৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৭ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৭ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট ফোরাম আয়োজিত সমাবেশের বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'পাকিস্তান সরকার অহেতুক মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। অবিরামভাবে একদিকে তারা যেমন বাংলাদেশে গণহত্যা চলমান রেখেছে অন্যদিকে তারা ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ভারত সরকার বারবার বলেছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শরণার্থীদের স্বদেশে পাঠানো হবে। আমরা এই অবস্থায় শরণার্থীদের কোনোভাবেই বাংলাদেশে পাঠাতে পারি না। সবার আগে শরণার্থীদের নিরাপত্তা আমাদের কাছে প্রাধান্য পাবে।'
এই প্রসঙ্গে পাকিস্তান কয়েকদিন আগে বলেছিল, 'পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে অনাগ্রহী ভারত। ভারত শরণার্থীদের দেশে ফেরত আসতে দিচ্ছে না।'
ভারতে এদিন
২৭ জুলাই দিল্লি থেকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রে জানা যায়, পূর্ব বাংলার বিষয়ে আলোচনা করতে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট শিগগির নিরাপত্তা পরিষদে এক বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নিরাপত্তা পরিষদের দেশগুলোর কাছেও অভিমত জানতে চেয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব প্রস্তাব করেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা চাইলে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকা যাবে। একইসঙ্গে এরইমধ্যে জাতিসংঘে ভারত ও পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে গতকাল পৃথক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন মহাসচিব উ থান্ট। তারা দুজনেই আলোচনায় আসার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই সূত্র জানায়, সেই বৈঠকে ভারতের অবস্থান কী রূপ হবে তা জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেনকে জানাতে ২৮ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকের কথা রয়েছে।
২৭ জুলাই দিল্লিতে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জ্যোতি বসু বলেন, 'বাংলাদেশের বিষয়ে চীনের অবস্থান পীড়াদায়ক। আমরা আশা করেছিলাম চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে শোষিতের পক্ষে থাকবে, তারা তার বদলে চিহ্নিত গণহত্যাকারীদের বৈধতা দিচ্ছে। আমরা আশা করি চীনের শীঘ্রই শুভবুদ্ধির উদয় হবে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
২৭ জুলাই মার্কিন সিনেটে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর প্রক্সমায়ার ও সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি বলেন, 'পূর্ববঙ্গে চলমান অসহনীয় পরিস্থিতির অবসান হওয়া উচিত। গণহত্যা, যেখানেই হোক না কেন তাতে আমরা সমর্থন করতে পারি না। আজ সেখানে ধর্মীয় বিশ্বাসবোধের কারণে হাজার হাজার নরনারী-শিশু বর্বরতার শিকার হচ্ছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে। এটা কোনো সভ্য মানুষ তা মেনে নিতে পারে না। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়ের প্রতিই কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেননি, লাখ লাখ অধিবাসীকে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছে। এসব হতভাগ্য মানুষের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। পূর্ব পাকিস্তানে এখনো বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। অধিকাংশ মানুষ সেখানে সন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে তাদের উপর আবার নিপীড়ন নেমে আসার আশঙ্কা হচ্ছে। সেখানে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ইতিমধ্যে হাজার হাজার তরুণ গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান সরকার এ মুহূর্তে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সত্যিকার রাজনৈতিক মীমাংসার উদ্যোগ না নিলে কেবল পাকিস্তানে নয় গোটা অঞ্চলের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। আমাদের উচিত এখনই পূর্ববঙ্গে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।
২৭ জুলাই কানাডার রাজধানী অটোয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প বলেন, 'কানাডা পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য ৭০ লাখ মার্কিন ডলার এবং ভারতে পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের জন্য এর দ্বিগুণ সাহায্য প্রদান করবে। প্রয়োজনে এ সাহায্য আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। কানাডিয়ান এইড এই টাকা থেকে ১০ লাখ ডলারের সরিষা ক্রয় করবে। যা ভারতে পাঠানোর পর ভোজ্য তেল উৎপাদন করে বিতরণ করা হবে।'
২৭ জুলাই লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের নেতারা সাংবাদিকদের বলেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যে বিখ্যাত আইনজীবী শন ম্যাক্সব্রাইড পাকিস্তান সফরে যাবেন। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার প্রক্রিয়ার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে এবং তার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে দাঁড়াতে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের কাছে আবেদন করবেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এর আগে দেখা করতে চান বলে জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন 
২৭ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়, '১ লক্ষ ৩৬ হাজার শরণার্থীকে মানায় গয়া ও এলাহাবাদে এবং ২৪ হাজার জনকে ত্রিপুরা থেকে গৌহাটিতে পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে ৫২ লাখ ৭৩ হাজার, ত্রিপুরায় ১১ লাখ ৪৯ হাজার, মেঘালয়ে ৩ লাখ ১ হাজার, আসামে ২ লাখ ৩৩ হাজার, বিহারে ৮ হাজারে শরণার্থী এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের ১৫টি কেন্দ্রীয় ট্রানজিট ক্যাম্পে মোট ২,৩৩,০৮৬ জন শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। শিবিরের বাইরে রয়েছেন ২১২০ জন শরণার্থী।'
দেশব্যাপী এদিন
২৭ জুলাই কুষ্টিয়ার ইউনাইটেড স্কুলে শান্তি কমিটির আল বদর বাহিনীর প্রথম দল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়। এই অনুষ্ঠানে আল বদরদের বাংলা ও উর্দুতে শপথ বাক্য পাঠ করান কুষ্টিয়া জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমদ ও আহমদ আলী। 
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৭ জুলাই সিলেটের মুক্তিবাহিনীর মনু নদী অবস্থানের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ বাঁধে। চার ঘণ্টা ব্যাপী এই যুদ্ধে ২০ হানাদার সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহান বাবুল এদিন শহীদ হন।
২৭ জুলাই সিলেটের ছোটলেখা চা বাগানে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছোটলেখা চা বাগান ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাপী এই যুদ্ধের পর হানাদারেরা পালিয়ে যায়। এসময় চার হানাদার সেনা নিহত হয়, এবং মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন গুরুতর আহত হন।
২৭ জুলাই শেরপুরের নালিতাবাড়ির তন্তর, মায়াঘাসিতে ল্যান্স নায়েক মেজবাহউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি টহল দলের তীব্র সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ল্যান্স নায়েক মেজবাহউদ্দিন গুরুতর হন। অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর ১৬ সৈন্য নিহত হয়।
২৭ জুলাই সুনামগঞ্জের বিরামপুরে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে ৭ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২৭ জুলাই চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হেয়াকোঁ ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৪ সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে বিভিন্ন জায়গায় অর্ধ শতাধিক পাকসেনা নিহত

 

মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাদের সবদিক থেকেই কাবু করতে থাকে। ফাইল ছবি

মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাদের সবদিক থেকেই কাবু করতে থাকে। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সিলেটে মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ছোটলেখা চা বাগান ঘাঁটি আক্রমণ করে। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। দু‘ঘন্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা অবস্থান ত্যাগ করে পালাতে শুরু করে। এ যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা এবং মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন গুরুতর আহত হন।

ল্যান্সনায়েক মেজবাহউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নালিতাবাড়ী থানার তন্তর ও মায়াঘাসিতে পাকিস্তানী সৈন্যের একটি টহলদার দলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্সনায়েক মেজবাহউদ্দিন গুরুতর আহত হন।

চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর হিয়াকু ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ৪ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা চালালে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। 

সিলেটের মুক্তিবাহিনীর মনু নদী অবস্থানের ওপর পাকহায়েনার দল অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে ৪ ঘন্টা যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সোবহান বাবুল শহিদ হন। সুনামগঞ্জের বিরামপুরে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ৭ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। অপরদিকে একজন মুক্তিসেনা শহিদ হন। 

সিনেটর প্রক্সমায়ার ও সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি মার্কিন সিনেটে বলেন, অবশ্যই বাংলাদেশের ট্র্র্যাজেডির অবসান হওয়া উচিত। গণহত্যা, তা যে ভূখন্ডেই সংঘটিত হোক না কেন কখনোই সমর্থন পেতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাসবোধের কারণে হাজার হাজার নরনারী-শিশু বর্বরতার শিকার হবে, তাদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চলবে, কোনো সভ্য মানুষ তা মেনে নিতে পারে না। পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রায়ের প্রতিই কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেননি, লাখ লাখ অধিবাসীকে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছে। এসব হতভাগ্য মানুষের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। পূর্ব পাকিস্তানে এখনো বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। অধিকাংশ মানুষ সেখানে সন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো মূহুর্তে তাদের ওপর চরম ব্যবস্থা নেমে আসতে পারে বলে তারা মনে করছেন। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ইতিমধ্যে হাজার হাজার তরুণ গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান সরকার এ মূহুর্তে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সত্যিকার রাজনৈতিক মীমাংসার উদ্যোগ না নিলে কেবল পাকিস্তানে নয় গোটা অঞ্চলের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

কুষ্টিয়ার ইউনাইটেড স্কুলে কুষ্টিয়ার মুজাহিদদের প্রথম দল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়। কুষ্টিয়া জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমদ ও আহমদ আলী মুজাহিদদের বাংলা ও উর্দুতে শপথ বাক্য পাঠ করান।