৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৭ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৭ জুলাই মুজিবনগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রস্তাবিত চীন সফর নিয়ে একটি বিবৃতি দেন। তাতে তিনি এই বলেন, বড় শক্তিগুলোর মধ্যে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিক কৌশলে পালাবদল এলে শান্তিকামী ছোট দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের স্বাধীনতার জাতীয় স্পৃহা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


ভারতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী এ ব্যাপারে কলকাতায় বলেন, নিক্সনের চীন সফরের ফলে বিশ্বশক্তির ভারসাম্য পাল্টে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যাতে ছোট রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতির আশঙ্কা আছে। তবে এর ফল যা–ই হোক, বাংলাদেশ আজ বাস্তব এবং লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর জয় হবেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো মীমাংসায় আসতে হলে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমেই তা সম্ভব।


বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘকে বাংলাদেশে ত্রাণকার্যে বা শরণার্থীদের তদারকির কাজে নামানোর প্রস্তাব দুরভিসন্ধিমূলক। জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারকে আগে স্বীকৃতি দিক, তারপর ওই ধরনের সাহায্য দিক। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিশ্বের জনগণের কাছে আবেদন জানান।


যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ সহায়ক কমিটির কাছে পাঠানো ২০০ ডলারের একটি চেক এই দিন কমিটির কাছে পৌঁছায়। চেকটির সঙ্গে অ্যালেন গিন্সবার্গ একটি চিঠিও পাঠান। চিঠিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা এবং পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রপূর্ণ জাহাজ পাঠানোর বিরুদ্ধে জনমত এখনো ততটা জোরদার হয়ে ওঠেনি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে যে বিশ্বের অন্য দেশে চলমান অন্যায়–অবিচারের দিকে তাকানোর অবকাশ তাদের হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হবে না বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।


যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম কমিটির একজন মুখপাত্র লন্ডনে সাংবাদিকদের জানান, তাঁরা আশঙ্কা করছেন, ইরান ব্রিটিশ কারখানায় ট্যাংকের যে ক্রয়াদেশ দিয়েছে, তা সম্ভবত পাকিস্তানের হাতে গিয়ে পড়বে অথবা ইরান ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে যেসব অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছে তার পরিবর্তে এই নতুন অস্ত্র পাঠাতে পারে। এ ব্যাপারে কমিটির নেতারা ব্রিটিশ সরকার ও লন্ডনের ইরানি দূতাবাসের সঙ্গে আলোচনার কথা ভাবছেন।


যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর ডক শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা আগের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ঘোষণা করেন, পাকিস্তানগামী জাহাজে অসামরিক মালপত্র তুলতে তাঁরা রাজি। আন্তর্জাতিক বন্দর কর্মী সমিতির স্থানীয় ইউনিটের প্রথম সহসভাপতি চার্লস জোনস বলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন জাহাজে অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়।


ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর বলেন, বাংলাদেশ থেকে এক কোটি শরণার্থী আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তখন শরণার্থী বাবদ খরচ আরও অনেক বাড়বে। এই হিসাবের মধ্যে প্রশাসনিক খরচ ধরা হয়নি।


ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ বি কিটিং পশ্চিমবঙ্গের সল্টলেক ও বারাসাতে তিনটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। শরণার্থীদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার পর সাংবাদিকেরা তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে কিটিং কোনো মন্তব্য করেননি। এরপর তিনি মহাকরণে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় এবং মুখ্য মচিব এন বি সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা করেন। সে সাক্ষাতের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বেইজিং যাওয়ার সিদ্ধান্তটি সময়োচিত পদক্ষেপ।


মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল মর্টারসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদা নদী রেলস্টেশনের দক্ষিণে মনোরা রেলসেতুর কাছে একদল পাকিস্তানি সেনার ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এতে কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

গুলির মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের শালদা নদী ঘাঁটিতে ফিরে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কিছু পাকিস্তানি সেনাকে লাতুমুড়া থেকে চন্দ্রপুর যাওয়ার পথে অ্যামবুশ করেন। অ্যামবুশে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।


কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কে পুটিয়া গ্রামের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযোদ্ধারা কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়কের আশিকাটি গ্রামের কাছে একদল পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল হাজীগঞ্জের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর নরসিংপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে যান।


উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী জেলার শাহপাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলের ওপর আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

 

৭০ লাখ শরণার্থীর জন্য ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন

 

ভারতে প্রায় ৭০ লাখ শরণার্থী এসেছে বাংলাদেশ থেকে। ফাইল ছবি

ভারতে প্রায় ৭০ লাখ শরণার্থী এসেছে বাংলাদেশ থেকে। ফাইল ছবি

সেক্টর কমান্ডারদের ঐতিহাসিক কনফারেন্সের ঘোষণা মোতাবেক বাংলাদেশ নৌবাহিনী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি অফিসার ও নাবিক যারা পশ্চিম পাকিস্তান ত্যাগ করে দেশে এসেছিলেন তারাই বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠন করেন। ভারত থেকে প্রাপ্ত ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামের ছোট দুটি গানবোট এবং ৪৯ জন নাবিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই নাবিকেরা শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হন।

শালদা নদীর রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণে মনোরা রেলওয়ে ব্রিজ পর্যন্ত পাকবাহিনীর সৈন্যরা অগ্রসর হয়ে ব্রিজের চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরীর প্রস্তুতি নেয়। এ সময় ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানীর একটি প্লাটুন মর্টারসহ পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনারা সম্পূর্ণভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং অনেক পাকসৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির মুখে পাকসেনারা উপায়ান্তর না দেখে তাদের শালদা নদী ঘাঁটিতে ফিরে যায়।

কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তার আশীকাটি গ্রামের নিকট মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি কনভয়ের ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। এই আকমণে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও অনেক আহত হয়। নিয়মিত ও গণবাহিনীর একটি সম্মিলিত কোম্পানী হাজীগঞ্জের কাছে পাকবাহিনীর নরসিংপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকহানাদার বাহিনীর ১৩ জন সৈন্য নিহত ও অনেক সৈন্য আহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা দল নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসে।

লে. হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা একদল পাকসেনাকে লাটুমুড়া থেকে চন্দ্রপুর যাওয়ার পথে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে পাকবাহিনীর ৪ জন নিহত ও একজন আহত হয় এবং বাকী সৈন্য প্রাণ বাঁচাতে লাটুমুড়ার দিকে পালিয়ে যায়।

কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কে পুটিয়া গ্রামের সামনে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ওয়াপদা ট্রাক হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা এন্টি-ট্যাংক মাইনের ওপর বিস্ফোরিত হয়। ফলে ট্রাকটি ধ্বংস হয় এবং ট্রাকে অবস্থানরত একজন পাকসৈন্য, ২ জন রাজাকার ও ড্রাইভারসহ সবাই নিহত হয়। পরে পাকসেনাদের আর একটি জীপ ও ট্রাক এন্টি-ট্যাংক মাইনের বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। এতে ৫ জন পাকসৈন্য, ১ জন পাক মেজর ও ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে কুমিল্লা থেকে পাকসেনারা ৩০টি গাড়ীতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। সামনের গাড়ী থেকে পাকসৈন্যরা নেমে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হলে এন্টিপার্সোনাল মাইন বিস্ফোরণে ৬/৭ জন সৈন্য নিহত ও অনেকে আহত হয়।

রামগঞ্জের উত্তরে নরিমপুর হতে এক কোম্পানী পাক রেঞ্জার্স ও রাজাকার দল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলে হাবিলদার জাকির হোসেনের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর পাকসেনারা ২ জন রাজাকারের লাশ ফেলে পালিয়ে যায়।

রাজশাহী জেলার শাহপারে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি টহলদার দলের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর ২২ জন সৈন্য নিহত হয়। গফরগাঁও থানার দেইল পাড় গ্রামে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ১৭ জন নিহত ও ২৭ জন আহত হয়।

পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী টাঙ্গাইল শেরপুর ও হালুয়াঘাটের সেনাবাহিনীর ঘাঁটিসমূহ পরিদর্শন করে। শেরপুর ও হালুয়াঘাটে নিয়াজী রাজাকারের সশস্ত্র ট্রেনিং দেখেন এবং তাদেরকে সেনাবাহিনীর পাশে থেকে কাজ করার নির্দেশ দেন।

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের সুপারিশ গৃহীত হয়। ভারতের বিহার রাজ্য থেকে প্রকাশিত সাময়িকী ‘কম্পাস’-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাদেশের স্বীকৃতি সম্পর্কে সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতি কর্তৃক আয়োজিত এক জনসভায় দেশের সব রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্দেশ্য এই মর্মে আবেদন করেন যে, ভারত সরকারের ওপর বিশেষ চাপ দেবার ব্যবস্থা করুন। বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেলেই ঐ দেশের মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে উপযুক্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা সহজ হয়ে উঠবে। 

শ্রী নারায়ণ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সেনারা যে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে তার ফলে ভারতকে এক ভীষণ সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই সঙ্কটের মধ্যে দিয়েই ভারতকে প্রকৃত রাজনৈতিক পরীক্ষা দিতে হবে। এই সঙ্কটের মাঝেই ভারত সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে অথবা তাকে ভাঙনের মুখে দাঁড়াতে হবে। আজ বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলছে তার বোঝা ভারতকে বহন করতেই হবে। বাংলাদেশ পরাজিত হলে, পরিণামে ভারতকেও পরাজয় বরণ করতে হবে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে ভারত শামিল হয়ে গেছে। পাকিস্তানের উপর অন্যান্য রাষ্ট্রদের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত অপেক্ষা করতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ যে রায় দিয়েছেন তার মর্যাদা ভারতকে দিতে হবে। পাকিস্তান বাংলাদেশে যে নিপীড়ন ও অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তা থেকে সরে দাঁড়াবে না। আর তার নীতিরও পরিবর্তন ঘটাবে না। এমতাবস্থায় এক্ষুনিই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিতে হবে। ভারতের স্বার্থেই এ কাজটা করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ থেকে যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের আগমণের ফলে এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকমের জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। 

বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের সামরিক চক্র যে টাকা খরচ করছে, তার চাইতে তিন চারগুণ বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে ভারতকে বিনা যুদ্ধেই। যদি কেউ মনে করেন যে যুদ্ধ চলতে থাকলে পাকিস্তানের কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে, তাহলে তিনি ভুল করবেন। তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে, তাকে বাইরে থেকে মনে হবে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এ যুদ্ধ গৃহযৃদ্ধ নয়। এ যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী একটা দেশের সঙ্গে একটি মুক্তিকামী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনগণের যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বার্তা বহন করে তিনি এটা উপলব্ধি করেছেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের ভারত বিরোধী প্রচারকার্য ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সমস্যাবলী নিয়ে বিশ্বের দুটি রাষ্ট্র অর্থাৎ আমেরিকা ও ফ্রান্স অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আমাকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, পাকিস্তানকে আরও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে আরও ছয়/সাত জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। ফ্রান্স সরাসরি পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র না পাঠালেও সেখানে খোলাবাজারে পাকিস্তানের জনগণের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। এখন ভারতে প্রায় ৭০ লাখ শরণার্থী এসেছে বাংলাদেশ থেকে। অদূর ভবিষ্যতে এই সংখ্যা এক কোটিতে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের ও দুর্গত শরণার্থীদের সাহায্য দেয়ার জন্য এ পর্যন্ত বিহারের জনগণ ২৭ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে। বিহারের অধিবাসীরা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করার এক কর্মসূচী নিয়েছে।

একই সম্পাদকীয়তে ‘কম্পাস’ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. এ আর মল্লিককে উদ্ধৃত করে বলে, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে বিহারের জনগণ যে ভূমিকা পালন করেছেন তা কোনদিনই বাংলাদেশের মানুষ ভুলবে না। ড. মল্লিক আরও বলেন, বাংলাদেশে বাঙালী হিন্দু ও বাঙালির মধ্যে কোনো শক্তিই ফাটল ধরাতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত বাংলার মুক্তিকামী মানুষ জয়ী হবেই। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে এখন যে যুদ্ধ চলছে তা হলো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার যুদ্ধ। এমতাবস্থায় গণতান্ত্রিক ভারতের জনগণ যদি বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে বাংলাদেশের মুক্তি আরও ত্বরান্বিত হবে।