৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৯ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৯ জুলাই একাধারে ঐতিহাসিক, ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন মুজিবনগর, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ৮টি ডাকটিকিট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে। যার নকশা করেন ভারতীয় বাঙালি শিল্পী বিমান মল্লিক।


ঢাকায় এদিনঃ
২৯ জুলাই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রশাসক ও গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে তার বাসভবনে বৈঠক করেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আজম। বৈঠকে টিক্কা খান গোলাম আজমকে বলেন, 'দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনীকে মোকাবিলায় পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দলে দলে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে এবং দেশের প্রয়োজনে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।' 
অন্যদিকে গোলাম আজম বলেন, 'ভবিষ্যৎ বংশধরদের খাঁটি পাকিস্তানি করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক থেকে অবাঞ্ছিত অংশ বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। জাতীয় আদর্শভিত্তিক নতুন সিলেবাস ভবিষ্যৎ নাগরিকদের খাঁটি মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক হবে।'


ভারতে এদিনঃ 
২৯ জুলাই দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, 'নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সমস্যা উত্থাপন করার কোনো ইচ্ছা বর্তমানে ভারতের নেই। তিনি জানান, বাংলাদেশ সঙ্কট সম্পর্কে বিবেচনা করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের কোনো আনুষ্ঠানিক বা ঘরোয়া বৈঠক আহ্বানের পরামর্শ দেননি।' 
২৯ জুলাই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'মুক্তিফৌজ কমান্ডো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় হিট অ্যান্ড রান কৌশল ব্যবহার তীব্রতর করেছে। কমান্ডো গ্রুপ ২৩ জুলাই সেনানিবাসের ৩টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় এক ডজন পাকসেনাকে হত্যা ও পাকবাহিনীর একটি গাড়ি ধ্বংস করে। একই দিন কমান্ডোরা আরও শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে রংপুর শহরের উপকণ্ঠে আলমনগর উপশহর আক্রমণ করে এবং এক ডজনেরও বেশি পাকবাহিনীর সমর্থককে হত্যা করে। পরদিন নীলফামারী অঞ্চলের কমান্ডারদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সমর্থকরা কিশোরগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের কাছে একটি জায়গায় বৈঠক করছিল। এই স্থানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা ঝটিকা আক্রমণ করে তাদের অনেককে হত্যা করে।' 
২৯ জুলাই কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকা এক প্রতিবেদনে বলে, 'রায়গঞ্জ সংবাদদাতার প্রতিবেদনে বলা হয়, দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, বোদা, তেঁতুলিয়া এবং দেবীগঞ্জ এখন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে। এসব অঞ্চলের সরকারি ও বেসরকারি ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে।' 


পাকিস্তানে এদিনঃ
২৯ জুলাই করাচির প্রেসিডেন্ট ভবনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো। 


আন্তর্জাতিক মহলে এদিনঃ
২৯ জুলাই জাতিসংঘের এক মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতে পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে এখনো মতৈক্য সৃষ্টি হয়নি। এরই মধ্যে ভারত জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দলের বিষয়ে নিজেদের অসম্মতি জানিয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা উ থান্টের চেষ্টার বিরোধিতা বা প্রত্যাখ্যান কোনোটিই করেনি। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদে এই নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা করতে রাজি নয়। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নও এভাবে কোনো সিদ্ধান্ত তৈরি করতে রাজি নয়। গত কয়েকদিন আগে নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সের জাক কোসসিউস্কো মরিসকে এক তারবার্তায় জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট বলেছিলেন, 'পূর্ব বাংলার অবস্থা এখন ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে। শেষমেশ পাকিস্তান ও ভারতের একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ারও তীব্র শঙ্কা রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে 'আগামী মাসে শরণার্থীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ভারত ও পাকিস্তান সফর করবেন মার্কিন সিনেটের শরণার্থী বিচার বিভাগীয় উপ-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি। তার ভারতের ভিসা হয়েছে। এরই মধ্যে তিনি পাকিস্তানের ভিসার জন্য আবেদন করেছেন।
২৯ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে দেখা করেন পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড। এসময় প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিষয়, শরণার্থীদের অবস্থা ও পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন জোসেফ ফারল্যান্ড। 


আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিনঃ
২৯ জুলাই লন্ডন থেকে প্রকাশিত "মর্নিং স্টার" পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে বলা হয় 'সম্প্রতি ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুন নামের একটি গেরিলা দলের সদস্যরা ঢাকায় বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটিতেই তারা হামলা করেছে। হামলার শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খানের বাসভবন ও ঢাকায় দুটি অভিজাত শপিং মলও।'  
২৯ জুলাই প্রকাশিত দ্য সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব বাংলায় চলমান গণহত্যা নিপীড়নের বিরুদ্ধে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে ও মুক্তিযুদ্ধের জনসমর্থনের জন্য আগামী ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে সম্প্রতি জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ নিয়ে করা রেকর্ডটি শোনানো হবে। একই সময়ে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শিরোনামে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। ওই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন নিজে অংশগ্রহণ করবেন। ওই কনসার্টে রিঙ্গো রকস্টার, বব ডিলানেরও অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। এই সমাবেশের আয়োজন করেছে অ্যাকশন বাংলাদেশ। একই সঙ্গে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিরা এদিন সংহতি দিবস পালন করবেন।
২৯ জুলাই প্রভাবশালী মার্কিন সাপ্তাহিক 'নিউজ উইক' পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ্য করে। 'The Bengali's strike back' শিরোনামের সেই সম্পাদকীয়  নিবন্ধে বলা হয়, 'ইয়াহিয়ার জন্যে দুঃখ হয়, কেননা তিনি যা দাবি করেছেন প্রকৃত ঘটনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ অভিযান ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এ অভিযান গোড়া থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। দেখার বিষয় হলো আধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে গঠিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তাদের হাতেই চরম মার খাচ্ছে।' 
একই দিন নিউজ উইক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে নিউজ উইকের সাংবাদিক লোরেন জেনকিন্স বলেন, দুদিন আগে মুক্তিবাহিনীর হাতে দুজন দালালকে গণধোলাই দেয়া হয়েছে। পরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাকে উদ্ধার করলেও সামরিক ক্যাম্পে তার শোচনীয় মৃত্যু হয়েছে।
২৯ জুলাই 'লন্ডন টাইমস' পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মাইকেল হর্নসবি এক প্রতিবেদনে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলাদের অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। ঢাকায় গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকার নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।' 


দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধঃ 
২৯ জুলাই কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনী জানতে পারে, কুমিল্লায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর বেশ কয়েক দফা হামলার পর হানাদার বাহিনী সেখানে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য নৌকায় করে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে জানা যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৭টি নৌকায় ৩০০ সৈন্যের হানাদার সেনা নদীপথে যাচ্ছে। 
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা জাফরগঞ্জে নদীর পাড়ে লুকিয়ে থাকে। হানাদার বাহিনীর সৈন্যসমেত সেই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় ৭টির মধ্যে ৪টি নৌকা মুক্তিবাহিনীর নাগালের মধ্যে এলে মুক্তিবাহিনীর মর্টার, এলএমজি ও এসএমজি দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। এসময় প্রায় চারটি নৌকায় থাকা ১২৫ জন সেনার মধ্যে বেশিরভাগই পানিতে ডুবে, মর্টারের আঘাতে ও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। বাকি তিনটি নৌকা হানাদারদের আর্টিলারির সাহায্য নিয়ে পূর্বের ঘাঁটিতে পালিয়ে যায়। 
২৯ জুলাই কুমিল্লার মন্দভাগে মুক্তিবাহিনী মেশিনগান, মর্টার সহযোগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর প্রায় ৩০ জন সৈন্য নিহত হয়।  
২৯ জুলাই কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট হেলাল মুর্শেদের নেতৃত্বে এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুকুন্দপুর-হরশপুর রেলস্টেশন ঘাঁটিতে হামলা করে। এসময় হানাদার বাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়। আক্রমণের পর মুক্তিবাহিনী নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়। 
২৯ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দির বাতাকান্দিতে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বেতার ব্যবস্থা ও একই সঙ্গে টেলিফোন সেবা অকার্যকর হয়ে পড়ে। 
২৯ জুলাই মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার ঘাটুকিয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি লঞ্চে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ বাঁধে। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ব্যাপী চলা এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৫ সৈন্য নিহত হয় এবং ১০ জন আহত হয়। 
২৯ জুলাই কুমিল্লা শহরে থাকা পাকিস্তানি প্রশাসকদের বেশ কয়েকজন মুক্তিবাহিনীর হামলার ভয়ে কুমিল্লা ছেড়ে চান্দিনায় চলে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা ও তার আশপাশের এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশেই তারা চান্দিনায় আশ্রয় নেয়। 
২৯ জুলাই টাঙ্গাইলের মধুপুরের পথের পাশে রাজাকার, বিহারিদের বহু মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তাদের মরদেহ সংগ্রহ করে কবর দিতে আসেনি।
২৯ জুলাই ময়মনসিংহের পারুলদিয়া বাজারে আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি বাহিনীর চর ও রাজাকারদের উপর অ্যামবুশ করে। এসময় ৩ রাজাকার নিহত হয়। 
২৯ জুলাই সুনামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর আব্দুল হাই, জগৎজ্যোতি দাস ও মুজাহিদ মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর তিনটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাচনা ও জামালগঞ্জ ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী নিজেদের সাচনা ও জামালগঞ্জ ঘাঁটি থেকে দুর্লভপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সিরাজ শহীদ হন। 
২৯ জুলাই সিলেটের মোহাম্মদপুরের তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক কর্মকর্তা, ২ জেসিও, ১ এনসিওসহ প্রায় ৪০ জনের মতো হানাদার সৈন্য নিহত হয়। 
২৯ জুলাই হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় ৯ হানাদার সেনা নিহত হয়। 
২৯ জুলাই সাতক্ষীরা শহর, ভোমরা, দেবহাটা ও কালীগঞ্জ থেকে আসা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট একত্রিত হয়ে রাত ৮টার দিকে  ক্তিবাহিনীর ভোমরা প্রতিরোধ ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। এসময় মুক্তিবাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এসময় মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিবাহিনীর আর্টিলারি একত্রিত হয়ে ভোমরা প্রতিরোধ ঘাঁটি ঘিরে ফেলে ৩ ইঞ্চি মর্টার ও আর্টিলারি দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করে। এসময় অসংখ্য হানাদার সেনা নিহত হয়।

 

 

২৯ জুলাই ১৯৭১: দিনাজপুর জেলার পাঁচটি অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে

 

 
মুক্তিবাহিনীর দখলে দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চল। ফাইল ছবি

মুক্তিবাহিনীর দখলে দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চল। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের আজকের এইদিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৬ জুলাই লন্ডনের হাউস অব কমন্সে বিমান মল্লিকের নকশা করা যে আটটি ডাকটিকিট ও একটি উদ্বোধনী খাম প্রদর্শন করেন তা ২৯ জুলাই প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একযোগে মুজিবনগর, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ লাভ করে।

১১ নম্বর সেক্টরের আফছার ব্যাটালিয়নের কোম্পানী কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল পারুলদীয়া বাজারে পাকবাহিনীর গুপ্তচরদের অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে পাকবাহিনীর ৩ সহযোগী নিহত হয়। কুমিল্লায় লে. হেলাল মুর্শেদের নেতৃত্বে এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর মুকুন্দপুর-হরশপুর রেলস্টেশন ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকসেনাদের বেশ ক্ষতি হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

সুনামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর আব্দুল হাই, জগৎজ্যোতি দাস ও মুজাহিদ মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর তিনটি দল পাকবাহিনীর সাচনা ও জামালগঞ্জ ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাকসেনারা তাদের সাচনা ও জামালগঞ্জ ঘাঁটি পরিত্যাগ করে দুর্লভপুর অভিমুখে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধা সিরাজ সাচনা বাজার যুদ্ধক্ষেত্রে পাকবাহিনীর গুলিতে শহিদ হন।

সিলেটের মোহাম্মদপুরের তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের এক অতর্কিত আক্রমণে ৩৫-৪০ জন সেনা নিহত হয়। একই আক্রমণে একজন অফিসার ২ জন জেসিও ও ১ জন এনসিও নিহত হয়। গেরিলাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে দুরমানগরে একজন রাজাকার নিহত হয়। একই এলাকায় শত্রুর অবস্থানে অতর্কিত হামলা চালানো হয়।

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি অতর্কিত আক্রমণে দুধপাতিল থানার চুনারুঘাটে ৯ জন সেনা নিহত হয়। দাউদকান্দির বাতাকান্দিতে বেতারব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে গেরিলাবাহিনী। কুমিল্লায় বেশ কিছু ঘটনায় বিব্রত হবার পর পাকসেনারা সেখানে তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য নৌকায় করে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করার চেষ্টা করছিল। মুক্তিফৌজের ধারাবাহিক আক্রমণের জবাবে পাকসেনারা তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল। ৩০০ সৈন্যের ৭টি নৌযান জলপথে যাচ্ছিল। কুমিল্লার জাফরগঞ্জে মুক্তিবাহিনী একটি সফল অ্যামবুশ করে তাদের উপরে। ৭টার মধ্যে ৪টা নৌকা মুক্তিবাহিনীর নাগালের মধ্যে এলে তারা মর্টার, এলএমজি ও এসএমজি দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। এতে প্রায় ১২৫ জন সেনা ছিল, প্রায় সবাই ডুবে মারা যায় বা নিহত হয়। কিন্তু বাকি ৩টি নৌকা তাদের আর্টিলারির সাহায্য নিয়ে তাদের পূর্বের স্থানের দিকে পালিয়ে যায়।

প্রায় একই সময়ে কুমিল্লার মন্দভাগে মুক্তিফৌজ মেশিনগান, মর্টার দিয়ে পাকসেনাদের আক্রমণ করে প্রায় ৩০ জনকে হত্যা করে।
সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা ও তার আশপাশের এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনায় পাকসেনাদের মনোবল ধ্বংস হয়ে যায়। তারা ভয়ে কুমিল্লার সরকারী বাসভবন ছেড়ে চান্দিনায় চলে যায়।

মুক্তিবাহিনী ঘাটুকিয়া নদীপথে যাতায়াতকারী পাকসেনাবাহী লঞ্চে আক্রমণ করে। ৪৫ মিনিট চলা বন্দুকযুদ্ধে শত্রুবাহিনীর ৫ জন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। রাত সাড়ে ৮টায় মুক্তিসেনাদের ভোমরা ডিফেন্সে শত্রুরা আক্রমণ করে। সাতক্ষীরা টাউন, শেরপুর, দেবহাটা ও কালিগং থেকে অনেক সৈন্য ভোমরাতে আসে। মুক্তিসেনাদের গেরিলারা ৩ ইঞ্চি মর্টার ও আর্টিলারি দিয়ে তাদের আক্রমণ করে। অসংখ্য পাকসেনা নিহত হয়।

এদিন মধুপুরের পথের পাশে রাজাকার আর তাদের সহযোগীদের প্রচুর লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। শত্রুরা তাদের লাশ সংগ্রহ করে কবর দিতে আসেনি। বিহারিদের লাশ ও রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নয়াদিল্লীতে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সমস্যা উত্থাপন করার কোনো ইচ্ছা বর্তমানে ভারতের নেই। তিনি জানান, বাংলাদেশ সঙ্কট সম্পর্কে বিবেচনা করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব উ‘ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের কোনো আনুষ্ঠানিক বা ঘরোয়া বৈঠক আহ্বানের পরামর্শ দেননি।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীর প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রশাসক ও গভর্নর টিক্কা খান মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলায় পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের প্রতি মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক আমীর গোলাম আজম ভবিষ্যৎ বংশধরদের খাঁটি পাকিস্তানী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক থেকে অবাঞ্ছিত অংশ বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, জাতীয় আদর্শভিত্তিক নতুন সিলেবাস ভবিষ্যৎ নাগরিকদের খাঁটি মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক হবে।

দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়, মুক্তিফৌজ কমান্ডো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল  বিশেষ করে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় হিট এ্যান্ড রান কৌশল ব্যবহার তীব্রতর করেছে। কমান্ডো গ্রুপ ২৩ জুলাই সেনানিবাসের ৩টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় এক ডজন পাকসেনাকে হত্যা ও পাকবাহিনীর একটি গাড়ি ধ্বংস করে। একই দিন কমান্ডোরা আরও শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে রংপুর শহরের উপকণ্ঠে আলমনগর উপশহর আক্রমণ করে এবং এক ডজনেরও বেশি পাকবাহিনীর সমর্থককে হত্যা করে। পরদিন নীলফামারী অঞ্চলের কমান্ডারদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সমর্থকরা কিশোরগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের কাছে একটি জায়গায় বৈঠক করছিল। এই স্থানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা ঝটিকা আক্রমণ করে তাদের অনেককে হত্যা করে।

যুগান্তর পত্রিকার রায়গঞ্জ সংবাদদাতার প্রতিবেদনে বলা হয়, দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, বোদা, তেঁতুলিয়া এবং দেবীগঞ্জ এখন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে। এসব অঞ্চলের সরকারি ও বেসরকারি ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। 

আমেরিকার বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’ পত্রিকার ‘The Bengali’s strike back’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়, ‘ইয়াহিয়ার জন্যে দুঃখ হয়, কেননা তিনি যা দাবী করেছেন প্রকৃত ঘটনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ অভিযান ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এ অভিযান গোড়া থেকেই পরিচালিত হচ্ছে এবং উন্নত সমরসজ্জায় সজ্জিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চরমভাবে ঘায়েল হচ্ছে।’

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল সফরকারী নিউজউইক-এর সংবাদদাতা লোরেন জেনকিন্সের বরাত দিয়ে আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে মুক্তিবাহিনীর হাতে দু‘জন দালালের ‘Red letter’ প্রাপ্তি ও কড়া সামরিক পাহারাধীন অবস্থায় শোচনীয় মৃত্যু হয়েছে।

‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকার সংবাদদাতা মাইকেল হর্নসবি জানান, বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অহরহ মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের সকল শহরে বিশেষ করে ঢাকা শহরে গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ পাকবাহিনী আশপাশের এলাকার বেসামরিক বাসিন্দাদের ওপর উৎপীড়ন করছে।