১৯ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ঢাকায় সামরিক আইন প্রশাসক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগের ২৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
তারা হলেন আবদুল মমিন, আবদুল হামিদ, জিল্লুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মৌলভী হুমায়ুন খালিদ, শামসুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আলী আজম, আবদুস সামাদ আজাদ, মোহাম্মদ আবদুর রব, মোস্তফা আলী, এ কে লতিফুর রহমান চৌধুরী মানিক, দেওয়ান ফরিদ গাজী, মোহাম্মদ ইলিয়াস, ফজলুর রহমান, এ কে শামসুজ্জোহা, আবদুল করিম ব্যাপারী, এ ভুঁইয়া, শামসুল হক, কে এম ওবায়দুর রহমান, মোল্লা জালাল উদ্দিন, শামসুদ্দিন মোল্লা, এম এ গফুর, শেখ আবদুল আজিজ, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এ মান্নান হাওলাদার, আবদুর রব সেরানিয়াবাত এবং এনায়েত হোসেন খান।
১৯ আগস্ট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত বিশ্ব জনমত অনুষ্ঠানে বলা হয়, 'পাকিস্তানের সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে প্রহসনের তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক চক্রকে এই বলে হুঁশিয়ার করেছেন যে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশে যা করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে প্রহসনে মেতে যা করতে যাচ্ছে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এর ফলে পাকিস্তানটাই তাসের ঘরের মতো এক মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে। দু' সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানি জাহাজ আল-আহমাদী মার্কিন সমরাস্ত্র বহনের জন্য ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু সেখানে পাকিস্তানি জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং বিক্ষোভকারীরা ছোট ছোট নৌযান দিয়ে পাকিস্তানি জাহাজের সম্মুখে অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে পাকিস্তানি জাহাজটিকে ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে বাল্টিমোরের দিকে অগ্রসর হয়।'
ঢাকায় এদিন
১৯ আগস্ট মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় হাবিব ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সামনে সকাল ১১টার দিকে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা মাহবুব আহমদ শহীদের নেতৃত্বে একটি টয়োটা গাড়ি ১০ পাউন্ড বিস্ফোরকসহ বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় বেশ কিছু গাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়।
ভারতে এদিন
১৯ আগস্ট কলকাতায় বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানো অপারেশন ওমেগার অন্যতম সদস্য ড্যানিয়েল গ্রোটা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের আটক করে যে ধরনের স্বৈরাচারের পরিচয় দিয়েছে তাতে আমরা মর্মাহত। এ মুহূর্তে সাধারণ মানুষের ত্রাণ প্রয়োজন। আমাদের এই যাত্রা সফল না হলেও আমরা অনেকখানি এগিয়ে গেছি। বাংলাদেশে আমাদের আটক করার আগে আমরা দেখেছি সীমান্তের পর থেকে গ্রামের পর গ্রাম কীভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে।'
১৯ আগস্ট লোকসভার সদস্য ও ভারতীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম সুলেমান সাইফ এক বিবৃতিতে বলেন, 'ভারত সরকার যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায় তবে মুসলিম লীগ ও ভারতে বসবাসকারী আমরা ৮ কোটির বেশি মুসলমান দৃঢ়ভাবে সরকারকে সমর্থন করবো। পূর্ব বাংলায় যা হচ্ছে তা পৈশাচিক ও বর্বরতার সীমা বহু আগেই ছাড়িয়ে গেছে।
১৯ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ শান্তি সংসদ আয়োজিত এক সভায় গায়ানার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছেদি জগন বলেন, 'পূর্ব বাংলার মানুষ এখন স্বাধীনতার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। এছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। কোনো দেশের স্বৈরশাসক ও স্বৈরাচারই জনগণের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। যুগের পর যুগ ধরে তাদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা হয়েছে তা ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না।'
পাকিস্তানে এদিন
১৯ আগস্ট পাকিস্তান সরকার এক ঘোষণায় বলে, 'পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত ৯৪ জন সদস্যের সদস্যপদ ব্যক্তিগত পর্যায়ে বহাল থাকবে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৯ আগস্ট ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রবার্ট ম্যাকক্লক্সি বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে বলে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি যে অভিযোগ করেছেন তাতে মার্কিন সরকার তার মতের সঙ্গে একমত নয়।'
১৯ আগস্ট ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন সরকার যে দুটো বোয়িং বিমান পাকিস্তানকে লিজ দিয়েছে সেগুলো পূর্ব পাকিস্তানে সেনা পরিবহনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে বলে যে অভিযোগ সম্প্রতি একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে সে ব্যাপারে পূর্ণ তদন্ত করছে মার্কিন সরকার। এই দুটো বোয়িং বিমান দেয়া হয়েছিল যাত্রী পরিবহনের জন্য। সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের জন্য নয়।'
১৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া কর্তৃপক্ষের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'সম্প্রতি একটি পাকিস্তানি জাহাজ থেকে পালানো ছয় জন বাঙালি নাবিক ফিলাডেলফিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন।'
এরই মধ্যে জাহাজটি বন্দর ছেড়ে করাচির উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার পর তারা রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। তাদের পক্ষে মূলত ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের মুখপাত্র রিচার্ড টেইলার আবেদনটি করেছেন।
১৯ আগস্ট নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হৃষিকেশ শাহ এক বিবৃতিতে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার শুরু ন্যায় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ নীতির বিরোধী এবং বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বাধাস্বরূপ। এর ফলে শরণার্থী সমস্যাটা আরো প্রকট হয়ে উঠবে।' এর আগে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চেয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন করেছিলেন হৃষিকেশ শাহ।
১৯ আগস্ট জাতিসংঘের একটি কূটনৈতিক সূত্র বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনার জন্য ঘোর বিরোধী। জাতিসংঘে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ভিকটর ইসরায়েলিয়ান জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে সোভিয়েত ইউনিয়নের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন সমস্ত সমস্যার উদ্ভব হয়েছে পাকিস্তান থেকেই। পাকিস্তানই মূলত আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করলেই পূর্ব বাংলার দুঃসহ অবস্থার অবসান হবে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
১৯ আগস্ট দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় 'ইরানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান ও আলোচনার জন্য ইসলামাবাদ ও তেহরানে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এই উদ্যোগের পক্ষে নিজেদের সমর্থন ঘোষণা করেছে। আলোচনার জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান মোহাম্মদ খান ইতিমধ্যেই তেহরান এসেছেন।'
১৯ আগস্ট ইন্ডিয়া নিউজ এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাই না। অন্যদিকে তিনি একই সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি চার দফার দাবি তথা অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম ঘোষণা, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ক্ষতিপূরণ এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
১৯ আগস্ট নিউ টাইমস পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে বলা হয় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহান ইয়াহিয়া খানের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের বিষয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারের মুখোমুখি করলে পুরো পাকিস্তানের ভবিষ্যৎই সুতায় ঝুলবে। তার বিচার জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।' চিঠিতে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিষয়টি মানবিক দিক থেকে ভেবে দেখার অনুরোধ করেন।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় কুড়িগ্রামের চিলমারীতে মেজর জামিলের নেতৃত্বে থার্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বাঙ্কারের ভিতরে ঢুকে চার হানাদার সৈন্যকে হত্যা করে। রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠে। এসময় হানাদার বাহিনীর আর্টিলারি হামলার পরেও মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পিছু নেয়। এদিন চিলমারী থেকে পালাতে পারে মাত্র ১ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য।
ভোররাতে ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি বাঙ্কারে, পজিশনে, ডিফেন্স লাইনে। প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটতে গিয়ে প্রায় ৭০০ হানাদার সৈন্য ৭/৮ মাইল দূরে চিলমারী রেলওয়ের স্টেশনের দিকে গেলে পুনরায় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশের শিকার হয়। এসময় বহু হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
১৯ আগস্ট মুক্তিবাহিনী সাঁটুরিয়া থানায় অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর এই অপারেশনে ৪ জন হানাদার সেনা ও ৫ জন পুলিশ নিহত হয়। এসময় ১৪ জন হানাদার সেনাকে আটক করে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়।
এসময় থানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেন।
১৯ আগস্ট ময়মনসিংহ-সিলেট- মৌলভীবাজার সেক্টরে কামালপুরের কাছাকাছি একটি সেতু উড়িয়ে দেয় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাহারারত রাজাকারদের হত্যা করে।
১৯ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি নৌকা শালদা নদী অবস্থান থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনী ছোট নাগাইশের কাছে নৌকাগুলোর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাকবাহিনীর দুটি নৌকা পানিতে ডুবে যায় ও ২০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। পিছনের নৌকাটি দ্রুত পাড়ে ভিড়লে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা দ্রুত পাড়ে উঠে মুক্তিবাহিনীর উপর পাল্টা হামলা চালায়। প্রায় চার ঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধের পর হানাদার সেনারা পিছু হটে।
১৯ আগস্ট কুমিল্লায় বেলা ১টার সময় মুক্তিবাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে হানাদার বাহিনীর শালদা নদী গুদামের একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। এসময় বাঙ্কারে থাকা ৮ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
১৯ আগস্ট খুলনার পাইকগাছায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চকে অ্যামবুশ করে। এ সময় লঞ্চে থাকা ২৬ হানাদার সেনা নিহত হয়।
শালদা নদীতে পাকসেনাদের তিনটি নৌকা মুক্তিরা ডুবিয়ে দেয়
পাকসেনাদের নৌকায় আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনী। ফাইল ছবি
১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন সন্ধ্যার আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে কুড়িগ্রামের চিলমারীর হানাদার পজিশনে ইস্ট বেঙ্গল ও মুক্তিবাহিনী থার্ড বেঙ্গল মেজর জামিলের নেতৃত্বে বীরদর্প আক্রমণে হানাদার বাঙ্কার দখল করে নেয়। বাঙ্কারেই হত্যা করা হয় ৪ হানাদারকে। রাতের আঁধারে যুদ্ধ আরও রক্তক্ষয়ী ও হিংস্র হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানী শক্তিশালী আর্টিলারির কাভার থাকা সত্ত্বেও চিলমারী থেকে পালাতে চায় ১ ব্যাটালিয়ন হানাদার। একদল মুক্তিযোদ্ধা সন্তর্পণে ক্ষিপ্র গতিতে গিয়ে পজিশন নেয় হানাদারদের পেছনে। ভোররাতে ইস্ট বেঙ্গলের যোদ্ধারা দ্রুত ঢুকে পড়ে পাকিস্তানী বাঙ্কারে, পজিশনে, ডিফেন্স লাইনে। ইস্ট বেঙ্গলের নির্ভীক যোদ্ধাদের নিশ্চিত লক্ষ্যভেদী আঘাতে ভেঙে পড়ে হানাদারদের বাঙ্কার, পাকিস্তানী ডিফেন্স। প্রাণভয়ে চিলমারী ডিফেন্স ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে প্রায় ৭০০ পাকসেনা কিন্তু ৭/৮ মাইল দূরে চিলমারী রেলওয়ের ষ্টেশনে বাধা পায় মুক্তিযোদ্ধাদের, পালাবার পথে প্রাণ যায় অসংখ্য হানাদারের।
ঢাকায় মুক্তিবাহিনী সাঁটুরিয়া থানা আক্রমণ করে। এ অভিযানে ৪ জন পাকসেনা ও ৫জন পুলিশ নিহত হয় এবং ১৪ জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়। থানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে। মুক্তিবাহিনী ময়মনসিংহ-সিলেট- মৌলভীবাজার সেক্টরে কামালপুরের কাছাকাছি সড়ক সেতু ধ্বংস করে পাহারারত রাজাকারদের হত্যা করে।
দুপুর ১২ টায় পাকবাহিনীর তিনটি নৌকা শালদা নদী অবস্থান থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনী ছোট নাগাইশের কাছে নৌকাগুলোর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর দু‘টি নৌকা পানিতে ডুবে যায় ও ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। পিছনের নৌকাটি দ্রুত পারে ভিড়িয়ে পাকসেনারা নৌকা থেকে নেমে পড়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। প্রায় চারঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর পাকসেনারা পিছু হটে।
বেলা ১টার সময় মুক্তিবাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে পাকবাহিনীর শালদা নদী গুদামে অবস্থিত একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় ও ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। খুলনার পাইকগাছায় মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চকে অ্যামবুশ করে। এতে লঞ্চে অবস্থানকারী ২৬ জন পাকসেনার সকলেই নিহত হয় এবং লঞ্চটি বিধ্বস্ত হয়।
ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় হাবিব ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সামনে এদিন সকাল ১১টার দিকে গেরিলারা মাহবুব আহমদ শহীদের নেতৃত্বে একটি টয়োটা গাড়ি ১০ পাউন্ড বিস্ফোরকসহ বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে বেশ কিছু গাড়ী ধ্বংস হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে: পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত ৯৪ জন সদস্যের সদস্যপদ ব্যক্তিগত পর্যায়ে বহাল থাকবে।
ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র রবার্ট ম্যাকক্লক্সি বলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে বলে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী যে অভিযোগ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার সঙ্গে একমত নন।
ঢাকায় সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগের ২৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সামরিক আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। সদস্যরা হচ্ছেন: আবদুল মমিন, আবদুল হামিদ, জিল্লুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মৌলবী হুমায়ুন খালিদ, শামসুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আলী আজম, আবদুস সামাদ আজাদ, মোহাম্মদ আবদুর রব, মোস্তফা আলী, এ কে লতিফুর রহমান চৌধুরী মানিক, দেওয়ান ফরিদ গাজী, মোহাম্মদ ইলিয়াস, ফজলুর রহমান, এ কে শামসুজ্জোহা, আবদুল করিম ব্যাপারী, এ ভুঁইয়া, শামসুল হক, কে এম ওবায়দুর রহমান, মোল্লা জালাল উদ্দিন, শামসুদ্দিন মোল্লা, এম এ গফুর, শেখ আবদুল আজিজ, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এ মান্নান হাওলাদার, আবদুর রব সেরানিয়াবাত এবং এনায়েত হোসেন খান।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে বলা হয়, পাকিস্তানের সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে প্রহসনের তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে এই বলে হুঁশিয়ার করেছেন যে, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশে যা করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে প্রহসনে মেতে যা করতে যাচ্ছে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এর ফলে পাকিস্তানটাই তাসের ঘরের মতো এক মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে।
সাম্প্রতিক সময়ের উল্লেখ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বলা হয়, দু’ সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানী জাহাজ আল-আহমাদী মার্কিন সমরাস্ত্র বহনের জন্য ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু সেখানে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং বিক্ষোভকারীরা ছোট ছোট নৌযান দিয়ে পাকিস্তানী জাহাজের সম্মুখে অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে পাকিস্তানী জাহাজটিকে ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে বাল্টিমোরের দিকে অগ্রসর হয়।