১৩ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে
এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু হলে সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। পাকিস্তান সরকারের কোনও অধিকার নেই বঙ্গবন্ধুর বিচার অনুষ্ঠানের। আমরা এ বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।'
ঢাকায় এদিন
১৩ আগস্ট ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একটি জিপকে ডেমরার কাছে অ্যামবুশ করে। অ্যামবুশে জিপটিতে থাকা চার বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা নিহত হন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছে থাকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ নথি ও কয়েকটি রিভলভার নিয়ে নেয়।
১৩ আগস্ট ঢাকা শহর শান্তি কমিটির আহ্বায়ক সিরাজউদ্দিন এক রাজাকার সমাবেশে বলেন, 'দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ এখন রাজাকারে যোগ দিচ্ছে। রাজাকাররা দেশ থেকে দুষ্কৃতিকারীদের উৎখাত করবেই।'
ভারতে এদিন
১৩ আগস্ট মার্কিন সিনেটের শরণার্থী বিষয়ক সাবকমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন শেষে দিল্লিতে পৌঁছান। দিল্লিতে সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেনেডি বলেন, 'পূর্ব বাংলার অবস্থা এখন ভয়াবহ। সেখানে মানবিক বিপর্যয় চলছে। পাকিস্তান সরকার যতই লুকানোর চেষ্টা করুক না কেন, এটি এখন প্রকাশ্য। কীভাবে এই মানবিক বিপর্যয় থেকে পূর্ব বাংলা বেরিয়ে আসতে পারে সে পরিকল্পনার জন্যই আমাদের ভারত সফর। আমাদের ভারত সফরের উদ্দেশ্যই পূর্ব বাংলার মানুষকে এই অসহনীয় অবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।'
এদিন তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও ভি ভি গিরির মধ্যে এই বৈঠকে শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আলোকপাত করা হয়।
১৩ আগস্ট কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে শেখ মুজিবের প্রহসনমূলক বিচার বন্ধ ও মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও লিবারেশন কাউন্সিল এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। এ বিক্ষোভ সমাবেশে কয়েক হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। সমাবেশ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে কলকাতার বড় সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে মার্কিন উপদূতাবাসে স্মারকলিপি জমা দেয়।
পাকিস্তানে এদিন
১৩ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক ভাষণে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা পাকিস্তানকে আরও দৃঢ় করেছে। পাকিস্তান সবসময় এক ও অভিন্ন থাকবে। আমরা আজ এমন সময় আমাদের স্বাধীনতা দিবস অতিক্রম করছি যখন বিদেশি পরাশক্তি ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমাদের উচিৎ দলমত নির্বিশেষে ঐকমত গড়ে তোলা।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৩ আগস্ট কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আপনাদের মানবিক থাকা উচিৎ। এই অঞ্চলে আঞ্চলিক শান্তির জন্যই এটি অতীব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কানাডা আশা করে তিনি শিগগির মুক্তি পাবেন এবং সমঝোতার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরে আসবে।'
১৩ আগস্ট নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে জাতিসংঘ সনদে উল্লিখিত মানবিক বিষয়ের পরিপন্থী মন্তব্য করে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের মামলা সম্পর্কে কোনো আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পাকিস্তান সীমান্তের বাইরে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। কেননা, তার বিচার প্রসঙ্গটি মানবিক উদ্বেগের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।'
১৩ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং। এ সময় দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণার্থী সমস্যা, শরণার্থীদের জন্য ইন্দোনেশিয়ার সহযোগিতা নিয়ে আলোকপাত করেন। এ সময় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সূত্র ধরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, 'ইন্দোনেশিয়া পূর্ব বাংলার বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরবে। ইসলামি দেশগুলোর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার গভীর সম্পর্ক। ভারত আশা করে আপনারা আন্তর্জাতিক মহলে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোকেও পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার অনুরোধ করবেন।' এ সময় ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিক বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে ইন্দোনেশিয়া অবগত এবং এ বিষয়ে ইন্দোনেশিয়া মানবিকতার খাতিরেই চেষ্টা চালিয়ে যাবে।'
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
১৩ আগস্ট প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক 'দ্য টাইমস' পত্রিকায় হাউস অব কমন্সের দুই এমপি ডব্লিউ টি উইলিয়ামস ও পিটার শো'র একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠিতে তারা দুজন বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমান এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া জন প্রতিনিধি এবং স্বাভাবিকভাবে তিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। অথচ এখন শেখ মুজিবুর রহমানকেই বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক কূটচাল বোঝা দায়। তারা যখনই দেখবে তাদের মতের পক্ষে যায়নি, তখন তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে সাব্যস্ত করবে। এর আগে, আইয়ুব খানের শাসনামলেও মিথ্যা মামলা সাজানো হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। তখন জনগণই রুখে দাঁড়িয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচনে পরাজিত করতে না পেরে এখন তার বিরুদ্ধে অবৈধ সামরিক আদালতে গোপন বিচার কেবল বেআইনিই নয় বরং মানবতা বিরুদ্ধও।'
দেশব্যাপী এদিন
১৩ আগস্ট দিনাজপুরে সামরিক কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সমন্বয়ে একটি মিছিল দিনাজপুর শহর প্রদক্ষিণ করে। এ সময় পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ ১৪ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য রাজাকার ও পুলিশের র্যালি ও প্যারেড অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য সব সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দেয়।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৩ আগস্ট নরসিংদীর পলাশের ঘোড়াশালের কাছে ঝিনারদিতে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে এক হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ১৫ হানাদার সেনা গেরিলাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিজেদের দখলে নেয়।
১৩ আগস্ট কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভুরুঙ্গামারী বাজার ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী কবির আহমদ শহীদ হন। এ সময় হানাদার বাহিনীরও ব্যাপক ক্ষতি হয়।
ঘোড়াশালে ১৫ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে
পাকসেনারা গেরিলাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফাইল ছবি
১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট দিনটি ছিল শুক্রবার। এদিন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু হলে সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। পাকিস্তান সরকারের কোনো অধিকার নেই বঙ্গবন্ধুর বিচার অনুষ্ঠানের। তিনি এ ব্যাপারে বিশ্বশক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব উ’থান্ট বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে জাতিসংঘ সনদে উল্লিখিত মানবিক বিষয়ের পরিপন্থী মন্তব্য করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মামলা সম্পর্কে কোনো আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ পাকিস্তান সীমান্তের বাইরে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। কেননা, তার বিচার প্রসঙ্গটি মানবিক উদ্বেগের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী শিবিরসমূহ পরিদর্শন শেষে নয়াদিল্লী পৌঁছান এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।
শেখ মুজিবের প্রহসনমূলক বিচার বন্ধ ও মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও লিবারেশন কাউন্সিল যৌথ প্রচেষ্টায় এদিন বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। কয়েক হাজার মানুষ সে বিক্ষোভে অংশ নেয়। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল কলকাতা শহরের নানা সড়ক প্রদক্ষিণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি পেশ করে।
ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদল পাক বিমানবাহিনীর একটি জীপকে ডেমরার কাছে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে জীপটি ধ্বংস হয় এবং ৪ জন পাক বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান কাগজপত্র, পরিচয়পত্র ও কয়েকটি রিভলবার দখল করে।
মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলাদল ঘোড়াশালের কাছে পাকবাহিনীর ঝিনারদি অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। আড়াই ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে ১ জন পাকসেনা নিহত হয় ও ১৫ জন গেরিলাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র দখল করে।
পাকবাহিনীর ভুরঙ্গামারী বাজার ঘাঁটি আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। এই আক্রমণ অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রচন্ড সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর সিপাহী কবির আহমদ শহিদ হন। ঢাকা শহর শান্তি কমিটির আহ্বায়ক সিরাজউদ্দিন বলেন, “দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ রাজাকারে যোগ দিচ্ছে। রাজাকাররা দেশ থেকে দুষ্কৃতকারীদের উৎখাত করবেই।”
দিনাজপুরের সামরিক কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সমম্বয়ে একটি মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ পরের দিনের রাজাকার ও পুলিশের র্যালী এবং প্যারেড অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য সকল সরকারী কর্মচারীদের নির্দেশ দেয়।