৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৬ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৬ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ঢাকায় পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৪ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে ২২ আগস্ট সকাল ১০টার মধ্যে নাটোরে ২ নম্বর সেক্টরের উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।

জাতীয় পরিষদ সদস্যরা হচ্ছেন, রিয়াজউদ্দিন আহমেদ (রংপুর), মোশাররফ হোসেন চৌধুরী (দিনাজপুর), মতিউর রহমান (রংপুর), মাজহার হোসেন চৌধুরী (রংপুর), মো. আজিজুর রহমান (দিনাজপুর), শাহ মাহতাব আহমেদ (দিনাজপুর), মুজিবুর রহমান (বগুড়া), মোতাহার হোসেন তালুকদার (সিরাজগঞ্জ), আবদুল আউয়াল (রংপুর), আবদুল মোমিন তালুকদার (পাবনা), আবু সাঈদ (পাবনা), এ বি এম মোকসেদ আলী (দিনাজপুর) ও অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী (দিনাজপুর)।

দেশব্যাপী এদিন

১৬ আগস্ট প্রথম প্রহর থেকে ভোর পর্যন্ত চট্টগ্রাম, মংলা সমুদ্রবন্দর ও চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা 'অপারেশন জ্যাকপট' অভিযানে নামেন। এদিন এই অপারেশনে প্রায় ২২টি জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান এবং পাকিস্তানি হানাদারদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ ও খাদ্যসামগ্রী ধ্বংস হয়। অসংখ্য সেনা হতাহত হয়। প্রতিটি অ্যাকশন শেষে নৌ-কমান্ডোরা নিরাপদে তাদের স্থানীয় ঘাঁটিতে ফিরে যান।

ভারতে এদিন

১৬ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে বলেন, 'পূর্ব বাংলার সঙ্কটজনক পরিস্থিতি স্বাধীনতার পর ভারতের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিপুল শরণার্থীর চাপে ভারতের অর্থনীতি সঙ্কটের মুখে।'

১৬ আগস্ট দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, 'গণহত্যা ও পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তান দায়ী। আমি শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়ে একটি জিনিসই বুঝেছি সেটি হলো সবাই এই অপশাসন থেকে মুক্তি চায়। তারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। এখন কেবল পূর্ব বাংলা থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সঙ্গেই আমাদের বৈঠক হতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ও তাকে জড়িয়ে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার যা করছে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ গোপন বিচার জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধ। আমার মনে হচ্ছে নির্বাচনে জয় লাভ করাটাই যেন শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৬ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তান ও চীনকে হুঁশিয়ার করে বলে, 'ভারত-সোভিয়েত শান্তি চুক্তির পুরো তাৎপর্য ভালো করে বুঝে-শুনে ভবিষ্যতে তাদের কাজে হাত দেয়। এদিন সুপ্রিম সোভিয়েত প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর বক্তৃতায় এই হুঁশিয়ারি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চুক্তিবদ্ধ দুই পক্ষের কারও বিরুদ্ধে আক্রমণ বা আক্রমণের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তির অঙ্গীকার সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে আন্দ্রে গ্রোমিকো ঘোষণা করেন, এই চুক্তির কথা না ভেবে এখন থেকে আর কেউই সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ভারত সম্পর্কে কোনো নীতি গ্রহণ করবে না।

১৬ আগস্ট ভারতে আসা বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থী যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন, তার জন্য পূর্ব বাংলা সংকটের একটা রাজনৈতিক ফয়সালা করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘের বৈষম্য নিবারণ ও সংখ্যালঘু রক্ষাসংক্রান্ত সাব-কমিশনকে জরুরি ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায়। সাব-কমিশনের বৈঠকে সোভিয়েত প্রতিনিধি এ আহ্বান জানিয়ে চলেন, মানবাধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘের ঘোষণার সঙ্গে সংগতি রেখে এ ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈঠকে পাকিস্তানি প্রতিনিধি এস খান বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করার জন্য বিভিন্ন সংস্থার সমালোচনা করে বক্তব্য দিলে সোভিয়েত প্রতিনিধি এই বিবৃতি দেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলছে। সুতরাং বিষয়টি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।'

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন

১৬ আগস্ট 'ওয়াশিংটন স্টার' পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের মূঢ় সামরিক চক্র এক প্রচন্ড ভুল করে বসেছে। ইয়াহিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের একথা বোঝা উচিত যে নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা প্রশ্নাতীত।'

১৬ আগস্ট 'ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর' পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। পাকিস্তানের জঙ্গি সামরিক চক্র প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে যদি তার কিছু করে, তাহলে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে যে চিরতরে বিদায় হবে তা নয় বরং মূল পাকিস্তানটাই চূর্ণ হয়ে যাবে।'

১৬ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় 'পাকিস্তানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র, ভুলের মর্মান্তিক কাহিনি' শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোল্জ পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহকে কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তার নিজের ভুল সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সরাসরি শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসানো।'

১৬ আগস্ট যুগোশ্লাভিয়ার প্রভাবশালী দৈনিক 'বেলগ্রেড বোরবা' পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করতে গিয়ে ইয়াহিয়া তার নিজের সমস্যার সমাধানের সকল পথই রুদ্ধ করেছে। এখন অন্ধকারে মাথা কুটে মরা ছাড়া তার আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।'

১৬ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার প্রভাবশালী সংবাদপত্র 'জাকার্তা টাইমস' এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেতা। তার বিচার চালাতে গিয়ে ইয়াহিয়া পাকিস্তানের সর্বস্ব খোয়ানোর ঝুঁকি নিয়েছে। ইয়াহিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ভুল ঘোড়ায় বাজি ধরেছে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৬ আগস্ট বাগেরহাটে ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতেৃত্ব ৫০ জনের একটি দল মঠবাড়িয়া থানা দখলের জন্য শরণখোলা রেঞ্জ অফিসের দিকে রওনা হয়। এসময় শরণখোলা রেঞ্জ অফিসে সুবেদার ফুলুর নেতৃত্বে ১০০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ভোরে ভোলা নদীর দুপারে ১০ জন করে ২০ জন রেখে ক্যাপ্টেন জিয়া সবাইকে সুন্দরবনের ভিতরে যাবার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ফরেস্ট অফিসের উত্তর দিকে ৭টি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গানবোট এসে পড়ে। মোড়েলগঞ্জে হানাদার সেনা এবং রাজাকাররা চরমভাবে মার খাওয়ার পর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গানবোটগুলো পাঠানো হয়েছিল। ৪টি গানবোট শরণখোলা রেঞ্জ অফিস অতিক্রম করে উত্তর দিকে যাওয়ার পর পরবর্তী সময়ে ৩টা গানবোটের ওপর ভোলা নদীর দুই পাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করে। সুবেদার গাফফার রকেট লাঞ্চার থেকে গোলা নিক্ষেপ করলে একটি গানবোট বিধ্বস্ত হয়। গানবোটটি গুলি খেয়ে দক্ষিণ দিকে ৩ মাইল পর্যন্ত গিয়ে ডুবে যায়। হানাদারদের ৪টি লাশ এসময় নদীতে ভাসতে দেখা যায়। বাদবাকি ৬টি গানবোট থেকে হানাদার সৈন্যরা মর্টার, হেভি মেশিনগান, লাইট মেশিনগান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রবলভাবে গোলাবর্ষণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা ওই স্থান ছেড়ে যান।

১৬ আগস্ট নরসিংদীর মনোহরদীতে ৩ নম্বর সেক্টরের হাবিলদার আজমল আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এসময় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা বেশ কয়েকটি মোটর লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। ১৪৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও অসংখ্য আহত হয়।

১৬ আগস্ট কুমিল্লা থেকে তিন মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কংসতলা অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। তুমুল সংঘর্ষে হানাদার সেনারা পর্যুদস্তু হয়ে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই সংঘর্ষে একজন অফিসারসহ ৩০ জন হানাদার সেনা হতাহত হয়। অপারেশন শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

১৬ আগস্ট বগুড়ায় সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সারিয়াকান্দি থানার নিকটবর্তী রামচন্দ্রপুর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলকে ধলাপাড়া ঘাটে আক্রমণ করে। এসময় ৩০ জন হানাদার সেনা নিহত ও বহু আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা হাতেম শহীদ হন এবং কাদের সিদ্দিকী আহত হন।

১৬ আগস্ট সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে জয়কলস সেতুর কাছে নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদারেরা পাল্টা আক্রমণ চালালে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। প্রায় ১২ ঘন্টাব্যাপী এ যুদ্ধে ৯ জন হানাদার সেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নাসহ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

১৬ আগস্ট ফেনীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি শক্তিশালী প্লাটুন নাগাইশের দিকে অগ্রসর হলে সুবেদার নজরুল ও সুবেদার মুনিবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দুটি দল তাদের ওপর আকস্মিক হামলা চালায়। এসময় ২৫ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

 

১৬ আগস্ট ১৯৭১: বিশ্ব গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসের বিস্ময় ‘অপারেশন জ্যাকপট’

নদীবন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোরা ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে অভিহিত আক্রমণ পরিচালনা করে। ফাইল ছবি

নদীবন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোরা ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে অভিহিত আক্রমণ পরিচালনা করে। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দিনটি ছিল সোমবার। এদিন প্রথম প্রহর থেকে ভোর পর্যন্ত চট্টগ্রাম, মংলা সমুদ্রবন্দর ও চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডোরা ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে অভিহিত আক্রমণ পরিচালনা করে। এতে প্রায় ২২টি জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান এবং পাকিস্তানী হানাদারদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ ও খাদ্যসামগ্রী ধ্বংস হয়। অসংখ্য শত্রু সৈন্য হতাহত হয়। প্রতিটি একশন শেষে নৌকমান্ডোরা নিরাপদে তাদের স্থানীয় ডেরায় ফিরে যান।

ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতেৃত্ব ৫০ জনের একটি দল মঠবাড়িয়া থানা দখলের জন্য শরণখোলা রেঞ্জ অফিসের দিকে রওনা হয়। শরণখোলা রেঞ্জ অফিসে সুবেদার ফুলুর নেতৃত্বে ১০০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ভোরে ভোলা নদীর দু’পারে ১০ জন করে ২০ জন রেখে জিয়া সবাইকে সুন্দরবনের ভিতরে যাবার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ফরেস্ট অফিসের উত্তর দিকে ৭টি পাকিস্তানী গানবোট এসে পড়ে। মোরলগঞ্জে পাকসেনা এবং রাজাকাররা চরমভাবে মার খাবার পর প্রতিশোধ নেবার জন্য গানবোটগুলো পাঠানো হয়েছিল। ৪টি গানবোট শরণখোলা রেঞ্জ অফিস অতিক্রম করে উত্তর দিকে যাবার পর পরবর্তী সময়ে ৩ খানা গানবোটের ওপর ভোলা নদীর দুই পাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করে। সুবেদার গাফফার রকেট লাঞ্চার থেকে গোলা নিক্ষেপ করলে একটি গানবোট বিধ্বস্ত হয়। গানবোটটি গুলি খেয়ে দক্ষিণ দিকে ৩ মাইল পর্যন্ত গিয়ে ডুবে যায়। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবীদের ৪টি লাশ নদীতে ভাসতে দেখা যায়। বাদবাকি ৬টি গানবোট থেকে খানসেনারা মর্টার, হেভি মেশিনগান, লাইট মেশিনগান থেকে মুক্তিসেনাদের ওপর প্রবলভাবে গোলাবর্ষণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা ঐ স্থান ত্যাগ করে ত্যারাব্যাকা হাটে একত্রিত হয়।

নরসিংদীর মনোহরদীতে ৩ নম্বর সেক্টরের হাবিলদার আজমল আলীর নেতৃত্বে পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি কটিয়াদী অ্যামবুশ নামে পরিচিত। সেখানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা বেশ কয়েকটি মোটর লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। ১৪৩ জন পাক সৈন্য নিহত ও অসংখ্য আহত হয়। কুমিল্লা থেকে তিন মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের কংসতলা অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। তুমুল সংঘর্ষে কিংকর্তব্যবিমুঢ় পাকসেনারা পর্যুদস্তু হয়ে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই সংঘর্ষে একজন অফিসারসহ ৩০ জন পাকসৈন্য হতাহত হয়। অভিযান শেষে মুক্তিযোদ্ধা দল নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

বগুড়ায় সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সারিয়াকান্দি থানার নিকটবর্তী রামচন্দ্রপুর গ্রামে পাকহানাদারদের একটি দলকে ধলাপাড়া ঘাটে আক্রমণ করে। এতে ৩০ জন পাকসেনা নিহত ও বহু আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা হাতেম শহীদ হন এবং কাদের সিদ্দিকী আহত হন। নিজামউদ্দিন লস্কর ময়নার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে জয়কলস সেতুর কাছে পাকহানাদারদের আক্রমণ করে। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালায়। ১২ ঘন্টাব্যাপী এ যুদ্ধে ৯ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। যুদ্ধে অধিনায়কসহ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ফেনীতে পাকবাহিনীর দু’টি শক্তিশালী প্লাটুন নাগাইশের দিকে অগ্রসর হলে সুবেদার নজরুল ও সুবেদার মুনিবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। এতে ২৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্কটজনিত পরিস্থিতি স্বাধীনতার পর ভারতের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিপুল শরণার্থীর চাপে ভারতের অর্থনীতি সঙ্কটের মুখে। সামরিক শাসক ১৪ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে ২২ আগস্ট সকাল ১০টার মধ্যে নাটোরে ২ নম্বর সেক্টরের উপ-সামরিক আইন প্রশাসকের আদালতে হাজির হবার নির্দেশ দেয়। জাতীয় পরিষদ সদস্যরা হচ্ছেন, রিয়াজউদ্দিন আহমেদ (রংপুর), মোশাররফ হোসেন চৌধুরী (দিনাজপুর), মতিউর রহমান (রংপুর), মাজহার হোসেন চৌধুরী (রংপুর) , মো. আজিজুর রহমান (দিনাজপুর), শাহ মাহতাব আহমেদ (দিনাজপুর), মুজিবুর রহমান (বগুড়া) , মোতাহার হোসেন তালুকদার (সিরাজগঞ্জ), আবদুল আউয়াল (রংপুর), আবদুল মোমিন তালুকদার (পাবনা), আবু সাঈদ (পাবনা), এ বি এম মোকসেদ আলী (দিনাজপুর) ও অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী (দিনাজপুর)।

‘ওয়াশিংটন স্টার’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের মূঢ় সামরিক চক্র এক প্রচন্ড ভুল করে বসেছে। ইয়াহিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের একথা বোঝা উচিত যে নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা প্রশ্নাতীত।

‘ক্রীশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। পাকিস্তানের জঙ্গী সামরিক চক্র প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে যদি তার কিছু করে, তাহলে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে যে চিরতরে বিদায় হবে তা নয় বরং মূল পাকিস্তানটাই চূর্ণ হয়ে যাবে।

যুগোশ্লাভ দৈনিক ‘বেলগ্রেড বোরবা’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করতে গিয়ে ইয়াহিয়া তার নিজের সমস্যার সমাধানের সকল পথই রুদ্ধ করেছে। এখন অন্ধকারে মাথা কুটে মরা ছাড়া তার আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

‘জাকার্তা টাইমস’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেতা। তার বিচার চালাতে গিয়ে ইয়াহিয়া পাকিস্তানের সর্বস্ব খোয়ানোর ঝুঁকি নিয়েছে। ইয়াহিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ভুল ঘোড়ায় বাজি ধরেছে।