৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৫ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে

 এদিন মার্কিন কংগ্রেসে পাকিস্তানকে সব ধরনের সামরিক সাহায্য বন্ধ সংক্রান্ত বিল পাস করায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হয় এবং একই সঙ্গে কংগ্রেসের প্রতি ধন্যবাদ জানানো হয়।


দেশব্যাপী এদিনঃ

৫ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর রংপুর জেলা সেক্রেটারি মওলানা কাজী নজমুল হুদা সৈয়দপুর, নীলফামারী, ডোমরা, জলঢাকা, পীরগাছা ও গাইবান্ধা সফর করেন। এসময় তিনি বেশ কয়েকটি রাজাকার শিবির পরিদর্শন করেন এবং রাজাকারদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, 'রংপুর জেলায় ৬ হাজারেরও বেশি রাজাকার সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।' 


পাকিস্তানে এদিনঃ
৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান সংকট সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। জাতীয় পরিষদ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের এই বিবরণীতে (শ্বেতপত্র) বলা হয়, 'পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ২৫ দিনের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে সরকারি দপ্তরগুলোতে কর্ম পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং দেশদ্রোহীদের হামলায় বিনষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনীর বিদ্রোহীরা সংগঠিত হয়ে সন্ত্রাসবাদী কায়দায় পাকিস্তানিদের নিধন করেছে। সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের সক্রিয় সাহায্যসহ আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চ ভোর থেকেই সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিল। ইতিমধ্যে তারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি শহরে আক্রমণাত্মক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু ২৬ মার্চ রাতের মধ্যে তাদের সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে।'


আন্তর্জাতিক মহলে এদিনঃ
৫ আগস্ট মার্কিন সিনেটের দুই প্রভাবশালী সিনেটর পাকিস্তানকে সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কড়া সমালোচনা করেন। এদিন ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে বক্তব্য দিয়েছেন তা কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয়। এই অবস্থায় শরণার্থী সমস্যা জিইয়ে রেখে কোটি ডলার ব্যয় সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অর্থহীন। মার্কিন কংগ্রেসে যে প্রস্তাব উঠেছে তা সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত।'
৫ আগস্ট মার্কিন সিনেটের অধিবেশনে সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য ও প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ বলেন, নিক্সন প্রশাসন অযৌক্তিকভাবে ১৮ মিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন। অথচ মার্কিন প্রশাসনের উচিত পাকিস্তানের উপর সম্পূর্ণভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পাকিস্তানকে দেওয়া অস্ত্র সহায়তা ও প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বক্তব্যের প্রতিবাদে হোয়াইট হাউসের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বেশ কয়েকটি সংগঠন।
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেংকু আব্দুল রহমান বাংলাদেশ বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং-এর সাথে বৈঠকে মিলিত হন।
৫ আগস্ট ইরানের তেহরান থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী আরব দৈনিক 'কায়হান ইন্টারন্যাশনাল' এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দৈনিক কায়রানের রাজনৈতিক সম্পাদক আমির তাহেরি বলেন, 'আওয়ামী লীগের সাবেক এক জাতীয় পরিষদ সদস্যের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ এখন প্রচন্ড আকারে চলছে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের আইন-শৃঙ্খলা মোটেও স্বাভাবিক নয়। সেখানে বিদ্রোহীরা সামরিক বাহিনীর উপর গুপ্ত হামলার কারণে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছি।' 
৫ আগস্ট হাউস অব কমন্সের অধিবেশনে প্রভাবশালী ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে একটি বিশেষ বিল উত্থাপন করেন। এসময় তিনি বিলের উপর উত্থাপিত এক বক্তব্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়ে ও পূর্ব পাকিস্তানে চলমান গণহত্যা বন্ধে, উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করার আহ্বান জানান। 
অধিবেশনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এই বিশেষ বিলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, আমরা এই বিষয়ে কোনো বৈঠক পাকিস্তানের সাথে করতে পারি না। কারণ বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ। আর শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের নাগরিক। সুতরাং শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক ও মুক্তির বিষয়টিও পাকিস্তানের নিজস্ব বিষয়। তবে যুক্তরাজ্য তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছে এবং পাকিস্তানকেও পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানকে সমঝোতায় আনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
৫ আগস্ট লন্ডনে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও  অধ্যাপক ড্রেপারকে এদিন লন্ডন থেকে জেনেভায় পৌঁছান। অধ্যাপক ড্রেপারকে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে রেডক্রস ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। রেডক্রস ইন্টারন্যাশনাল বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করেন। একই দিন অধ্যাপক ড্রেপার ও আবু সাঈদ চৌধুরী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আইসিজের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

৫ আগস্ট লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসের হিসাব নিরীক্ষা বিভাগের পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন বাঙালি কূটনীতিবিদ আকবর লুৎফুল মতিন। এদিন তিনি একই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
৫ আগস্ট পূর্ব বাংলার প্রথম গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক চালমার্স বোর্ন এক বক্তব্যে বলেন, 'পাকিস্তানের সংহতির জন্যে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। আমি আরও বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানের শত্রুরা আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে সাধারণ মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে বিদেশি শক্তির কাছে মাথানত করেছিল।


দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধঃ
৫ আগস্ট ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ার রাঙ্গামাটিতে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষে ৩৫ হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং ১৭ জন আহত হয়। 
৫ আগস্ট কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নয়নপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ অপারেশনে বহু হানাদার সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান শেষে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
৫ আগস্ট কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নাটুদহ কোম্পানি সদর দপ্তর আক্রমণ করলে দুপক্ষের তুমুল যুদ্ধ হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা ব্যাপী চলা এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হাসান, আলাউল, ইসলাম খোকন, আবুল কাশেম, রওশন আলম, তারিক, রবিউল, আফাজ উদ্দিন ও কেয়ামুদ্দিন শহীদ হন।
৫ আগস্ট দক্ষিণ কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের উপর বেশ কয়েকটি জায়গায় হামলা করে। বিকেল সাড়ে ৪টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাঙ্গামুরা বাজারের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়, এসময় হানাদার বাহিনীর আরেকটি দল সেই ব্যারিকেডকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য মার্চ করে আসার সময় মুক্তিবাহিনী দুই হানাদার দলের উপর গুলি চালিয়ে ২ হানাদার সেনাকে হত্যা করে। এদিন বিকেলে কোটেশ্বরে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের ৪ সৈন্য নিহত হয়।
৫ আগস্ট নোয়াখালীর সেনবাগে মুক্তিবাহিনী চার রাজাকারকে হত্যা করে। চৌরালার যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে শত্রুপক্ষের তিনটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং দুজন নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিফৌজের এন কে আব্দুস সাত্তার, এন কে মুজাহিদ এবং মোহাম্মাদ আলি আক্কাস শহীদ হন।
৫ আগস্ট সিলেটের দক্ষিণ ভাগে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের কাছে সেজামুরা, ধর্মঘর, চৌরাস্তা ইত্যাদি এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনাদের জড়ো হওয়ার খবর শুনে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর মেশিনগান ও মর্টার নিয়ে হামলা করে। এসময় ৬ হানাদার সেনা নিহত হয়।
৫ আগস্ট সুনামগঞ্জে সুরমা গ্রাম থেকে রসদ নিয়ে আসা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি জিপ ও ৩ টনের ট্রাক আক্রমণ করে উড়িয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার সিদলাইয়ের পশ্চিমে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে ১৫ হানাদার সেনা নিহত হয়।
৫ আগস্ট চট্টগ্রাম সেক্টরের সাতকানিয়া কলেজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ৪০ সৈন্য নিহত হয়। এদিন মুক্তিবাহিনীর একটি দল মেহাব বাজারে ডিনামাইট লাগিয়ে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। একই এলাকায় মুক্তিবাহিনী হানাদারদের একটি ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ৩ হানাদার সৈন্যকে হত্যা করে। এসময় পাঁচ হানাদার সৈন্য আহত হয়।
৫ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সীমান্তবর্তী মহাজনপুর গ্রামে শেল্টার ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। এসময় বাগোয়ান গ্রামের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এসে অভিযোগ করে রাজাকারেরা তাদের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এ খবর পাওয়া মাত্রই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হাসানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা বাগোয়ান গ্রামের মাঠে দক্ষিণ-পশ্চিমে দু'দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় পাকিস্তানি হানাদাররা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আখখেতে অ্যামবুশ করে রাখে। মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁদে পা দিলে হানাদারেরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। আড়াইঘণ্টা ব্যাপী এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা রবিউল, কাশেম, খোকন, কিয়ামুদ্দিন, হাসান, রওশন, আফাজ ও তারিক শহীদ হন। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশগুলো পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী জগন্নাথপুর মাঠে নিয়ে চাপা দেয়।

 

 

কুষ্টিয়ায় দুই বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন

 

দুই পক্ষের সংঘর্ষে বহু পাকসেনা নিহত হয়। ফাইল ছবি

দুই পক্ষের সংঘর্ষে বহু পাকসেনা নিহত হয়। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন ফুলবাড়ীয়া থানার রাঙ্গামাটিতে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষে পাকহানাদারদের একটি গাড়ী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং ৩৫ জন পাকসেনা নিহত ও ১৭ জন আহত হয়। কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনী নয়নপুর পাকহানাদার ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ অভিযানে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান শেষে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর নাটুদহ কোম্পানী সদর দপ্তর আক্রমণ করলে দুপক্ষের তুমুল যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হাসান, আলাউল, ইসলাম খোকন, আবুল কাশেম, রওশন আলম, তারিক, রবিউল, আফাজ উদ্দিন ও কেয়ামুদ্দিন শহিদ হন। মুক্তিবাহিনী দক্ষিণ কুমিল্লায় পাকসেনাদের পর্যুদস্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে ছোটখাট হামলা পরিচালনা করে। বিকেল সাড়ে ৪টায় পাকবাহিনীর একটি দল রাঙ্গামুরা বাজারের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়, আরেকটি দল সেই ব্যারিকেডকে সুরক্ষা করার জন্য মার্চ করে আসবার সময় মুক্তিবাহিনী দুই দলের ওপর গুলি চালিয়ে ২ জনকে হত্যা করে। 

আরেকটি অপারেশনে কোটেশ্বরে মুক্তিফৌজ একটি সম্মুখযুদ্ধে পাক হানাদারদের ৪ জন সৈন্যকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। এদিন সেনবাগে চারজন রাজাকারকে হত্যা করা হয়। চৌরালার যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে শত্রুপক্ষের তিনটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং দু’জন নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিফৌজের এন কে আব্দুস সাত্তার, এন কে মুজাহিদ এবং মোহাম্মাদ আলি আক্কাস শহীদ হন। কুমিল্লার উত্তরে মুক্তিফৌজ শত্রুদের ওপর হামলা অব্যাহত রাখে।

সিলেটের দক্ষিণ ভাগে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের কাছে সেজামুরা, ধর্মঘর, চৌরাস্তা ইত্যাদি এলাকায় পাকসেনারা জড়ো হতে থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা মেশিনগান ও মর্টার নিয়ে তাদের আক্রমণ করে। এতে ৬ পাকসেনা নিহত হয়। সুনামগঞ্জের সুরমা গ্রাম থেকে রেশন নিয়ে আসা পাকবাহিনীর একটি জিপ ও ৩ টনের ট্রাক আক্রমণ করে উড়িয়ে দেয়া হয়। সিদলাইয়ের পশ্চিমে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। কিছু বাঙ্কার ধ্বংস হয়।

মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম সেক্টরের সাতকানিয়া কলেজ এলাকায় পাকবাহিনীর ওপর অভিযান চালালে সেখানে পাকবাহিনীর ৪০ জন হতাহত হয়। মেহাব বাজারের একটি সেতু ধ্বংস করা হয়। একই এলাকায় একটি ক্যাম্পে অভিযান চালায় এবং ৩ জন পাকসেনাকে হত্যা করে এবং পাঁচ জন আহত হয়।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার সীমান্তবর্তী মহাজনপুর গ্রামের শেল্টার ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। বাগোয়ান গ্রামের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এসে রাজাকাররা তাদের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে বলে খবর দেয়। এ খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধা হাসানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা বাগোয়ান গ্রামের মাঠে দক্ষিণ-পশ্চিমে দু’দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হন। পাকিস্তানী হানাদাররা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আখক্ষেতে অ্যামবুশ করে রাখে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই অ্যামবুশে পড়ে যায়। উভয়পক্ষের মধ্যে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এতে পাকবাহিনীর বেশ কিছু সদস্য হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা রবিউল, কাশেম, খোকন, কিয়ামুদ্দিন, হাসান, রওশন, আফাজ ও তারিক শহিদ হন। তাদের মৃতদেহগুলো পাক হানাদারবাহিনী জগন্নাথপুর মাঠে নিয়ে মাটি চাপা দেয়।

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ কর্তৃক পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য প্রদান বন্ধ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাশ করায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেংকু আব্দুল রহমান বাংলাদেশ বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং-এর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।

তেহরান থেকে প্রকাশিত দৈনিক কায়হান ইন্টারন্যাশনাল-এর রাজনৈতিক সংবাদদাতা আমির তাহেরি আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্যের বক্তব্য উল্লেখ করে লেখেন, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ এখন প্রচন্ড আকারে চলছে। লে. জেনারেল টিক্কাখান স্বয়ং তাহেরির সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন যে, পূর্ব বাংলার আইন ও শৃঙ্খলা মোটেই স্বাভাবিক নয়।

পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। শ্বেতপত্রে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ২৫ দিনের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে গুরুতরভাবে বিনষ্ট সরকারী কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারে সামরিক বাহিনীকে আদেশ দেয়া হয়েছিল। আরো বলা হয়, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্টপাকিস্তান রাইফেলস এবং আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনীর বিদ্রোহীরা সংগঠিত হয়ে সন্ত্রাসবাদী কায়দায় পাকিস্তানীদের নিধন করে। সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের সক্রিয় সাহায্যে আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চ ভোরে সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে। ইতিমধ্যে তারা প্রদেশের প্রতিটি শহরে আক্রমণাত্মক তৎপরতা শুরু করে। কিন্তু ২৫-২৬ মার্চ আঘাত হানার নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘন্টা আগেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়।

জামায়াতে ইসলামীর রংপুর জেলা সেক্রেটারী মওলানা কাজী নজমুল হুদা সৈয়দপুর, নীলফামারী, ডোমরা, জলঢাকা, পীরগাছা ও গাইবান্ধা এলাকা সফর করেন। সেখানকার রাজাকারদের কর্মতৎপরতা পরিদর্শন শেষে তিনি জানান, জেলায় ৬ হাজারেরও বেশী রাজাকার সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

পূর্ব বাংলার (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক চালমার্স বোর্ন বলেন, পাকিস্তানের সংহতির জন্যে প্রয়োজন ছিল সামরিক হস্তক্ষেপের। তিনি আরো বলেন, আমি আরও বিশ্বাস করি যে, পাকিস্তানের শত্রুরা আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে সরল প্রাণ লোকদের বিপথে পরিচালিত করে এবং বিদেশী শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়।