৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১২ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিবাহিনীর সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলনের প্রথম দিনের অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে ১২ জুলাই কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অধিবেশনের শুরুতেই একটি আবেগঘন বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছেন এবং যাঁরা বেসামরিক নানা কাজে যুক্ত আছেন সবার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কাজই পরিপূরক। তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ঐক্য ও সমঝোতা বজায় রাখার আহ্বান জানান। ভাষণের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।


অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল, নেতৃত্বের বিভিন্ন ধাপ, এলাকা নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়। সেক্টর অধিনায়কেরা তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বিভিন্ন সাফল্য, সমস্যা ও পরিকল্পনার কথা বলেন। সম্মেলন শুরুর আগে জুনের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে বেশ কয়েকটি নীতিনির্ধারণী চিঠি সেক্টরগুলোতে পাঠানো হয়েছিল। কয়েকজন সেক্টর অধিনায়ক চিঠি না পাওয়ায় যুদ্ধ পরিচালনার নীতিমালা নিয়ে আলোচনা হলেও তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।


সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম উল্লেখ করেন, আলোচনা ভোরবেলা শুরু হয়ে শেষ হতো রাতে। উপস্থিত সব সেক্টর কমান্ডারই তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেন।


বাংলাদেশ সরকার এই দিন মুজিবনগরে এক ঘোষণায় পাকিস্তান সরকার অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বাজারে যেসব প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও প্রাইজবন্ড ছেড়েছে, সেসব না কিনতে বাংলাদেশের জনগণকে অনুরোধ জানায়। এ ছাড়া পোস্টাল জীবন বীমার প্রিমিয়াম বাবদ অর্থও না দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।


যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর বন্দরে পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ পদ্মার আসার খবর বন্দরের ডকে শতাধিক মানুষ সকাল থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এই জাহাজের পাকিস্তানে যাওয়া বন্ধ করতে তাঁরা বিক্ষোভে অংশ নেন। ইস্ট ওয়েস্ট শিপিং এজেন্সিজের ম্যানেজার ওয়াল্টার স্পাইয়েকার বিক্ষোভকারীদের বলেন, বাল্টিমোরে পদ্মা জাহাজে কোনো সামরিক মালপত্র তোলার কথা নয়। তিনি আশ্বাস দেন, জাহাজে কোনো সামরিক সম্ভার ওঠাতে দেখা গেলে তিনি তা বিক্ষোভকারীদের দিয়ে দেবেন।


বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকার ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটির লোকেরাও। বিক্ষোভকারীদের মুখপাত্র বিল ময়ার বলেন, স্পাইয়েকারের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও পরদিন পদ্মায় গোলাগুলি ওঠানো হবে। জাহাজটির কাল এখানে পৌঁছানোর কথা।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি শরণার্থীদের আস্থার মনোভাব নিয়ে দেশে ফেরার পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য জাতিসংঘের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসলামাবাদের কর্তৃপক্ষের প্রকৃত রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই যে শুধু সে পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে বলে ভারত মনে করে, তিনি তা–ও বুঝিয়ে বলেন।


ইরানে অবস্থানকালে পাকিস্তান সরকারকে বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন বলে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি প্রচারিত একটি খবর করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না।


জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আমির আবুল আলা মওদুদী সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি ভুট্টোর ইরানে দেওয়া ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মীমাংসার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর বেআইনি ঘোষিত দলের সঙ্গে সরকারের আলোচনা করা উচিত’—এই মন্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভুট্টোর কথা বলা সংগত হয়নি। এ ছাড়া পাকিস্তান সরকারকে তিনি এমন একজনের সঙ্গে মীমাংসা করার পরামর্শ দিয়েছেন, যিনি পাকিস্তানের ঘোরতর একটি শত্রুদেশের যোগসাজশে পাকিস্তানকে খণ্ডবিখণ্ড করার চেষ্টায় তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।


ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রায় এদিন দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের সর্বত্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সতর্ক প্রহরা জোরদার করা হয়েছে। ভারতের ভূখণ্ডে যে–ই প্রবেশ করুক, তাদের রুখে দিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় বলেন, বাংলাদেশের এবং এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থায়িত্বের ওপর পাকিস্তানকে অর্থসাহায্য দেওয়ার নীতির বিপজ্জনক। তাঁরা এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে লিখিত উত্তরে তিনি জানান, ৮ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার ১৯ জন শরণার্থী ভারতে এসেছেন। এই সংখ্যাই প্রমাণ করে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়।


ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা উপমন্ত্রী অমিয়কুমার কিস্কু লোকসভায় জানান, ৪ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি বুলেট বা অস্ত্রের আঘাতে আহত ১ হাজার ১৪০ জনেরও বেশি শরণার্থীর মধ্যে ৪২ জন মারা গেছেন।

 

কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে প্রায় ৭০ জন পাকসেনা হতাহত হয়

 

মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে অনেক পাকসেনাদের বাংকার ও ঘর ধ্বংস হয়।  ফাইল ছবি

মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে অনেক পাকসেনাদের বাংকার ও ঘর ধ্বংস হয়। ফাইল ছবি

কুমিল্লায় ক্যাপ্টেন গাফফারের কোম্পানী ও ফাস্টফিল্ড রেজিমেন্ট পাকবাহিনীর মন্দভাগ বাজার ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে অনেক বাংকার ও ঘর ধ্বংস হয় এবং অন্তত ৬০/৭০ জন পাকসৈন্য হতাহত হয়। দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর মন্দভাগ বাজার ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।

রাত ৮ টায় পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর শালদা নদী ঘাঁটি আক্রমণ করে। ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানীর মেজর সালেকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ে আক্রমণ পরিত্যাগ করে। এতে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয়।

নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি সড়কে বাউসিয়া সেতু এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ডিমোলিশন পার্টির ওপর পাকবাহিনী ও রাজাকার দল অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এতে ডিমোলিশন দলের ৩ জন গেরিলা গুরুতরভাবে আহত হয়। এ সংঘর্ষে ডিমোলিশন দল আহত গেরিলাসহ নিরাপদে মুরাদনগর ঘাঁটিতে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।

সিলেটে ময়না মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল পাকবাহিনীর শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ২ জন সৈন্য নিহত হয়। পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো তেহরান থেকে কাবুল না গিয়ে আকস্মিকভাবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর মওলানা আবুল আলা মওদুদী এক বিবৃতিতে ভুট্টো উত্থাপিত পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের মধ্যে আপোষ মীমাংসার পরামর্শকে ‘রাজনৈতিক হঠকারিতা ও দুরভিসন্ধিমূলক’ বলে অভিহিত করেন।

কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ব-পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, তবে ভারতের দালালরা সেখানে সক্রিয় রয়েছে। এদের হুমকি মোকাবেলা করার জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিক আজ ঐক্যবদ্ধ।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর মিয়া তোফায়েল ঢাকা শহরে জামায়াতের এক কর্মী সমাবেশে বলেন, ২৫ মার্চের পূর্বে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের নামে যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানো হয়েছিল তা ছিল পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্যে দুশমনদের একটি সুসংগঠিত চক্রান্ত। তিনি বলেন, ‘দুশমনদের চক্রান্ত থেকে মহান সেনাবাহিনী দেশকে রক্ষা করছে। আমাদেরকেই এই অবস্থা ধরে রাখতে হবে।’