৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৮ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে

 এদিন হংকংয়ে নিযুক্ত পাকিস্তান দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত পাকিস্তানি ট্রেড কমিশনার মহিউদ্দিন আহমেদ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে পদত্যাগ করেন। এদিন এক সংবাদ সম্মেলনে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'কোনো ব্যক্তির পক্ষে আর সম্ভব নয় এমন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা যারা গণহত্যায় জড়িত ও পৈশাচিকতায় লিপ্ত। আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না যেখানে দেশের হাজার হাজার মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এখনই সময় আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর।'
দেশব্যাপী এদিন
১৮ আগস্ট ত্রাণ সহায়তায় অংশ নেওয়া অপারেশন ওমেগার সদস্যদের ২৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখার পর যশোর থেকে ভারতে পাঠানো হয়। এসময় তারা যেসব ত্রাণ নিয়ে এসেছিলেন সেগুলোও তাদের সঙ্গে ফেরত পাঠানো হয়। আগের দিন ১৭ আগস্ট ভারত থেকে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে লন্ডনের পিস নিউজ পত্রিকার সম্পাদক ও সমাজসেবক রজার মুডির নেতৃত্বে ৮ জন ব্রিটিশ নাগরিক ত্রাণ সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন। তারপর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেপ্তার করে সেনা হেফাজতে নেয়া হয়েছিল। 
ভারতে এদিন 
১৮ আগস্ট কলকাতার মুসলিম ইন্সস্টিটিউট হলে আয়োজিত জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন ওলামায়ে হিন্দের সেক্রেটারি জেনারেল ও লোকসভার সদস্য সৈয়দ আসআদ মাদানী। এসময় তিনি বলেন 'পূর্ব বাংলার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভারত সরকার পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষদের জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা পুরো ভারতবাসীর জন্য গর্বের। আমরা পূর্ব বাংলার মানুষের সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করছি।'
১৮ আগস্ট 'ব্লিডিং বাংলাদেশ' শিরোনামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি একটি চিত্র-সংকলন ও ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে বলা হয়, 'এই প্রদর্শনীটি নিপীড়িত বাংলাদেশের গল্প বলার প্রচেষ্টা। প্রতিটি ছবিই বাংলাদেশের দুঃখী নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের মাঝে পাকবাহিনীর রেখে যাওয়া হস্তক্ষেপের চিহ্ন। ছবির পাতাগুলো উন্মোচন করে যে, তারা আসলে খুবই সাধারণ লোক, যাদের একমাত্র দোষ ছিল যে তারা তাদের নিজেদের দেশকে ভালবাসতো। সেনাবাহিনীর তৈরি এই ধ্বংসলীলা থেকে মুক্তভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছাধারীদের কেউই রক্ষা পায়নি-শিশু, নারী, বৃদ্ধ জনতা-সবাই আক্ষরিক অর্থেই নির্যাতিত হয়েছে, তাদের সাধারণ ঘরবাড়ি এবং সকল ধরনের সাধারণ আমানত হয় লুন্ঠিত হয়েছে অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এই ছবিগুলো সেসব কথা বলে এবং এইসব ছবি যেই নৃশংসতাকে উন্মোচিত করেছে তা আমরা আমাদের ক্রুদ্ধ উন্মত্ত মানসিক অবস্থাতেও আদৌ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি কি না তা নিয়ে গুরুতর সন্দেহের উদ্রেক জাগায়। এই ছবিগুলো আসলে নিপীড়িত বাংলাদেশের বিষয়ে প্রকৃত ঘটনার শুধু একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রকাশ মাত্র। সেই দুঃখী দেশটিতে যা কিছু হয়েছে এবং এখনো যা ঘটে চলেছে তার সব কিছুর চিত্রধারণ করা সম্ভব হয়নি, এমনকি যে সব ছবি ধারণ করা হয়েছে এবং সেই দেশ হতে বাইরে তা পাচার করে দেয়া সম্ভব হয়েছে তার সবগুলো সংগ্রহ ও ছাপানো সম্ভব হয়নি।
১৮ আগস্ট সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ডি পি ধরকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ বিষয় তিনি দেখভাল করবেন। 
পাকিস্তানে এদিন 
১৮ আগস্ট করাই থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নিউ ওয়েভ পত্রিকায় কাবুলে আশ্রয় নেয়া পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'এখন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এতোখানি বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে যে পাকিস্তানের ভাঙন আর আটকে রাখার সামর্থ্য কারো নেই। এর জন্য প্রধানত দায়ী পাকিস্তানের সরকার। দীর্ঘদিন তারা জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কী চায় তা বোঝার চেষ্টা না করে তারা তাদের উপর সমস্ত কিছু চাপিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়া এড়াতে পারেন একমাত্র শেখ মুজিব। পাকিস্তানের বিচ্ছেদ আটকানোর সাধ্য শেখ মুজিব বাদে কারো নেই। অথচ তাকেই কিনা বন্দী করে রাখা হয়েছে অবৈধ বিচারের নামে। জনগণের রায় প্রতিফলিত হয় যে তিনি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত।'  
১৮ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের করা একটি মন্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, জাতিসংঘ মহাসচিব এখানে অযাচিতভাবে নাক গলাচ্ছেন। শেখ মুজিবুর রহমান দোষী বলেই তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। এদিন জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী এই প্রতিবাদলিপিটি জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তরে জমা দেন।
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৮ আগস্ট মার্কিন সিনেটের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র অপরাধ হলো তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। তার বিচার আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে ন্যায়বিচারের প্রহসন মাত্র।'
১৮ আগস্ট নরওয়ের অসলোতে প্রবাসী বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও বাংলাদেশে চলমান ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়ে একটি স্মারকলিপি নরওয়ের পররাষ্ট্র দপ্তরে জমা দেন। একই দিন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ট্রিগিভা ব্রাত্তেলি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ন্যায় সঙ্গত ও মানবিক আচরণ করার জন্য নরওয়ের জনগণ আপনাকে অনুরোধ করছে। আমরা আশা করি পাকিস্তান সরকার তার প্রতি মানবিক আচরণ করবে।'
১৮ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত মৈত্রী চুক্তির অনুমোদনের পর কার্যকর করা হয়। চুক্তি কার্যকর অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষে হাজির ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের রাষ্ট্রদূত কে এস শেলভাঙ্গর ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কুজনেতসেভ।
১৮ আগস্ট ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় রেডিও আদ্দিস আবাবা থেকে প্রচারিত এক খবরে বলা হয়, 'রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্যে সারাবিশ্বে প্রচার অভিযান শুরু করবে।'
১৮ আগস্ট সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় লিগ অব রেডক্রস ও রেডক্রস ইন্টারন্যাশনালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন ব্রিটেনে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী। এসময় আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি রেডক্রসকে এই বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
১৮ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি উপ সম্পাদকীয়তে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলস শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, 'পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সামরিক আদালত শেখ মুজিবুর রহমানের যে গোপন বিচার চালাচ্ছে তা আগাগোড়া একটি প্রহসন মাত্র। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এটি চরম ধৃষ্টতা। এ বিচার সকল রীতিনীতি ও আইন-কানুনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। মার্কিন সরকারকে অতীতের সব ভুলত্রুটি সংশোধন করে পাকিস্তানের কাছে সামরিক অস্ত্র ও সমরসম্ভার বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক সাহায্য দান চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। এছাড়া পূর্ব বাংলার অবস্থার উন্নতি আমরা আশা করতে পারি না।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৮ আগস্ট কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে নদীপথে হোমনার দিকে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি নৌকাকে অ্যামবুশ করে মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় গেরিলাদের গুলিতে দুটি নৌকা পানিতে ডুবে যায় এবং এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৯ জন পাকসেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। এ অভিযানে মুক্তিবাহিনী প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেয়।
১৮ আগস্ট মুক্তিবাহিনী সিলেট শহরের কদমতলী ঝালোপাড়ার কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি জিপে অ্যামবুশ করে। এসময় একজন অফিসারসহ ৩ হানাদার সেনা নিহত হয়। অভিযান শেষে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
১৮ আগস্ট নওগাঁর কুলফতেপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও ১২ জন আহত হন।
১৮ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর একটি দল কাংখালি থানায় অভিযান চালিয়ে ৫ জন পাকিস্তানি সেনা এবং কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে। এসময় মুক্তিবাহিনী ৪৫টি রাইফেল জব্দ করে।
১৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। এসময় মুক্তিবাহিনী ৩ জন হানাদার সৈন্য ও ১০ জন রাজাকারকে হত্যা করে। এসময় তারা থানার একটি লঞ্চ, ৩টি বার্জ এবং ১২টি রাইফেল নিজেদের দখলে নেয়।
১৮ আগস্ট সুন্দরবন মুক্তিবাহিনী সব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিনের পরিকল্পনায় শ্যালা নদীতে পাকিস্তানি হানাদারদের বহনকারী একটি গানবোট খুলনা যাওযার পথে আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর রকেট হামলায় গানবোটের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং কয়েকজন হানাদার নিহত হয়।
১৮ আগস্ট রাত ২টায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে একদল নৌবাহিনীর অফিসার পিআইএ এর গাড়ি করে ফেরার পথে গেরিলা সন্দেহে পাহারারত পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা নৌবাহিনীর অফিসারদের গাড়িতে গুলি চালায়। এসময় গুলিতে গাড়ির চালকসহ ৩-৪ জন নৌবাহিনীর অফিসার নিহত হয়। নৌবাহিনীর সৈন্যরা আত্মরক্ষার্থে পাহারারত পদাতিক বাহিনীকে গেরিলা সন্দেহে পাল্টা গুলি চালালে একজন অফিসারসহ সাত পদাতিক সৈন্য নিহত হয়। অপারেশন জ্যাকপট আক্রমণের পর বিমানবন্দর ও বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা আতঙ্কে ভুগতে থাকা হানাদার সৈন্যদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে এবং এর ফলে এই রাতে বিভিন্ন জায়গায় ১৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।

 

কুমিল্লার মুরাদনগরে নৌকা ডুবে ক্যাপ্টেনসহ ২৯ জন পাকসেনা নিহত

 

সফল অভিযান শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।  ফাইল ছবি

সফল অভিযান শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট দিনটি ছিল বুধবার। এদিন পাকসেনাদের তিনটি দল কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে হোমনার দিকে নৌকায় অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল মুরাদনগর থেকে ৮ মাইল দূরে পাকসেনাদের নৌকাগুলোকে অ্যামবুশ করে। গেরিলাদের গুলিতে দু‘টি নৌকা পানিতে ডুবে যায় এবং এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৯ জন পাকসেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। এ অভিযানে মুক্তিবাহিনী প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে।

মুক্তিবাহিনী সিলেট শহরের কদমতলী ঝালোপাড়ার কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি জীপ অ্যামবুশ করে। এতে একজন পাক অফিসারসহ ৩জন পাকসেনা নিহত হয়। সফল অভিযান শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। নওগাঁর কুলফতেপুরে পাকহানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। এতে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন ও ১২ জন আহত হন।

মুক্তিবাহিনী কাংখালি থানায় অভিযান চালিয়ে ৫ জন পাকসেনা এবং কয়েকজন রাজাকার হত্যা ৪৫টি রাইফেল জব্দ করে। মুক্তিবাহিনী কোটালীপাড়া থানা আক্রমণে ৩ জন পাকসৈন্য ও ১০ জন রাজাকার হত্যা করে। তারা একটি লঞ্চ, ৩টি বার্জ এবং ১২টি রাইফেল জব্দ করে। সুন্দরবন মুক্তিবাহিনী সব-সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিনের পরিকল্পনায় শ্যালা নদীতে পাকিস্তানী হানাদার বহনকারী গানবোট খুলনা যাওযার পথে আক্রমণ করা হয়। রকেট হামলায় গানবোটের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং কয়েকজন হানাদার নিহত হয়।

রাত ২টায় পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে একদল নৌবাহিনীর অফিসার পিআইএ এর গাড়ি করে ফেরার পথে গেরিলা সন্দেহে পাহারারত পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা নৌবাহিনীর অফিসারদের গাড়িতে গুলি চালায়। গুলিতে গাড়ির চালকসহ ৩-৪ জন নৌবাহিনীর অফিসার নিহত হয়। নৌবাহিনীর সৈন্যরা আত্মরক্ষার্থে পাহারারত পদাতিক বাহিনীকে গেরিলা সন্দেহে পাল্টা গুলি চালালে একজন অফিসারসহ সাত পদাতিক সৈন্য নিহত হয়। অপারেশন জ্যাকপট আক্রমণের পর বিমানবন্দর ও বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা আতঙ্কে ভুগতে থাকা হানাদার সৈন্যদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে এবং এর ফলে এই রাতে বিভিন্ন জায়গায় ১৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।

হংকংয়ের ভারপ্রাপ্ত পাকিস্তানী ট্রেড কমিশনার মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে পদত্যাগ করেন। মহিউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান সরকারকে পূর্ববঙ্গে নির্মম গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করে বলেন, কোন ব্যক্তির পক্ষে আর সম্ভব নয় এমন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা যারা গণহত্যায় জড়িত। আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারি না যেখানে দেশের হাজার হাজার মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

পাকবাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ-পুরুষ জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভার সদস্য আসআদ মাদানী একাত্তরের এই দিনে কলকাতার মুসলিম ইসস্টিটিউট হলে আয়োজিত জমিয়তের কনভেশন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে রেজুলেশন পাস করেন। (উল্লেখ্য, পাক বাহিনীর গণনির্যাতন বন্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে মাওলানা আসআদ মাদানী অনন্য ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বজনমত গঠনের লক্ষ্যে বিশেষ করে তার নেতৃত্বে কলকাতায় সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল জনমত গঠনের লক্ষ্যে মাওলানা আসআদ মাদানী রাজধানী দিল্লীর বিশাল মহাসমাবেশসহ ভারতজুড়ে প্রায় ৩০০টি সমাবেশ করেন। মাওলানা আসআদ মাদানী পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এলাকায় শরণার্থী শিবিরের ব্যবস্থা করেন এবং জমিয়তের পক্ষ থেকে নিয়মিত রিলিফ বিতরণের ব্যবস্থা করেন।)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলস শেখ মুজিবুর রহমানের তথাকথিত বিচারের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন: পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের যে গোপন বিচার চালাচ্ছে তা আগাগোড়া একটি প্রহসন মাত্র। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার এটা একটা চরম ধৃষ্টতা। এ বিচার সকল রীতিনীতি ও আইন-কানুনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’-এ একটি তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধে চেস্টার বোলস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অতীতের সব ভুলত্রুটি সংশোধন করে পাকিস্তানের কাছে সামরিক অস্ত্র ও সমরসম্ভার বিক্রয় সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করা এবং পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক সাহায্য দান একেবারে বন্ধ করে দেবার আহ্বান জানান।

মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু বিষয়ক কমিটির সভাপতি সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেন, পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র অপরাধ হলো তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। তার বিচার আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে বিচারের ব্যাভিচার ও ন্যায়বিচারের প্রহসন মাত্র।

আদ্দিস আবাবা বেতার থেকে প্রচারিত এক খবরে বলা হয়, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্যে সারাবিশ্বে প্রচার অভিযান শুরু করবে।

‘ব্লিডিং বাংলাদেশ’ শিরোনামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি কর্তৃক সভাপতির বক্তব্যসহ একটি চিত্র-সংকলন প্রকাশ করে বলা হয়, এইটি ছবির মাধ্যমে নিপীড়িত বাংলাদেশের গল্প বলার প্রচেষ্টা। প্রতিটি ছবিই বাংলাদেশের দুঃখী নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের মাঝে পাকবাহিনীর রেখে যাওয়া হস্তক্ষেপের চিহ্ন যা আসল এবং প্রকৃত প্রমাণ। ছবির পাতাগুলো উন্মোচন করে যে, তারা আসলে খুবই সাধারণ লোক, যাদের একমাত্র দোষ ছিল যে তারা তাদের নিজেদের দেশকে ভালবাসতো। আর্মিদের তৈরি এই ধ্বংসলীলা হতে মুক্তভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছাধারীদের কেউই রক্ষা পায়নি-শিশু, নারী, বৃদ্ধ জনতা-সবাই আক্ষরিক অর্থেই নির্যাতিত হয়েছে, তাদের সাধারণ ঘরবাড়ি এবং সকল ধরনের সাধারণ আমানত হয় লুন্ঠিত হয়েছে অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এই ছবিগুলো সেইসব কথা বলে এবং এইসব ছবি যেই নৃশংসতাকে উন্মোচিত করেছে তা আমরা আমাদের ক্রুদ্ধ উন্মত্ত মানসিক অবস্থাতেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি কি না তা নিয়ে গুরুতর সন্দেহের উদ্রেক জাগায়।

এই ছবিগুলো আসলে নিপীড়িত বাংলাদেশের বিষয়ে প্রকৃত ঘটনার শুধু একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রকাশ মাত্র। সেই দুঃখী দেশটিতে যা কিছু হয়েছে এবং এখনো যা ঘটে চলেছে তার সব কিছুর চিত্রধারণ করা সম্ভব হয়নি, এমনকি যে সব ছবি ধারণ করা হয়েছে এবং সেই দেশ হতে বাইরে তা পাচার করে দেয়া সম্ভব হয়েছে তার সবগুলো সংগ্রহ ও ছাপানো সম্ভব হয়নি।