৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৮ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৮ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান 'ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশ' এ বলা হয়, 'বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার শাসকদের চালানো গণহত্যার ব্যাপারে বিশ্ববাসী এখন জানে। কিন্তু এরা গণহত্যার বিষয়টি এমনভাবে লুকানোর চেষ্টা করেছে, হিটলার বেঁচে থাকলে তার আধুনিক শিষ্যদের কাণ্ড দেখে নিজেই লজ্জা পেতেন। যেখানে গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা পৌনে এক লাখ দেখিয়েছে সেখানে আর কী বা বলার আছে? প্রাণের ভয়ে ৭০ লাখের বেশি শরণার্থীকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে।

এখন সারা বিশ্বের সামনেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এক কলঙ্কের নাম। এরপরও তারা জনগণকে ধোঁকা দিতে এখন বলছে, 'পূর্ব পাকিস্তানে সবকিছু স্বাভাবিক আছে, আপনারা নিজ নিজ আবাসস্থানে ফিরে আসুন। আমরা শরণার্থীদের জন্য অভ্যর্থনাকেন্দ্র খুলেছি।' আদতে পুরোটাই বানোয়াট। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদপত্র 'সানডে টাইমস' এর একজন প্রতিনিধি এ রকম একটি, অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে ঘুরে এসে জানিয়েছেন, পাঁচটি বেওয়ারিশ কুকুর ছাড়া কেন্দ্রটিতে আর কেউ নেই। গত কয়েক সপ্তাহে, ব্রিটেন, কানাডা, আয়ারল্যান্ড থেকে সংসদীয় প্রতিনিধিদল পূর্ব বাংলা সফর করেন। সেখানে আতঙ্কের পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলেই প্রতিনিধিদের মনে হয়েছে। নাৎসীদের কাছ থেকে পাকিস্তানি শাসকেরা গণহত্যার পদ্ধতি ছাড়া আরও অনেক কিছুই শিখেছে বলে দেখা যাচ্ছে। সেন্সরশিপ থাকা সত্ত্বেও যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতেও বোঝা যায়, পূর্ব বাংলায় কোনো ধরনের পুলিশি রাজত্ব কায়েম হয়েছে। পূর্ব বাংলা এখন এক আতঙ্কের উপত্যকা, যেখানে জার্মান গেস্টাপো কায়দায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সরকারি অফিসে এখনও যেসব কর্মকর্তা আসছেন তাদের উদ্দেশ্যে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রশ্নমালা জারি করেছে। যেসব প্রশ্নের উত্তর বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে। সেগুলোর মধ্যে একটি: আপনি কি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন? আরেকটি: আপনি কি বাঙালী? এ কী ধরনের অন্যায়! 
লস এঞ্জেলেস টাইমসের এক প্রতিবেদনে পূর্ব বাংলায় পরিস্থিতির একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, 'ঢাকা এখন এক ভয়ের নগরী। রাতের বেলায় রাস্তায় রাস্তায় ভুতুড়ে শূন্যতা বিরাজ করছে। সন্ধ্যা নামলেই লোকজন বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে, যদি আত্মীয়-স্বজনের বাড়ির দরজা-জানালা-দেয়াল শক্তপোক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তারা সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, 'কোনোমতে শাকসবজি, অথবা একটু মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েই তাড়াতাড়ি তেলের বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়, দরজা আটকে দেয়া হয়। এ রকম একটা ধারণা বিরাজ করছে যে, অন্ধকার বাড়িঘরে কর্তৃপক্ষ আসার সম্ভাবনা কম।' 
প্রতিনিধি আরও বলেন, 'রাতের বেলায় ঘরে ঘরে দরজায় কড়া নেড়ে একই কাজ করা হয়। কোথায় বিদ্রোহীরা রয়েছে সে তথ্য জানা, পিঠ বাঁচাতে ইচ্ছুক লোকদের চর হিসেবে দলে নেয়া, অথবা নারীদের শ্লীলতাহানি করা; অথবা ভয় দেখানোর জন্যই আসা; অথবা মুচলেকা আদায় করা।' তিনি একজন বাঙালি ব্যাংকারকে উল্লেখ করে বলেন, যাকে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সামরিক কর্মকর্তাদের থেকে নিজের ও তার পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। লিখেছেন, 'কখনও কখনও পুরুষদের অস্ত্রের মুখে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আর নারীরা আহাজারি করতে থাকে। কেউ কেউ আহত অবস্থায় ফেরে, কেউ কেউ ফেরে না।' সেনা কর্তৃপক্ষ ও তাদের পোষ্য স্থানীয় মিলিশিয়াদের সহায়তায় গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটিও জনগণকে আতঙ্কিত করার আরেকটি উপায়। 
বিবিসি লন্ডন টাইমসের মার্ক টালি বলেন, স্থানীয় মিলিশিয়ারা মূলত মাস্তান, যারা এ সুযোগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে বেড়াচ্ছে।


ঢাকায় এদিনঃ
২৮ জুলাই জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি জন আর কেলি নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় আসেন।


ভারতে এদিনঃ
২৮ জুলাই রাজ্যসভার অধিবেশনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, 'ভারত এখনই বাংলাদেশের বিষয়ে কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করবে না। কারণ আমরা বিশ্ব রাজনীতি ও সম্ভাব্য সকল পরিণতি নিয়ে ভাববো। তবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আমাদের সহায়তা ও সমর্থন অনড় থাকবে। এরই মধ্যে আমাদের দূতেরা নানা দেশে বাংলাদেশের পক্ষে কার্যত সর্ব প্রকার প্রচারণা চালিয়েছে।
২৮ জুলাই রাজ্যসভার অধিবেশনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা বলেন, 'গত মার্চ মাসের পর থেকে চীনের সেনাবাহিনী ভারতীয় সীমান্তে মহড়া দেয়নি।
২৮ জুলাই ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় সম্প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরও পাঁচ বাঙালি অফিসার কাশ্মীর সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে।


পাকিস্তানে এদিনঃ
২৮ জুলাই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ২ দিন আগে ভারতীয় সীমান্ত থেকে কুমিল্লা শহরে ভারতীয় শেল নিক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
২৮ জুলাই করাচিতে পিপিপি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সভাপতিত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টির এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।


আন্তর্জাতিক মহলে এদিনঃ
২৮ জুলাই লন্ডনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে ধরনের রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে উদগ্রীব হয়ে আছে তা ফিরিয়ে দিতে কেবল পাকিস্তান সরকারই পারে। কিন্তু পাকিস্তান সে ব্যাপারে আন্তরিক বলে মনে হয় না। তারা এখনো পূর্ব পাকিস্তানে সংঘাত চালিয়েই যাচ্ছে। আমরাও তাই এই মুহূর্তে পাকিস্তান সরকারকে কোনো সাহায্য দিতে পারি না। আমাদের পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানোর আগে দেখতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে কিনা। পাকিস্তান যদি সেটি প্রমাণ করতে পারে তবেই পাকিস্তানে আমরা সহায়তা প্রেরণ করতে পারি।'
২৮ জুলাই প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর জেমস উইলিয়াম ফুলব্রাইট সিনেট অধিবেশনে তার বক্তব্যে বলেন, 'উদীয়মান প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারকে ধ্বংস এবং নির্মম সামরিক অভিযানের মুখে- যা প্রধানত হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বাঙালি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে, শত হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তথাপিও আমরা পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সমর্থন করি। আরও সাহায্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ ও বিশ্বের অন্যান্য দাতা দেশগুলোর বিপরীতমুখী মনোভাবের মুখে এই সমর্থন চলমান রয়েছে। তবে, গৃহযুদ্ধে জড়িত একটি সরকারকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে সমর্থন করা অপর পক্ষকে হস্তক্ষেপের শামিল। ভারত কোনোক্রমেই শরণার্থীদের পণ্যদ্রব্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যাপক চাহিদার এই বোঝা বহন করতে পারবে না। এই পরিস্থিতি সহজেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দ্রুততর বিপ্লবী কার্যকলাপকে পুনরায় ত্বরান্বিত করতে পারে যা ভারতের নিজেদের ভবিষ্যতের প্রতি বা আরেকটি ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটনের হুমকি বহন করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিরা উভয়েই একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধানে একমত না হওয়া পর্যন্ত এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ না নেয়া পর্যন্ত অর্থনৈতিক সহায়তা স্থগিত করা উচিত।'
২৮ জুলাই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সকে লেখা এক চিঠিতে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর জর্জ ম্যাকগভার্ন প্রশ্ন তুলে বলেন, 'হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরকে গোপন করার পুরস্কার স্বরূপই কি পাকিস্তান সরকারকে দেড় কোটি ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র সহায়তা দেয়া হচ্ছে?' পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা আমরা জানি। এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে সহায়তা করে পূর্ববঙ্গকে বিপদে ফেলা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। এখন মার্কিন সরকারের উচিত এই অস্ত্র কোথায় ব্যবহার হচ্ছে তার খবর নেওয়া।'


আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিনঃ
২৮ জুলাই প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান এক সম্পাদকীয়তে বলে, 'এখন সম্ভাব্য কয়েকটি উপায়ের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হতে পারে। তার মধ্যে একটি পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দান। আরেকটি, নিরাপত্তা পরিষদে সবার সঙ্গে বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসা। তৃতীয়টি হলো ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশের ব্যবস্থা করা। তাতে করে শরণার্থীদের ফেরা সহজতর যেমন হবে তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের সম্ভবনাও হ্রাস পাবে। জাতিসংঘের উচিত এই বিষয়গুলো ভেবে দেখা।'


দেশব্যাপী এদিনঃ
২৮ জুলাই দিনাজপুরে পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমে এক ঘোষণাতে বলে, 'যারা বাড়ি-ঘর ত্যাগ করেছে, তারা যদি আর একদিনের মধ্যে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে না আসে তবে মালিকানা বাজেয়াপ্ত করা হবে। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রত্যহ রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে। এই সময়ের মধ্যে কাউকে ঘরের বাইরে কিংবা রাস্তায় পাওয়া গেলে গুলি করা হবে।'


দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধঃ
২৮ জুলাই কুমিল্লার বায়রায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বড় দল বিজনা ব্রিজ পরিদর্শনে এলে মুক্তিবাহিনী তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা কায়েম গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ৩ সৈন্য নিহত হয় এবং ৭ জন আহত হয়।
২৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালদা নদী পুলিশ স্টেশনে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর মুক্তিবাহিনী তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় দুই হানাদার সেনা নিহত হয়।
২৮ জুলাই কুমিল্লার শশীদলের হরিমঙ্গলে মুক্তিবাহিনী ডিনামাইট লাগিয়ে ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২০ ফুট প্রস্থের একটি ব্রিজের দুই পাশ উড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে কুমিল্লার আনন্দপুরে হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। এসময় ৩ হানাদার সেনা নিহত হয়।
২৮ জুলাই পঞ্চগড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছোট একটি দলের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনীর সুবেদার হাফিজের কোম্পানীর একটি দল। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা পালিয়ে চাওই নদীর তীরে তাদের মূল ঘাঁটিতে ফিরে যায়। 
২৮ জুলাই কুমিল্লার হোমনার সাঘুটিয়া লঞ্চঘাটে সুবেদার গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি টহলদার লঞ্চের উপর অ্যামবুশ করে। এসময় মুক্তিবাহিনীও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এক ঘণ্টা তীব্র গোলাগুলি হয়। পরে হানাদার সেনারা লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়।
২৮ জুলাই দিনাজপুরে ইছামতী নদীর তীরে অবস্থিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উসকা ঘাঁটিতে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে চারপাশে মাইন পুঁতে নিকটবর্তী ধানখেতে লুকিয়ে পড়ে। এসময় পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা পতাকাটি দেখে এগিয়ে এসে ক্ষিপ্ত হয়ে পতাকাটি নামাতে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরিত হয়ে সব সৈন্য নিহত হয়। পরে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে হানাদার সৈন্যদের সব অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে নিয়ে আসা হয়।
২৮ জুলাই ফেনীর সোনাগাজীর নবাবপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পালানোর সময় হানাদার বাহিনীর কমান্ডার গুল মোহাম্মদ মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

 

দিনাজপুরে প্রতিরাত ১০ টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা

কারফিউর সময় কাউকে ঘরের বাইরে কিংবা রাস্তায় পাওয়া গেলে গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।  ফাইল ছবি

কারফিউর সময় কাউকে ঘরের বাইরে কিংবা রাস্তায় পাওয়া গেলে গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফাইল ছবি

১৯৭১ এর দিনটি ছিল বুধবার। এদিন সোনাগাজী থানার নবাবপুরে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের পর পাক কমান্ডার গুল মোহাম্মদের শিরচ্ছেদ করা হয়। বায়রার দক্ষিণ অংশে বিজনা ব্রিজে মুক্তিবাহিনী শত্রুদের অবস্থানে মর্টার আক্রমণ করে। এতে শত্রুদের ১০ জন সেনা আহত এবং ৩ জন নিহত হয়। সালদা নদী পুলিশ স্টেশনে পাক অবস্থানে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে, এতে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়।

হরিমঙ্গলে ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২০ ফুট প্রস্থের একটি ব্রিজের দুই পাশ উড়িয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী। আনন্দপুরের কাছে শত্রুদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও আক্রমণ করা হয়। এ আক্রমণে ৩ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। কুমিল্লায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল বিজনা ব্রিজ পরিদর্শনে এলে মুক্তিবাহিনীর কামান গর্জে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির মুখে পাকসেনারা অবস্থান পরিত্যাগ করে কায়েম গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এই অভিযানে পাকবাহিনীর ৩ জন সৈন্য নিহত ও ৭ জন আহত হয়।

হোমনা থানার সাঘুটিয়া লঞ্চঘাটে সুবেদার গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদারদের একটি টহলদার লঞ্চকে অ্যামবুশ করে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে একঘন্টাব্যাপী প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। পরে পাকসেনারা লঞ্চ নিয়ে পশ্চাদপসারণ করে। ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল ইছামতির তীরে পাকবাহিনীর উস্কা ঘাঁটির কাছে একটি খুঁটিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে চারপার্শ্বে এন্টি পারসোনাল মাইন পুঁতে নিকটবর্তী ধানক্ষেতে ওৎপাতে। পাকবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য পাশ দিয়ে যাবার সময় পতাকাটি দেখতে পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পতাকাটি নামানোর জন্য অগ্রসর হয়। এতে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং পাকসেনাদের সবাই নিহত হয়। পরে ক্যাপ্টেন হুদা পাকসেনাদের পরিত্যক্ত অস্ত্র উদ্ধার করে দলের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।

৬নং সেক্টরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সুবেদার হাফিজের কোম্পানীর প্রধানপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া ও নুনিয়াপাড়া অবস্থানের ওপর  হামলা চালায়। হামলা শেষে পাকসেনারা চাওই নদীর তীরে তাদের মূল ঘাঁটিতে ফিরে যায়। পাকহানাদারদের এ হামলায় মুক্তিবাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়।

সিনেটর জেমস উইলিয়াম ফুলব্রাইট বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সিনেটে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের ভয়ানক পুনরাবৃত্তি শুধু গুরুতর অপব্যবহারই চিহ্নিত করে না যার সঙ্গে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা সম্পৃক্ত। মার্কিন সামরিক সহায়তা ছিল কমিউনিজমের বিরুদ্ধে সুরক্ষায় পাকিস্তানকে সজ্জিত করা। যা পরবর্তী সময়ে ব্যবহৃত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং পরবর্তীকালে গণতন্ত্রের দিকে ধাবমান পাকিস্তান নিজের দুর্বল পদক্ষেপকে দমন করতে। মার্কিন সহায়তার এই স্বেচ্ছাচারিতা সত্ত্বেও আমরা বিস্মিত যে- সামরিক পণ্যের চালান এখনও চলমান, দৃশ্যত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর ভ্রান্ত প্রভাব বা ‘লিভারেজের’ কারণে। এই বেদনা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ প্রশাসন ফরেন রিলেশনস কমিটিকে আশ্বস্ত করেছে যে, ২৫ মার্চ থেকে কোনো সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে চালান হয়নি এবং তা সরবরাহের জন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। উদীয়মান প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারকে ধ্বংস এবং নির্মম সামরিক অভিযানের মুখে- যা প্রধানত হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বাঙালি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে, শত হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তথাপিও আমরা পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সমর্থন করি। আরও সাহায্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ ও বিশ্বের অন্যান্য দাতা দেশগুলোর বিপরীতমুখী মনোভাবের মুখে এই সমর্থন চলমান রয়েছে। তবে, গৃহযুদ্ধে জড়িত একটি সরকারকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে সমর্থন করা অপর পক্ষকে হস্তক্ষেপের শামিল। ভারত কোনক্রমেই শরণার্থীদের পণ্যদ্রব্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যাপক চাহিদার এই বোঝা বহন করতে পারবে না। এই পরিস্থিতি সহজেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দ্রুততর বিপ্লবী কার্যকলাপকে পুনরায় ত্বরান্বিত করতে পারে যা ভারতের নিজেদের ভবিষ্যতের প্রতি বা আরেকটি ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটনের হুমকি বহন করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানীরা উভয়েই একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধানে একমত না হওয়া পর্যন্ত এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ না নেয়া পর্যন্ত অর্থনৈতিক সহায়তা স্থগিত করা উচিত।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি জন আর কেলি ঢাকায় পৌঁছোন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউম লন্ডনে বলেন, পাকিস্তানের পূর্ব অংশের জনসাধারণ যে ধরনের রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে উদগ্রীব তা একমাত্র পাকিস্তান সরকারই করতে পারে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানোর আগে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতিষ্ঠা অবশ্যই প্রয়োজন।

সামরিক প্রশাসন দিনাজপুর জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমে ঘোষণা করে, যারা বাড়ি-ঘর ত্যাগ করেছে, তারা যদি আর একদিনের মধ্যে তাদের নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে না আসে তবে মালিকানা বাজেয়াপ্ত করা হবে। দিনাজপুরে সামরিক শাসক পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত প্রত্যহ রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করে। এই সময়ের মধ্যে কাউকে ঘরের বাইরে কিংবা রাস্তায় পাওয়া গেলে গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে ঘোষণাতে বলা হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশে বলা হয়েছে, পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের চালানো গণহত্যার ব্যাপারে অনেকটাই জানা গেছে। তাদের কার্যক্রম এতোই নিখুঁত ছিল যে, হিটলার বেঁচে থাকলে তাঁর আধুনিক শিষ্যদের পদ্ধতিতে কোনো কিছুর কমতি খুঁজে পেতেন না। সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা পৌনে এক লাখের মতো। জীবন-সম্ভ্রম বাঁচাতে সত্তর লাখ পূর্ব বাঙালিকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। সারা বিশ্বের সামনে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা এক কলঙ্কের নাম। এরপরেও, জনগণকে ধোঁকা দিতে, পূর্ব বাংলায় সবকিছু স্বাভাবিক আছে, এমন দাবি করছে পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা, তারা উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি ফিরে আসা শরণার্থীদের জন্য অভ্যর্থনাকেন্দ্রও খোলা হয়েছে। 

ব্রিটিশ সংবাদপত্র সানডে টাইমস এর একজন প্রতিনিধি সম্প্রতি এ রকম একটি কেন্দ্র থেকে ঘুরে এসে জানিয়েছেন, পাঁচটি বেওয়ারিশ কুকুর ছাড়া কেন্দ্রটিতে আর কেউ নেই। গত কয়েক সপ্তাহে, ব্রিটেন, কানাডা, আয়ারল্যান্ড থেকে সংসদীয় প্রতিনিধিদল পূর্ব বাংলা সফর করেন। সেখানে আতঙ্কের পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলেই তাদের সবার মনে হয়েছে। নাৎসীদের কাছ থেকে ইসলামাবাদের শাসকরা গণহত্যার পদ্ধতি ছাড়া আরও অনেক কিছুই শিখেছে বলে দেখা যাচ্ছে। সেন্সরশিপ থাকা সত্ত্বেও যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, পূর্ব বাংলায় পুলিশি রাজ কায়েম হয়েছে। পূর্ব বাংলা এখন এক আতঙ্কের উপত্যাকা, যেখানে জার্মান গেস্টাপো কায়দায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সরকারী অফিসে এখনও যেসব কর্মকর্তা আসছেন তাদের উদ্দেশ্যে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রশ্নমালা জারি করেছে। 

যেসব প্রশ্নের উত্তর বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে একটি: আপনি কি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন? আরেকটি: আপনি কি বাঙালি? এ কী ধরনের অন্যায়! লস এ্যাঞ্জেলস টাইমসের এক প্রতিবেদনে পূর্ব বাংলায় পরিস্থিতির একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। তিনি জানাচ্ছেন, ঢাকা এখন এক ভয়ের নগরী। রাতের বেলায় রাস্তায় রাস্তায় ভুতুড়ে শূন্যতা বিরাজ করছে। সন্ধ্যা নামলেই লোকজন বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে; যদি আত্মীয়-স্বজনের বাড়ির দরজা-জানালা-দেয়াল শক্তপোক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তারা সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, ‘কোনোমতে শাকসবজি, অথবা একটু মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েই তাড়াতাড়ি তেলের বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়, দরজা আটকে দেয়া হয়। এ রকম একটা ধারণা বিরাজ করছে যে, অন্ধকার বাড়িঘরে কর্তৃপক্ষ আসার সম্ভাবনা কম।’ গোপন আলোচনায় এ আতঙ্কের কারণ হিসেবে বেশ কয়েকজনই তল্লাশিকে চিহ্নিত করেছেন। 

প্রতিনিধি আরও বলেন, ‘রাতের বেলায় ঘরে ঘরে দরজায় কড়া নেড়ে একই কাজ করা হয়। কোথায় বিদ্রোহীরা রয়েছে সে তথ্য জানা, পিঠ বাঁচাতে ইচ্ছুক লোকদের চর হিসেবে দলে নেয়া, অথবা বাড়ির নারীদের শ্লীলতাহানি করা; অথবা ভয় দেখানোর জন্যই আসা; অথবা মুচলেকা আদায় করা।’ তিনি একজন বাঙালি ব্যাংকারকে উল্লেখ করে বলেন, যাকে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সামরিক কর্মকর্তাদের থেকে নিজের ও তার পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। ফয়সি লিখেছেন, ‘কখনও কখনও পুরুষদের অস্ত্রের মুখে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আর নারীরা আহাজারি করতে থাকে। কেউ কেউ আহত অবস্থায় ফেরে, কেউ কেউ ফেরে না।’ সেনা কর্তৃপক্ষ ও তাদের পোষ্য স্থানীয় মিলিশিয়াদের সহায়তায় গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটিও জনগণকে আতঙ্কিত করার আরেকটি উপায়। বিবিসি লন্ডন টাইমসের মার্ক টালি বলেন, স্থানীয় মিলিশিয়ারা মূলত মাস্তান, যারা এ সুযোগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে বেড়াচ্ছে।