৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৩ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে

সারাদেশে তীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। এদিন মার্কিন কংগ্রেসে পাকিস্তান ও গ্রিসকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের মার্কিন সহায়তা বন্ধ জারি করে একটি বিল পাস হয়। লন্ডনে হাউস অব কমন্সে ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের আছে আবেদন জানিয়ে প্রস্তাব পাশ করেন।

ঢাকায় এদিনঃ

৩ আগস্ট ঢাকায় এক দলীয় কর্মী সমাবেশে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এন এম ইউসুফ বলেন, জনসাধারণ বুঝতে পেরেছে, দুষ্কৃতকারীদের ফ্যাসিস্ট তৎপরতাই আমাদের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। আমি আমাদের দলের সব সদস্যকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়ার অনুরোধ করছি।

৩ আগস্ট ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, 'কোনো দেশ সাহায্যের সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিলে তিনি ওই সাহায্য সাহায্যদাতার মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলবেন। ভারতের সমালোচনা করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেন, উদ্বাস্তু সমস্যার মতো মানবিক সমস্যাকে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারত উদ্বাস্তুদের পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনে বাধা দিচ্ছে। তারা খোলাখুলি বলছে, উদ্বাস্তুদের তারা 'ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে' যেতে দেবে না, যেতে দেবে 'মুজিবের বাংলাদেশে।'

তিনি বলেন, ভারত তার ভূখন্ডে ট্রেনিং শিবির খুলেছে। সেখানে ৩৫ হাজার বিদ্রোহীকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে এবং উদ্বাস্তুদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চাপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৭৫ মিনিটব্যাপী সাক্ষাতকারে ক্ষমতা হস্তান্তর, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচন এবং পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বেসামরিক সরকার গঠনের সিদ্ধান্তে তিনি অটল রয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপ্রধান থাকার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। তিনি সেনাবাহিনীতে ফিরে যেতে আগ্রহী। সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্বকারী পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিষদ অনুরোধ করলেই শুধু তিনি প্রেসিডেন্টের কার্যভার চালিয়ে যাবেন। আমার লক্ষ্য দেশকে একত্রিত রাখা আর বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা। তাঁবেদার বেসামরিক সরকার গঠনের জন্য তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে যে গুজব ছড়িয়েছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা পুরোপুরি ভুল।'

ভারতে এদিনঃ

৩ আগস্ট রাজ্যসভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়ে ভারত আন্তর্জাতিক মহলে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছে। ভারত একই সঙ্গে বলেছে বাংলাদেশের শান্তি ফিরিয়ে আনতে এর বিকল্প নেই।'

৩ আগস্ট দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, 'মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুল রহমান আজ রাতে দিল্লি আসবেন। তিনি বাংলাদেশে চলমান শরণার্থী সমস্যা ও শরণার্থীদের বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন।' বর্তমানে টুংকু আবদুল রহমান ওআইসির মহাসচিব হিসেবে কর্মরত থাকলেও ভারত ওআইসির প্রতিনিধি দলকে ভারত সফরে নিষেধ করায় টুংকু আবদুল রহমান আসবেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।

এদিন ত্রিপুরাতে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় ত্রিপুরার ছাত্ররা।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিনঃ

৩ আগস্ট ঢাকায় জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৫৬ জনের একটি আন্তর্জাতিক বেসামরিক প্রতিনিধি দল মোতায়েনের বিষয়ে পাকিস্তান ও জাতিসংঘের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সই হয়। ভারত পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন সংক্রান্ত জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

৩ আগস্ট লন্ডনে হাউস অব কমন্সে ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস ব্রিটিশ পররাষ্টমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলেন। এদিন হাউস অব কমন্সে ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের আছে আবেদন জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেন। এই আবেদনে তারা বলেন, 'যদি প্রকৃত অর্থেই ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের বিষয়ে রাজনৈতিক সমাধান চান তবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া উচিত। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তির মাধ্যমেই রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব।'

৩ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বেশ কয়েকটি সাহায্যকারী দেশ ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠিয়েছে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল পূর্ব পাকিস্তান সফর করবেন। একই সঙ্গে তারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এই সফরের ব্যাপারে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধঃ

৩ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস বানচালের প্রতিজ্ঞা নিয়ে এই দিন ভারত থেকে মুক্তিবাহিনীর একটি বড় দল চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। এদের প্রতি সাতজনে একটি গ্রুপ করে মোট ৩৬টি গ্রুপ তৈরি করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপে একজন কমান্ডার ছিল। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে তিনটি চ্যানেল খোলা হয় এবং কয়েকজন গাইড নিযুক্ত করা হয়। ফটিকছড়ির দায়িত্ব দেয়া হয় জহুরুল হককে এবং মিরসরাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় নূর মোহাম্মদকে। প্রত্যেক গ্রুপকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয় এবং সব গ্রুপের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় সার্জেন্ট এ এইচ এম মাহি আলম চৌধুরীকে। মেজর রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এনাম, ফ্লাইট লেফটেনেন্ট সুলতান, হান্নান, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, রফি, সাবের, আজগরী, জালালউদ্দিন নেতৃবর্গের উপস্থিতিতে সবাইকে শপথ পাঠ করানো হয়।

৩ আগস্ট মৌলভীবাজারের শাহবাজপুর রেল স্টেশন এবং গুদামের ওপর ২৪ রাউন্ড মর্টারের গোলাবর্ষণ করে মুক্তিবাহিনী। এদিন আরেকটি গেরিলা দলকে বিয়ানীবাজারে পাঠানো হয়। কিন্তু পথে রাজাকারের গুলির মুখোমুখি হয় তারা।

৩ আগস্ট মৌলভীবাজারের বড়লেখা সড়কে মুক্তিবাহিনীর ১৬টি এ্যান্টিপার্সোনাল মাইন বসায়।

৩ আগস্ট ৭ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃতে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তাহেরপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় হানাদার বাহিনীর অনেক ক্ষতি হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

৩ আগস্ট মুক্তিবাহিনী ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মানিকগঞ্জ ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় দুইপক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গোলা বিনিময় হয়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার সেনারা মানিকগঞ্জ ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ ঘাঁটি দখল করে এবং প্রায় ১৫০ মাইনসহ বহু গোলাবারুদ উদ্ধার করে।

৩ আগস্ট শেরপুরের ঝিনাইগাতির নকশীতে ক্যাপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নকশী বিওপি আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় এবং অনেক সৈন্য হতাহত হয়। বিজয়ের মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝিতে যোদ্ধারা শত্রু শিবিরের ৫শ গজের মধ্যে চলে যায়। এ সময় পেছন থেকে কভার দেয়া নিজেদের মর্টার শেলে বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

৩ আগস্ট ফরিদপুরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা বিকাল ৪টার সময় মাদারীপুরের ভাঙ্গা এবং মুহাফিজ সেতুগুলোতে পাহারারত হানাদার সেনাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী ডিনামাইট লাগিয়ে কয়েকটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। এসময় মুক্তিবাহিনী ৭টি রাইফেল উদ্ধার করে।

৩ আগস্ট খাগড়াছড়িতে মিজোদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একটি দলের সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন মিজো নিহত হয় এবং বাকি মিজোরা পালিয়ে যায়।

এদিন রাজবাড়ীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও মিজোদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষে ১৩ জন হানাদার সৈন্য ও ২ জন মিজো মারা যান।

৩ আগস্ট ফটিকছড়ির বিবিরহাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বহরে হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী। এসময় ৭ হানাদার সেনা ও ১৪ রাজাকার নিহত হয়।

৩ আগস্ট চট্টগ্রামের রাউজান কলেজের সামনে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলায় ৫ হানাদার সৈন্য নিহত হয়। এসময় ২টি চাইনিজ স্টেন, ৩টি চাইনিজ রাইফেল, ৫টি বেয়নেট এবং ১ পেটি গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।

এদিন গোমদন্ডী স্টেশনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে রাজাকারদের সংঘর্ষ হয়। এসময় ৪০-৫০ জন রাজাকার নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার ফজলু শহীদ হন। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজন রাজাকারের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।

৩ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও মিয়ার বাজারের সংযোগকারী রাস্তায় দাঁড়ানো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর ৫০০-৬০০ গজ দূর থেকে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ৪ সৈন্য নিহত হয়।

ফেনীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক ও অ্যান্টি পারসোনাল মাইনসহ একদল রাজাকারকে আটক করে।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সুরাইনল এবং মাদলীতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৮ সৈন্যকে হত্যা করে মুক্তিবাহিনী। এই হামলায় ২ হানাদার সৈন্য আহত হয়।

এদিন ফটিকছড়ির পাইন্দং 'কারবালা টিলা' সেনাচৌকির পাশে চারজন পাকিস্তানী হানাদার সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে মারা যায়।

 

এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান

 

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এদিন শাহবাজপুর রেল স্টেশন এবং গুদামের ওপর ২৪ রাউন্ড ২’ মর্টারের গোলাবর্ষণ করে শত্রুকে উত্ত্যক্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের জিটার পার্টি। আরেকটি শত্রু উত্ত্যক্তকারী দল বিয়ানীবাজারে পাঠানো হয়। তারা টার্গেটে পৌঁছানোর আগেই রাজাকাররা তাদের ওপর গুলি করে।

বড়লেখা সড়কে এ্যান্টিপার্সোনাল মাইন বসানোর জন্য একটি দলকে পাঠানো হয়। তারা ১৬টি মাইন স্থাপন করে ফিরে আসে। ৭ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর তাহেরপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে পাকবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা অক্ষত অবস্থায় নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর মানিকগঞ্জ ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে দু’পক্ষে প্রচন্ড গোলা বিনিময় হয়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা মানিকগঞ্জ ঘাঁটি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এ অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ ঘাঁটি দখল করে এবং বহু মাইন ও গোলাবারুদ তাদের হস্তগত হয়।

ক্যাপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রেভো ও ডেল্টা কোম্পানির যোদ্ধারা পাকবাহিনীর নকশী বিওপি আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় এবং অনেক সৈন্য হতাহত হয়। বিজয়ের মুহুর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝিতে যোদ্ধারা শত্রু শিবিরের ৫শ’ গজের মধ্যে চলে যায়। এ সময় পেছন থেকে কভার দেয়া নিজেদের মর্টারশেলে বেশ ক’জন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান। এই দুঃখজনক ঘটনায় মারা যান গ্রামবাসীসহ ২৫ জন।

মুক্তিসেনারা চৌদ্দগ্রাম এবং মিয়ার বাজারের সংযোগকারী রাস্তায় দাঁড়ানো পাকসেনাদের ওপর ৫০০-৬০০ গজ দূর থেকে অতর্কিত হামলা চালায় এবং ৪ জনকে হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী চট্টখোলা-ফেনী রোডে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক এবং অ্যান্টি পারসোনাল মাইনসহ এক রাজাকার দলকে আটক করে, যাদের মাইন পাতার নির্দেশ দিয়ে পাঠানো হয়েছিল।

চৌদ্দগ্রামের সুরাইনল এবং মাদলীতে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। এতে ৮ জন সেনা নিহত এবং ২ জন আহত হয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস বানচালের প্রতিজ্ঞা নিয়ে এই দিন ভারত থেকে মুক্তিফৌজের একটি বড় দল চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। এদের প্রতি সাতজনে একটি গ্রুপ করে মোট ৩৬টি গ্রুপ তৈরি করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপে একজন কমান্ডার ছিল। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে তিনটি চ্যানেল খোলা হয় এবং কয়েকজন গাইড নিযুক্ত করা হয়। ফটিকছড়ির দায়িত্ব দেয়া হয় জহুরুল হককে এবং মিরসরাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় নূর মোহাম্মদকে। প্রত্যেক গ্রুপকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয় এবং সব গ্রুপের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় সার্জেন্ট এ এইচ এম মাহি আলম চৌধুরীকে। মেজর রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এনাম, ফ্লাইট লেফটেনেন্ট সুলতান, হান্নান, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, রফি, সাবের, আজগরী, জালালউদ্দিন প্রমুখ নেতৃবর্গের উপস্থিতিতে সবাইকে শপথ পাঠ করানো হয়। 

প্রথমে খাগড়াছড়িতে মিজোদের সঙ্গে এদের একটি দলের সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন মিজো নিহত হয় এবং বাকি মিজোরা পালিয়ে যায়। রাজবাড়ীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ১৩ জন পাঞ্জাবি ও ২ জন মিজো মারা যায় এবং একটি জিপ ধ্বংস হয়। তৃতীয় সংঘর্ষ হয় ফটিকছড়ির বিবিরহাটে। এ সংঘর্ষে ৭ জন পাঞ্জাবী ও ১৪ জন মুজাহিদ মারা যায়। পাঞ্জাবীরা তখন পিছু হটতে বাধ্য হয়। রাউজান কলেজের সামনে চতুর্থ সংঘর্ষে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২টি চাইনিজ স্টেন, ৩টি চাইনিজ রাইফেল, ৫টি বেয়নেট এবং ১ পেটি গুলি হস্তগত হয়। পঞ্চম সংঘর্ষ হয় গোমদন্ডী স্টেশনে। এই সংঘর্ষে ৪০-৫০ জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার ফজলু নিহত হন। কয়েকজন রাজাকারের বাড়িও পুড়িয়ে দেয়া হয়। সারোয়াতলীতে সপ্তম সংঘর্ষে ৩৫ জন রাজাকার নিহত হয়। ২০টি রাইফেল, একটি এলএমজি, তিন পেটি গুলি উদ্ধার করা হয়।

ফরিদপুরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা তৎপরতা অব্যাহত থাকে। ফলে বিকাল ৪টার সময় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মাদারীপুরের ভাঙ্গা এবং মুহাফিজ সেতুগুলোতে পাহারারত শত্রুসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। সে আক্রমণে তারা সেতুগুলো ধ্বংস করে দেয় ও ৭টি রাইফেল দখল করে।

মিঠাপুরের ডাকঘর এবং ইউসুফপুরের তহসিল অফিস জ্বালিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ফটিকছড়ির পাইন্দং ‘কারবালা টিলা’ সেনাচৌকির পাশে পাহাড়ি ঝোঁপে দু’জন মুক্তিযোদ্ধার হাতে চারজন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। একজন রাখাল বালক (মুক্তিযোদ্ধা) ছেঁড়া গেঞ্জি ও লুঙ্গি পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে পাকিস্তানী সেনাচৌকিতে ঢুকে বলে, ‘বাবা আমাকে বাঁচাও। ওই যে গেরিলা দুষ্কৃতকারী আমাকে মারতে আসছে, আমাকে মেরে ফেলবে’- বলে চিৎকার করতে থাকে। চারজন পাকিস্তানী দ্রুত চৌকি থেকে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে গেরিলাকে ধরতে পাহাড়ী সরু পথের দিকে যায়। এ সময় অপর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থেকে স্টেনগানের ব্রাশফায়ারে পাকিস্তানী সৈন্য ৪ জনকে ঝাঁজরা করে দেয়।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ঢাকায় ১৫৬ জনের একটি আন্তর্জাতিক বেসামরিক প্রতিনিধি দল মোতায়েনের বিষয়ে পাকিস্তান ও জাতিসংঘের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন সংক্রান্ত জাতিসংঘের মহাসচিব উত্থান্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এন এম ইউসুফ ঢাকায় এক দলীয় কর্মী সমাবেশে দলের সদস্যদের প্রতি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জনসাধারণ বুঝতে পেরেছে, দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) ফ্যাসিস্ট তৎপরতাই আমাদের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।

দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, কোনো দেশ সাহায্যের সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিলে তিনি ওই সাহায্য সাহায্যদাতার মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলবেন। ভারতের সমালোচনা করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেন, উদ্বাস্তু সমস্যার মতো মানবিক সমস্যাকে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারত উদ্বাস্তুদের পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনে বাধা দিচ্ছে। তারা খোলাখুলি বলছে, উদ্বাস্তুদের তারা ‘ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে’ যেতে দেবে না, যেতে দেবে ‘মুজিবের বাংলাদেশে।’ তিনি বলেন, ভারত তার ভূখন্ডে ট্রেনিং শিবির খুলেছে। সেখানে ৩৫ হাজার বিদ্রোহীকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে এবং উদ্বাস্তুদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চাপ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। 

ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৭৫ মিনিটব্যাপী সাক্ষাতকারে ক্ষমতা হস্তান্তর, আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচন এবং পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বেসামরিক সরকার গঠনের সিদ্ধান্তে তিনি অটল রয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপ্রধান থাকার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। তিনি সেনাবাহিনীতে ফিরে যেতে আগ্রহী। সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্বকারী পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিষদ অনুরোধ করলেই শুধু তিনি প্রেসিডেন্টের কার্যভার চালিয়ে যাবেন। আমার ম্যান্ডেট স্পষ্ট। তা হচ্ছে দেশকে একত্রিত রাখা আর বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা। 

তাঁবেদার বেসামরিক সরকার গঠনের জন্য তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে যে গুজব ছড়িয়েছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা পুরোপুরি ভুল। সৈনিক হিসেবে তিনি গুজবকে অপরাধ মনে করেন। আমি এরূপ কৌশল অবলম্বন করি না। পিপলস পার্টিকে নিয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, জনাব ভুট্টোর দেশের এক অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। কিন্তু দেশের উভয় অঞ্চলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বেসামরিক সরকার গঠিত হওয়া উচিত। যাই হোক, কয়েক মাসের মধ্যেই বেসামরিক সরকার যখন গঠিত হচ্ছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারে। আমি সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্বকারী পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পরিষদ চাই। কিন্তু তার পূর্বে কোনো ব্যক্তি বা দলের কাছে আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করব না। আওয়ামী লীগের বিজয় এবং নতুন পরিস্থিতিতে উপনির্বাচন সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে কতিপয় প্রশ্ন করা হয়। ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের বিজয়কে ভীতি প্রদর্শন, ত্রাস সৃষ্টি ও অনিয়মের ফল বলে আখ্যায়িত করেন। 

ইয়াহিয়া বলেন, সেই সময় তিনি আওয়ামী লীগের তৎপরতা সম্পর্কে সঠিক খবর পাননি। এখন আমরা বুঝতে পারছি প্রত্যেক আসনে জয়ের জন্য মুজিব কি করেছিল। তার অধিকাংশ লোক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে কারণ আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করতে জনগণ ভীত ছিল।

  •