৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৯ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মুজিবনগর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'আগামী ২৫শে জুলাই নদীয়ার কৃষ্ণনগরে নদীয়া জেলা দলের সঙ্গে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ ফুটবল দল।

এই ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ আমাদের মুক্তিসংগ্রাম তহবিলে প্রদান করা হবে।' এই বিজ্ঞপ্তিতে একই সঙ্গে বিমানবাহিনী ও নৌ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

ঢাকায় এদিনঃ

১৯ জুলাই ক্র্যাক প্লাটুনের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে একযোগে গেরিলা আক্রমণ চালায় ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা। এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো রামপুরার উলন, গুলবাগ ও খিলগাঁও পাওয়ার স্টেশন। এদিন রাত নয়টার দিকে সর্বপ্রথম উলন বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা চালানো হয়, তারপর খিলগাঁও এবং সবশেষে গুলবাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা চালানো হয়। তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্র্যাক প্লাটুনের তিনটি দল অংশ নিয়েছিল।

১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় সভাপতিত্ব করেন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মোস্তফা শওকত ইমরান। সভায় বক্তারা মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রতিহত করার নির্দেশ দেয়।

১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জে শান্তিকমিটি ও স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে বৈঠক করেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এন এম ইউসুফ। বৈঠকে তিনি বলেন, 'অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্যদের প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে। তবুও আমরা পাকিস্তানকে রক্ষা করবো।'

এসময় তিনি দেশরক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করার জন্য রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।

ভারতে এদিনঃ

১৯ জুলাই রাজ্যসভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, 'পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা একদিকে যেমন বাংলাদেশের শান্তি আনয়নের জন্য ক্ষতিকর তেমনি ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা করার ফলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত সমঝোতা বৈঠকের যে প্রস্তাব ছিল তার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে গেল।'

১৯ জুলাই ভারত সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থী সংখ্যা ৭০ লাখ ২১ হাজার ৪৯০ জনে পৌঁছেছে।

পাকিস্তানে এদিনঃ

১৯ জুলাই করাচিতে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইউম খান বলেন, 'পাকিস্তানের মধ্যে কেবল মুসলিম লীগই ১৯৬৬ সাল থেকে সর্বদা ৬ দফার বিরোধিতা করেছে। ৬ দফা প্রস্তাব ছিল ষড়যন্ত্রমূলক এবং টাইম বোমা। যা দ্বারা পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। সরকার যদি তখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতো তবে আজ এইদিন দেখতে হতো না।'

১৯ জুলাই রাওয়ালপিণ্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা বলেন, পাকিস্তানের এই দুঃসময়ে কেউ কেউ ক্ষমতার জন্য উন্মাদের মতো আচরণ করছে। এই ভয়াবহ দুর্যোগকালে ক্ষমতা হস্তান্তর বরং দেশের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে। যারা এই মুহূর্তে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করছে তারা নিঃসন্দেহে ক্ষমতালোভী ও দেশদ্রোহী।'

১৯ জুলাই পেশোয়ারে মুসলিম লীগের সেক্রেটারি খান গোলাম মোহাম্মদ লুন্দখোর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, 'পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পাঁয়তারায় ভারতের ইশারায় যুক্ত হয়েছেন খান আবদুল গাফফার খান ও ওয়ালী খান। তারা বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত কুৎসা রটিয়েই যাচ্ছেন। আমি সরকারের কাছে আহবান জানাই তাদের বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করা হোক।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিনঃ

১৯ জুলাই নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বিটলসের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, 'রবিশঙ্করের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জর্জ হ্যারিসন 'বাংলাদেশ' নামে একটি গান লিখেছেন। একই সঙ্গে তা রেকর্ডও করা হয়েছে। আগামী পহেলা আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই গানটি গাওয়া হবে। তবে এর পূর্বে আগামী ২৩ জুলাই থেকে বেশ কয়েকটি রেডিওতে এই গানটি বাজানো হবে। একই সঙ্গে ২৬ জুলাই থেকে এই গানের রেকর্ড বাজারে পাওয়া যাবে।'

১৯ জুলাই ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) এক খবরে বলে, 'শিগগিরই শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে যদি মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করাও হয় তবুও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি চাইলে তাকে ক্ষমা করতে পারেন। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যস্থতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। যদিও ইন্দিরা গান্ধী সে বৈঠকের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিনঃ

১৯ জুলাই ভারতের দ্য স্টেটসম্যান এক প্রতিবেদনে বলে, 'সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে পাকিস্তানি সেনারা সম্ভাব্য গেরিলা আক্রমণ থেকে রাজধানী ঢাকা, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ও চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এসব সূত্র মোতাবেক, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে এবং শুধু চট্টগ্রাম- সিলেট সেক্টরে এ সংখ্যা ৭০ হাজারের মতো। পশ্চিমাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাশক্তি এর চাইতে কম বলে মনে করা হয়। পাকবাহিনীর, ঢাকা ময়নামতি ও চট্টগ্রামের সরবরাহ লাইন সচল রাখার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিন মাস চেষ্টার পরেও তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সীমান্ত এলাকার সেনাবাহিনীর জন্য জরুরি ও কৌশলগত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি। গত মাসে মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৯০টি সফল গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করে। যাতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। বিশ্বাসযোগ্য হিসাব মতে এসব অপারেশনে ১৭০০ জন পাকসেনা নিহত বা গুরুতর আহত হয় যেখানে মুক্তিবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক কম। ঢাকায় গেরিলা বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে প্রায়ই খণ্ডযুদ্ধ হচ্ছে। এ সময় আতঙ্কিত ও বাহ্যত নীরব শহর উত্তাল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ২৮ জুন ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর পরই ঢাকা শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই ধারাবাহিকভাবে গেরিলা আক্রমণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ৩ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ‘পাক বে কোম্পানি’ গেরিলা আক্রমণে ধ্বংস হয়। এখান থেকে অনেক দূরে বসবাসকারী মানুষেরা সারা রাত এখানকার জ্বলন্ত আগুন দেখতে পেয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এখন কৌশলগত সেনা অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ শহর, শিল্পাঞ্চল ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে করা হয়। ইতোমধ্যে পূর্বাঞ্চলে পাকসেনাদের কৌশলগত পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। পাকসেনারা এখন তাদের গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি এবং স্থল ও জলপথের যোগাযোগ রক্ষায় বেশি তৎপর। এর ফলে সিলেট ও চট্টগ্রামের মধ্যে কয়েকশ’ মাইল সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত ছোট ছোট ঘাঁটিতে অবস্থানরত সেনাদের প্রত্যাহার করে সুরক্ষিত ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী যেসব এলাকা থেকে পাকসেনা সরিয়ে নেয়া হয়েছে তার কিছু এলাকায় রাজাকার নামের এক নতুন বেসামরিক বাহিনী নিয়োগ করা হয়। পূর্বাঞ্চলের মুক্তিসেনারা এখন পাকসেনাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া উন্নতমানের চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। সুসজ্জিত পাকসেনারা যারা একমাস আগেও গ্রামাঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে ভীতির সঞ্চার করত এখন তারা গেরিলা আক্রমণ ও তাদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে আতঙ্কিত। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া এক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭ জন পাকসেনা কুমিল্লার নবীনগর গ্রামের এক মুসলিম লীগ নেতাকে গেরিলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য এক মাস আগে নিয়োজিত ছিল। গভীর রাতে গেরিলারা এখানে আসে এবং তাদের সবাইকে বাইরে আসতে বলে; এর পর বিনা বাধায় তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। আমি যখন এখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দেবীপুর সীমান্ত এলাকায় ছিলাম তখন আমাকে আরেকটি কাহিনী বলা হয়। গত শনিবার বিকেল ৩ টায় গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা সীমান্তবর্তী সালদা নদীতে একটি সেনা স্পিড বোটে অকস্মাৎ হামলা চালায় যেখানে দু’জন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন ও ৪ জন সেনাসহ মোট ৮ জন নিহত হয়। এরা সবাই সালদা নদীর ঘাঁটি পরিদর্শনে এসেছিল। এলাকা ত্যাগ করার জন্য তাড়াহুড়ায় ছিল ও অকস্মাৎ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অভিযানের সময় গেরিলারা কিছু চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র, ওয়ারলেস সেট ও স্পিড বোট দখল করে। একই সঙ্গে আরেকটি স্পিড বোট ধ্বংস হয়ে যায়।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধঃ

১৯ জুলাই ফেনীর ছাগলনাইয়ার করৈয়া বাজারে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রার সময় ২০০ শরণার্থীর উপর পাশবিক নির্যাতন চালায় হানাদার বাহিনী। এসময় ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল খবর পেয়ে এগিয়ে এসে হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় প্রায় ৩০ হানাদার সেনা নিহত হয়। বেশ কয়েকজন শরণার্থী দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে নিহত হয়।

১৯ জুলাই ময়মনসিংহের ভালুকায় আফসার বাহিনীর একটি মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি হানাদারদের ভালুকা বাজার ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ২২ সৈন্য নিহত হয়। আহত হয় ১১ জন।

১৯ জুলাই কুমিল্লার বাবুরহাটে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত গ্রেনেড হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ৫ সৈন্য নিহত হয় এবং ৭ জন আহত হয়।

১৯ জুলাই লক্ষ্মীপুরের মান্দারিবাজারে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদারদের মান্দারিবাজার ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত। হানাদার বাহিনীর এসময় পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

 

ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে

 

ভারতে পূর্ব বাংলার ৭০ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। ফাইল ছবি

ভারতে পূর্ব বাংলার ৭০ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই দিনটি ছিল সোমবার। এদিন ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ লাখ ২১ হাজার ৪শত ৯০ জন। কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল বাবুরহাটে পাকহানাদারদের একটি গাড়ীর ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এই আক্রমণে ৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।

সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নির্দেশে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ, হাবিলদার মতিন ও শাহাবউদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা দল রাজাকারসহ হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্যের মান্দারীবাজার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন।

পাকিস্তানীদের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী একজন মেজরের কমান্ডে করুইয়াবাজার অবস্থানে ভারতে গমনরত প্রায় দুইশত শরণার্থীকে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল পাকহানাদারদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সময় প্রায় দেড়শ শরণার্থী নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসে ও কিছু শরণার্থী গোলাগুলিতে নিহত হয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩০ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী কোনো ক্ষতি স্বীকার না করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ভালুকা থানার বাজার ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ আক্রমণে হানাদারদের ঘাঁটি বিধ্বস্ত হয় এবং ২২ জন পাকসেনা নিহত ও ১১ জন আহত হয়। ঢাকা শহরের তিনটি বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে রাতে শহরের একাংশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপির খবরে বলা হয়েছে, রাতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চামেলিবাগ ও শাহবাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে আক্রমণ করে কেন্দ্র দুটিকে বিকল করে দেয়।

কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, জাতীয় জীবনের এ সঙ্কটকালে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি দেশদ্রোহিতামূলক। পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইউম খান বলেন, দেশের রাজনৈতিক দল হিসেবে শুধুমাত্র পাকিস্তান মুসলিম লীগই প্রথম থেকে ৬ দফার বিরোধীতা করে এসেছে, ৬ দফাকে একটি ‘টাইম বোমা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এন এম ইউসুফ নারায়ণগঞ্জে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের কর্মতৎপরতা দেখতে যান। তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জে রাজাকাররা দুষ্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা) দমনে কঠিন পরিশ্রম করছে এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে।

গাফফার খান ও ওয়ালী খানের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করার দাবি জানায় মুসলিম লীগ সেক্রেটারী লুন্দখোর। তিনি বলেন, ‘এসব লালকোর্তাধারীরা বিদেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তফা শওকত ইমরান। সভায় মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রতিহত করার নির্দেশ দেয়া হয়।

দ্য স্টেটস ম্যানের প্রতিবেদক তার রিপোর্টে বলেন, সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে পাকসেনারা সম্ভাব্য গেরিলা আক্রমণ থেকে রাজধানী ঢাকা, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ও চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এসব সূত্র মোতাবেক, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে এবং শুধু চট্টগ্রাম- সিলেট সেক্টরে এ সংখ্যা ৭০ হাজারের মতো। পশ্চিমাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাশক্তি এর চাইতে কম বলে মনে করা হয়। পাকবাহিনীর, ঢাকা ময়নামতি ও চট্টগ্রামের সরবরাহ লাইন সচল রাখার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিন মাস চেষ্টার পরেও তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সীমান্ত এলাকার সেনাবাহিনীর জন্য জরুরী ও কৌশলগত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি। গত মাসে মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৯০টি সফল গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করে। যাতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। 

বিশ্বাসযোগ্য হিসাব মতে এসব অপারেশনে ১৭০০ জন পাকসেনা নিহত বা গুরুতর আহত হয় যেখানে মুক্তিবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক কম। ঢাকায় গেরিলা বাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রায়ই খণ্ডযুদ্ধ হচ্ছে। এ সময় আতঙ্কিত ও বাহ্যত নীরব শহর উত্তাল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। 
২৮ জুন ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর পরই ঢাকা শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই ধারাবাহিকভাবে গেরিলা আক্রমণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ৩ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ‘পাক বে কোম্পানি’ গেরিলা আক্রমণে ধ্বংস হয়। এখান থেকে অনেক দূরে বসবাসকারী মানুষেরা সারা রাত এখানকার জ্বলন্ত আগুন দেখতে পেয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এখন কৌশলগত সেনা অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ শহর, শিল্পাঞ্চল ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে করা হয়। এরইমধ্যে পূর্বাঞ্চলে পাকসেনাদের কৌশলগত পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। পাকসেনারা এখন তাদের গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি এবং স্থল ও জলপথের যোগাযোগ রক্ষায় বেশি তৎপর। এর ফলে সিলেট ও চট্টগ্রামের মধ্যে কয়েকশ’ মাইল সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। 

সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত ছোট ছোট ঘাঁটিতে অবস্থানরত সেনাদের প্রত্যাহার করে সুরক্ষিত ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী যেসব এলাকা থেকে পাকসেনা সরিয়ে নেয়া হয়েছে তার কিছু এলাকায় রাজাকার নামের এক নতুন বেসামরিক বাহিনী নিয়োগ করা হয়। পূর্বাঞ্চলের মুক্তিসেনারা এখন পাকসেনাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া উন্নতমানের চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। সুসজ্জিত পাকসেনারা যারা একমাস আগেও গ্রামাঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে ভীতির সঞ্চার করত এখন তারা গেরিলা আক্রমণ ও তাদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে আতঙ্কিত। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া এক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭ জন পাকসেনা কুমিল্লার নবীনগর গ্রামের এক মুসলিম লীগ নেতাকে গেরিলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য এক মাস আগে নিয়োজিত ছিল। 

গভীর রাতে গেরিলারা এখানে আসে এবং তাদের সবাইকে বাইরে আসতে বলে; এর পর বিনা বাধায় তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। আমি যখন এখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দেবীপুর সীমান্ত এলাকায় ছিলাম তখন আমাকে আরেকটি কাহিনী বলা হয়। গত শনিবার বিকেল ৩ টায় গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা সীমান্তবর্তী সালদা নদীতে একটি সেনা স্পিড বোটে অকস্মাৎ হামলা চালায় যেখানে দু’জন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন ও ৪ জন সেনাসহ মোট ৮ জন নিহত হয়। এরা সবাই সালদা নদীর ঘাঁটি পরিদর্শনে এসেছিল। এলাকা ত্যাগ করার জন্য তাড়াহুড়ায় ছিল ও অকস্মাৎ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অভিযানের সময় গেরিলারা কিছু চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র, ওয়ারলেস সেট ও স্পিড বোট দখল করে। একই সঙ্গে আরেকটি স্পিড বোট ধ্বংস হয়ে যায়।