৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০১ আগষ্ট ১৯৭১ এই দিনে

একাত্তরের ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে প্রখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং বিটলস–শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। কনসার্ট শুরু হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে। এই কনসার্টের জন্য তিনি ‘বাংলাদেশ ধুন’ নামে নতুন একটি সুরবিন্যাস রচনা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে সরোদে যুগলবন্দী করেন ওস্তাদ আলী আকবর খান। তবলায় সংগত দেন ওস্তাদ আল্লা রাখা খান। কমলা চক্রবর্তী তানপুরায় সহযোগিতা করেন। অনুষ্ঠানটির জন্য জর্জ হ্যারিসনও ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি নতুন গান লিখে পরিবেশন করেন।


এ কনসার্টের আরেক আকর্ষণ ছিলেন পরবর্তীকালে নোবেলবিজয়ী সংগীতশিল্পী বব ডিলান। তিনি গেয়েছিলেন ছয়টি গান—তাঁর লেখায় ও সুরে ‘মি. ট্যাম্বুরিনম্যান’ থেকে শুরু করে ৫০ লাইনের বিখ্যাত গান ‘আ হার্ড রেইন ইজ গনা ফল’।
অনুষ্ঠানে লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, ডন প্রেস্টন এবং বিটলসের অন্যতম সদস্য রিঙ্গো স্টারসহ ১৮ জন শিল্পী অংশ নেন।


কনসার্টের সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায় এবং বিপুলসংখ্যক শ্রোতা-দর্শক এতে হাজির হন। টিকিট বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিশু শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এই কনসার্ট আয়োজন করা হয়।


ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ‘স্টপ জেনোসাইড, রিকগনাইজ বাংলাদেশ’ স্লোগান লেখা ব্যানার হাতে ওই সমাবেশে ২০ হাজারের বেশি বাঙালি সমবেত হন। সমাবেশে ব্রিটিশ এমপিদের স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পড়ে শোনানো হয়।


লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এই সমাবেশে এসে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করে বক্তব্য দেন।


ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম দিল্লিতে ভারতীয় যুব ফোরামের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্পর্কে এক আলোচনায় বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক হুমকি ও অন্য ঘোষণায় এটাই বোঝা যায়, বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী সাফল্য লাভ করছে। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন আই কে গুজরাল।


ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর পুনেতে তিলক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম সম্পর্কে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেন, উপযুক্ত সময় ঠিক করার ব্যাপারটি সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।


ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবিতে জনসংঘের উদ্যোগে সত্যাগ্রহ পালিত হয়। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সংসদ ভবন এলাকায় শোভাযাত্রা করায় জনসংঘের প্রায় ৫০০ স্বেচ্ছাসেবীকে পুলিশ সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করে। কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে জনমত গড়ে তোলার জন্য জনসংঘ যে ১২ দিনের কর্মসূচি নিয়েছে, এদিন ছিল তার প্রথম দিন। শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন সাংসদ পীতাম্বর দাস।


আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রের উদ্যোগে কলকাতায় একাডেমি অব ফাইন আর্টস ভবনে অনুষ্ঠিত কবি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী পশ্চিমবঙ্গের ৪৫ জন কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করে যে সম্মানী পান, সবাই তা বাংলাদেশের সাহায্যার্থে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেন।


পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। এক মাসের মধ্যে তাঁরা এ নিয়ে চতুর্থবার বৈঠক করলেন। ভুট্টো এদিন বলেন, অবস্থা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।


পাকিস্তানের সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান আফগানিস্তানের কাবুল থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকেরা দেশটিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। পশুশক্তির মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তিনি আবারও এ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আবেদন জানান।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল শালদা নদীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি নৌকা অ্যামবুশ করে। দুই পক্ষের আধা ঘণ্টাব্যাপী গুলিবিনিময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং একজন আহত হন। কাইয়ুমপুরে মুক্তিবাহিনীর অন্য একটি দলের আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

 

আগস্ট ১, ১৯৭১- দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর কিছু অদেখা ছবি

ছবিঃ জর্জ হ্যারিসন

চ্যারিটি কনসার্টের কথা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। কোন একটা মহৎ কাজের উদ্দেশ্যে কনাসার্টের আয়োজন করা এবং সেখান থেকে উপার্জিত টাকা দিয়ে দুস্থদের সেবা করার এই ব্যাপারটা আজ যেমন এত জনপ্রিয়, আগে তা ছিলো না। এই চ্যারিটি কনসার্টের আইডিয়াটি জনপ্রিয়তা লাভ করে ১৯৭১ সালের জর্জ হ্যারিসনের আয়োজিত সেই কনসার্টের পর হতে, যা তিনি করেছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধপীড়িত মানুষের কল্যাণের জন্য।

বাংলাদেশ তখন ইস্ট পাকিস্তান নামের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। একদল দামাল ছেলে নিজের প্রাণ বাজি রেখে ইস্ট পাকিস্তানকে বাংলাদেশ তৈরির লড়াইয়ে লেগে আছে। দেশের মানুষ অসহায়ভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, পাক সেনার হাতে মারা পরছে। অন্যদিকে প্রায় এক কোটি বাঙালি শরনার্থি, যারা বর্ডার পার হয়ে ভারতে গেছে প্রাণ বাঁচাতে, তারা না খেয়ে মরছে। এই বিশাল পরিমাণে শরনার্থিদের একবেলা খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছে ভারত সরকার। অন্য দেশ থেকে সাহায্য এলেও তা পরিমাণে অত্যন্ত নগণ্য। তখন এগিয়ে আসেন জর্জ হ্যারিসন।

তিনি জড়ো করেন তার অন্যান্য বন্ধুদের। বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রবি শঙ্কর, রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেসটন এমন আরো কয়েকজনকে। তিনি আয়োজন করেন বিশ্বের প্রথম তারকাখচিত চ্যারিটি কনসার্টের। তিনি এর নাম দেন “Concert For Bangladesh”।

ছবিঃ জ়র্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান

জর্জ হ্যারিসনের বয়স তখন সবে আটাশ, বব ডিলানে তিরিশ। তারা বহুদিন এভাবে লাইভ কনসার্টে পারফর্ম করেননি। এমনকি কনসার্টের দিনতো সবাই ভেবেছিলো বব ডিলান স্টেজেই আসবেন না! শেষপর্যন্ত সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে সবার সামনে আসেন বব ডিলান এবং জর্জ হ্যারিসন। নিজেদের মনোমুগ্ধকর গানে মাতিয়ে রাখেন সবাইকে। জর্জ হ্যারিসন গান বাংলাদেশ নিয়ে লেখা তার গান।এরিক ক্ল্যাপটনের “While my guitar gently weeps” ছিলো অসাধারণ। সবাই তাদের সেরাটা উপহার দিয়েছিলেন সেদিন।

ছবিঃ এরিক ক্ল্যাপটন

নিউইয়র্কের বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১ আগস্ট ১৯৭১ সালে আয়োজন করা হয়েছিলো এই কনসার্টের। কনসার্টটি ছিলো দুই বেলা। সকাল এবং সন্ধ্যায়। ১০ হাজার দর্শক টিকেট কেটে দেখতে এসেছিলো এই ঐতিহাসিক চ্যারিটি কনসার্ট। এই কনসার্ট নিয়ে বানানো হয়েছে ডকুমেন্টারি। এই কনসার্টটি আজ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চ্যারিটি কনসার্টগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকে উপার্জিত একটি বিশাল পরিমান অঙ্কের টাকা ব্যয় করা হয়েছিলো যুদ্ধপীড়িত বাঙালির কল্যাণে। যতদিন পৃথিবীর মানচিত্রের বুকে বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে, ততদিন বাঙালি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে তাদের, যারা আয়োজন করেছিলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশের।দেখে নিন সেই কনসার্টের আরো কয়েকটি মূহুর্ত।

স্টেজে পারফর্ম করছেন তারকারা।

সুরের ঝংকার তুলছেন রবি শঙ্কর।

পারফর্ম করছেন রিঙ্গো স্টার।

গিটার হাতে বব ডিলান।

গাইছেন বিলি প্রেসটন।

উত্তাল জনতার একাংশ।

জর্জ হ্যারিসন, যার উদ্যোগেই হয়েছিলো কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।