৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৪ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

 ১৪ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর বন্দরে পাকিস্তানকে দেয়া অস্ত্র সহায়তা বন্ধে এবং পাকিস্তানের করাচিগামী পদ্মা জাহাজকে বাল্টিমোর বন্দরে ভিড়তে দেয়ার প্রতিবাদে মুখর হয় বাল্টিমোর শহরের মানুষ। এদের মধ্যে একদল শ্রমিক, স্থানীয় বাঙালি ও অবাঙালি মানুষ এসময় যুদ্ধজাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা দেয়।


কোয়ার্কাস নামের একটি দল এদিন বেশ কয়েকটি ডিঙি নৌকা নিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে পাকিস্তানগামী পদ্মা কার্গো জাহাজের গতিপথ বন্ধ রাখে। এ প্রতিবাদের নেতৃত্বে ছিলেন উন্নয়নকর্মী রিচার্ড কে. টেলর, আন্দোলনকারীদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী বাঙালি সুলতানা আলম, চার্লস খান, স্যালি উইলবি, স্টেফানি হলিম্যান, চার্লস গুডউইন, ওয়েইন লাউসারসহ অনেকে। এ আন্দোলনের কারণে টেইলরসহ ৭ জনকে সরকারি কাজে বাঁধা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের গ্রেপ্তার করলে ধর্মঘট ডেকে বসে বন্দরের শ্রমিকরা। ‘রক্তমাখা টাকা নেব না’—এমন স্লোগান দিয়ে তারা পাকিস্তানি জাহাজে মালামাল তোলা থেকে বিরত থাকে। পাকিস্তানে কোনো অস্ত্র যাবে না, পাকিস্তানে সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ করো- এমন অজস্র প্ল্যাকার্ড নিয়ে শ্রমিক, আন্দোলনকারী ও সাধারণ মানুষ পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি ও সামরিক সহায়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এদিনের আন্দোলনের খবর পরদিন ফলাও করে প্রচার করে গণমাধ্যমগুলো। 


১৪ জুলাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, 'সম্প্রতি প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী নিউজ ইউক বলেছে, 'পাকিস্তান যেদিন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য সৈন্য পাঠায় সেই দিনই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযান চালানোর জন্য বাংলাদেশে যখন সৈন্য ও সমরসম্ভার পাঠানোর কাজে ব্যস্ত ছিল ঠিক সেই সময় পাকিস্তানের ঘরে-বাইরে সবদিক থেকেই রাজনৈতিক সমাধানের দাবি উঠছিল। ইয়াহিয়ার সামরিক প্রস্তুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠছিল। দাবি উঠছিল পাকিস্তানের যে সঙ্কট তার সমাধান সমরসজ্জা বা সামরিক অভিযানে সম্ভব নয়। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। কোনো রকম শর্তারোপ না করে গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই সমাধান নিহিত আছে। বুলেট-বেয়নেটে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র ঘরে-বাইরের এই দাবি উপেক্ষা করে পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল করে বাংলাদেশের ওপর সামরিক অভিযান চালায়। গত সপ্তাহে ঢাকায় কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন, 'আপোষ আলোচনার আর কোনো পথই খোলা রইল না। ইয়াহিয়ার গোঁয়ার্তুমির জন্য আলোচনার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। আলোচনা এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তান এখন মৃত, সামরিক শাসনই পাকিস্তানের ধ্বংসের জন্য দায়ী।'
১৪ জুলাই কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিদল যশোরের ঝিকরগাছা ও খুলনা পরিদর্শন করেন।


ভারতে এদিনঃ
১৪ জুলাই লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, এখন একটি জিনিস দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার ও সত্য যে বাংলাদেশের বিজয় এখন কেবলই সময়ের অপেক্ষা। দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে শিগগির মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে বিজয়ী করবে।


১৪ জুলাই লোকসভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, 'পশ্চিম পাকিস্থানের শাসক মহল বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর যেভাবে নিপীড়ন ও জঘন্য অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তাতে তাদের পুরনো সেই ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ খুলে পড়েছে। পাকিস্তান সরকার মুখে ন্যায়ের কথা বলছে অথচ নিরীহ সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। পুরো বাংলাদেশকে তারা আজ শ্মশানে রূপান্তর করেছে। অথচ এর পরেও মার্কিন সরকার তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে। যারা আজ পাকিস্তানের এতো নির্মম নিপীড়ন, গণহত্যার পরেও তাদের সহযোগিতা করছে পক্ষান্তরে তারা গণহত্যাকেই উৎসাহিত করছে। তারা বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতন ও নিপীড়নে অন্যতম কুশীলবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।' 


১৪ জুলাই নব কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে বলা হয়, অতিসত্বর শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে।


১৪ জুলাই মুম্বাইয়ে ভারত বন্দর ও ডক ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি এস আর কুলকারনি বলেন, আমরা সম্প্রতি ১৩টি দেশের পরিবহন সংস্থার কাছে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার অনুরোধ করেছি। এবং এও বলেছি যতক্ষণ না পাকিস্তান সরকার পূর্ববঙ্গে স্থিতিশীলতা না আনবে ততোক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানের সকল সামরিক ও বেসামরিক যানবাহনের সঙ্গে যেন তারা যুক্ত না হন। এবং একই সঙ্গে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে স্বীয় দেশের সরকারের কাছে দাবি জানান। 


পাকিস্তানে এদিনঃ
১৪ জুলাই পাকিস্তানের ইসলামাবাদে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক বিবৃতিতে বলেন, 'জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই এই মুহূর্তে জটিল অবস্থা নিরসনে একমাত্র সমাধান। নির্বাচনের পর ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় প্রচুর সময় নষ্ট হয়েছে। যার ফলে জনগণ নিজেরাও হতাশ হয়ে পড়েছে।'


১৪ জুলাই পাকিস্তান সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, 'ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিককে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।'


১৪ জুলাই কোয়েটায় এক সংবাদ সম্মেলনে তেহেরিকে ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটে চলেছে, তাতে কেবল দেশেরই ক্ষতি হয়নি, বরং অমীমাংসিত কাশ্মীর সমস্যাতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।'


আন্তর্জাতিক মহলে এদিনঃ

১৪ জুলাই ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা আর্থার বটমলি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা পাকিস্তানে আটক পূর্ব বাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি কিন্তু আমাদের দেখা করতে দেয়া হয়নি। আমরা যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছি তখন ইয়াহিয়ার আচরণ ছিল অগ্রহণযোগ্য। একই সঙ্গে ইয়াহিয়া খান তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।'


১৪ জুলাই মার্কিন সিনেটের অধিবেশন দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রজার পি ডেভিস পূর্ব পাকিস্তানে চলমান মানবিক বিপর্যয় ও সহায়তার বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে পাকিস্তান সরকার যতক্ষণ না কোনো পূর্ণাঙ্গ সমাধানে পৌঁছায় ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানে সকল প্রকার মার্কিন সহায়তা বন্ধ করতে হবে। তাহলে আমরা অবস্থার উন্নতি আশা করতে পারি।'


১৪ জুলাই ব্রিটিশ সরকারের এক প্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়। ব্রিটিশ সরকার সম্প্রতি পাকিস্তানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, 'পাকিস্তানের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য ও ভীষণ হতাশাজনক।' এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে চরম অসন্তোষের প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সরকার। একই সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার বলেছে, 'পাকিস্তান বন্ধুপ্রতিম হতে পারে কিন্তু মানবিকতা ও অন্যায়ের ক্ষেত্রে আমরা কোনো ছাড় দিতে পারি না। পূর্ব বাংলার সাধারণ জনগণের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের ন্যূনতম সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। তারা অনুমানও করতে পারে না তাদের দেশের জনগণ সরকারের কাছে কী প্রত্যাশা করে!'


আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিনঃ
১৪ জুলাই বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলে, ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পূর্ব পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ইতিহাসের ভয়াল পৈশাচিকতা চলছে বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন এই মুহূর্তে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে শেখ মুজিবুরের মুক্তি ও তার সঙ্গে সমঝোতা করা।


১৪ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমস এক সম্পাদকীয়তে বলে, 'পাকিস্তানের উপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মার্কিন সরকার যেভাবে অগ্রহণযোগ্যভাবে অস্ত্র বিক্রি করেছে তা ভয়ানক। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। যার পরিণাম ভোগ করবে নিরীহ সাধারণ মানুষ।


দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধঃ
১৪ জুলাই নরসিংদীর বেলাবোতে সুবেদার বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালাতে অ্যামবুশ তৈরি করে। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অ্যামবুশের কথা জানতে পারে। এসময় হানাদারেরা তাদের সিদ্ধান্ত বদল করে তারা লঞ্চে না এসে নৌকাযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান অতিক্রম করে। পরে একটি খালি লঞ্চ এলে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনী ধারণা করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর খালি লঞ্চে গুলিবর্ষণ দেখে হানাদার সেনারা পিছন দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। এসময় মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে প্রবল গোলাগুলি হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ক্যাম্পে চলে যায়। এই যুদ্ধে শহীদ হন সুবেদার আবুল বাশার, সিপাহী আবদুল বারী, সিপাহী নূরুল ওহাব, সিপাহী সোহরাব হোসেন, সিপাহী মমতাজ উদ্দীন, সিপাহী আব্দুল হক, সিপাহী আবদুস সালামসহ বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৪ জুলাই কুড়িগ্রামের বড়খাতায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর সিপাহী মুহাম্মদ আলী শহীদ হন।

 

 ‘বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই’, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম

 

একাত্তরের গণহত্যার বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব পাকিস্তানের নিন্দা করতে থাকে। ফাইল ছবি

একাত্তরের গণহত্যার বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব পাকিস্তানের নিন্দা করতে থাকে। ফাইল ছবি

এই দিনটি ছিল বুধবার। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম লোকসভায় বলেন, একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আর তা হলো মুক্তিফৌজের সাহসিকতার ফলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় বলেন, পশ্চিম পাকিস্থানের শাসকচক্র বাংলাদেশের জনগণের ভাবাবেগের ওপর জঘন্য সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে তার ঔপনিবেশিক চক্রান্তের মুখোশ খুলে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, ভারত সরকার মনে করে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করছে তারা পক্ষান্তরে পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গকে বাঙালি জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাবার উৎসাহ দিচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকবর্গ বাংলাদেশের জনগণের ব্যাপারে অযথা হস্তক্ষেপ করছে বলে সরকার মনে করছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বাংলাদেশের বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও একাত্তরের গণহত্যার বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ করেছিল আমেরিকার মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর শহরের মানুষ। বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দর থেকে অস্ত্র বোঝাই করছিল পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজ ‘পদ্মা’। ১৪ জুলাই ১৯৭১ তারিখে একদল শ্রমিক ও স্থানীয় বাঙালি ও অবাঙালি সাধারণ মানুষ যুদ্ধজাহাজে অস্ত্র তুলতে বাধা দেয়। কোয়ার্কাস নামের একটি দল কতগুলো ডিঙি নৌকা নিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে পাকিস্তানের কার্গো জাহাজের গতিপথ বন্ধ রাখে। এ প্রতিবাদের নেতৃত্বে ছিলেন উন্নয়নকর্মী রিচার্ড কে. টেলর। তার সঙ্গে ছিলেন সুলতানা আলম, চার্লস খান, স্যালি উইলবি, স্টেফানি হলিম্যান, চার্লস গুডউইন, ওয়েইন লাউসার প্রমুখ। এ আন্দোলনের কারণে টেইলরসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বন্ধ করা যায়নি। এর পরই ধর্মঘট ডেকে বসে পোর্ট শ্রমিকরা। ‘রক্তমাখা টাকা নেব না’—এমন স্লোগান দিয়ে তারা পাকিস্তানী জাহাজে মালামাল তোলা থেকে বিরত থাকে। ‘No arms to pakistan’, ‘End all US Aid to Pakistan’ লেখা ফেস্টুন নিয়ে তারা সেদিন ধর্মঘট করে। এ আন্দোলনের খবর ফলাও করে প্রচার করে গণমাধ্যমগুলো।

স্বাধীন বাংলা বেতারে সংবাদ পর্যালোচনায় মার্কিন সাময়িকী নিউজইউকের বরাতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান যেদিন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য সৈন্য পাঠায় সেই দিনই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। নিউজউইক পত্রিকায় বলা হয় ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযান চালানোর জন্য বাংলাদেশে যখন সৈন্য ও সমরসম্ভার পাঠানোর কাজে ব্যস্ত ছিল ঠিক সেই সময় পাকিস্তানের ঘরে-বাইরে সবদিক থেকেই রাজনৈতিক সমাধানের দাবি উঠছিল। ইয়াহিয়ার সামরিক প্রস্তুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠছিল। দাবি উঠছিল- পাকিস্তানের যে সঙ্কট তার সমাধান সমরসজ্জা বা সামরিক অভিযানে সম্ভব নয়। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। কোনো রকম শর্ত আরোপ না করে গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই সমাধান নিহিত রয়েছে। বুলেট-বেয়োনেটে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র ঘরে-বাইরের এই দাবি উপেক্ষা করে পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল করে বাংলাদেশের ওপর সামরিক অভিযান চালাল। নিউজউইক উল্লেখ করে, গত সপ্তাহে ঢাকায় কয়েকজন বিদেশী কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন, আপোষ আলোচনার আর কোনো পথই খোলা রইল না। ইয়াহিয়ার গোঁয়ার্তুমির জন্য আলোচনার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। আলোচনা এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তান মরে গেছে এবং ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্রই পাকিস্তানকে ধ্বংস করেছে।

পাকবাহিনীর বেলাবো আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে সুবেদার বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল বেলাবোর নিকটবর্তী এলাকা টোকের কাছে অ্যামবুশ তৈরী করে। বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনী অ্যামবুশের কথা জানতে পারে। ফলে তারা লঞ্চে না এসে নৌকাযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান অতিক্রম করে। পরে একটি খালি লঞ্চ এলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাবাহিনী মনে করে গুলিবর্ষণ শুরু করে।

অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা পিছন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েক ঘন্টা গুলি বিনিময় হয়। এই যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবুল বাশার, সিপাহী আবদুল বারী, সিপাহী নূরুল ওহাব, সিপাহী সোহরাব হোসেন, সিপাহী মমতাজ উদ্দীন, সিপাহী আব্দুল হক ও সিপাহী আবদুস সালাম শহীদ হন। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে।