান! ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো পাকিস্তানের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল হবে।