৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১০ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিচেল শার্প অটোয়ার গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রে ১০ জুলাই বলেন, পাকিস্তানকে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মনে হলেও, সেটাই বাংলাদেশ সংকটের একমাত্র সমাধানের পথ। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য কানাডা সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্পর্কে কিছু সৎ মন্তব্য চাওয়া হয়েছিল।


মিচেল শার্প বলেন, তাঁর মতে পাকিস্তানে সম্পূর্ণ নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই সর্বাপেক্ষা উত্তম সমাধান। তিনি লেখেন, জাতিসংঘের সনদের আওতার বাইরে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার আন্তর্জাতিক দায়িত্ব সম্পর্কে তাঁর দেশ সজাগ দৃষ্টি রেখেছে।


বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে ভারতীয় ক্রিকেটারদের স্বাক্ষরিত একটি ব্যাট এই দিন যুক্তরাজ্যের লিস্টারে ৭৭ স্টার্লিং পাউন্ডে বিক্রি হয়। ভারতীয় ক্রিকেট দল এখানে খেলতে এলে লর্ড বিশপের তহবিল এই র‌্যাফলটির ব্যবস্থা করে। খেলার প্রথম দিন দশর্কদের মধ্যে র‌্যাফলের টিকিট বিক্রি করেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, আবিদ আলী, বিষেণ সিং বেদী, কেনিয়া জয়ন্তীলাল ও সৈয়দ কিরমানি।


পশ্চিম পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন–এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে পত্র বিনিময়টি যুক্তরাজ্য–পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে উদ্ভূত ভুল–বোঝাবুঝির এবং তিক্ততা দূর করার একটি প্রচেষ্টা। ভারত-ব্রিটেন যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তান ও ব্রিটেনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।


পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রসের চেয়ারম্যান বিচারপতি নুরুল ইসলাম পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন দেশ সফর শেষে এই দিন ঢাকায় ফেরেন। রেডক্রসের সাহায্যের ব্যাপারে আলোচনার জন্য কয়েক দিন আগে তিনি জেনেভা যান। পরে প্যারিস, স্টকহোম, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ও লন্ডন সফর করে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালান।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদা নদী এলাকার ঝিকুরায় সুবেদার আবদুল ওহাবের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম) নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাবোঝাই একটি স্পিডবোট অ্যামবুশ করেন। এ হামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও কুমিল্লার জল্লাদ হিসেবে পরিচিত বোখারীসহ লেফটেন্যান্ট কর্নেল, মেজর ও ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন।


শালদা নদী এলাকার সাগরতলায় আরেক দল মুক্তিযোদ্ধার গুলির মুখে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নিজেদের অবস্থানে ফিরে যায়।


ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর একদল গেরিলা ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কের মোড়ে একটি টহল পুলিশের গাড়ির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়।


উত্তরাঞ্চলের নওগাঁয় একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মধইল এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অতর্কিত আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

 

শালদায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে লে. কর্ণেলসহ নিহত ১৩জন

মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হতে থাকে। ফাইল ছবি

মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হতে থাকে। ফাইল ছবি

শালদা নদী এলাকায় মঈনপুরে সুবেদার আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল পাকবাহিনীর সৈন্য বোঝাই একটি স্পীডবোটকে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২ জন লে. কর্নেল, ২ জন মেজর ৩ জন ক্যাপ্টেন, ১ জন নায়েব সুবেদার, ৩ জন সিপাই ও ১ জন অবাঙালি ব্যবসায়ী নিহত হয়। 

‘কুমিল্লার জল্লাদ’ হিসেবে পরিচিত ক্যাপ্টেন বোখারী এই আক্রমণে নিহত হয়। অ্যামবুশ দল একটি ম্যাপ (শত্রুর অবস্থান চিহ্নিত), একটি ওয়ারলেস সেট ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে। পরে পাকবাহিনী এলাকায় ঘোষণা করে, যে ব্যক্তি সুবেদার ওয়াহাবের মৃত লাশ নিয়ে আসবে তাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কৃত করা হবে।

শালদা নদীর কাছে মুক্তিবাহিনীর সাগরতলা অবস্থানের ওপর পাকহানাদার বাহিনী আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালালে হানাদার বাহিনীর ৩০/৪০ জন সৈন্য হতাহত হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির মুখে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে শালদা নদী অবস্থানে ফিরে যায়।

ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর একদল গেরিলা ধানমন্ডির ২ নং সড়কের মোড়ে পাকবাহিনীর একটি টহলদার পুলিশের গাড়ীর ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এত একজন অফিসারসহ ৫ জন পাকিস্তানি পুলিশ নিহত হয়।

নওগাঁয় মকাই চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদল মধইলে পাকবহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে ৬ জন পাকসৈন্য নিহত হয় ও মুক্তিযোদ্ধারা কিছু হালকা অস্ত্র দখল করে। নৌকমান্ডো সাব লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহর তত্ত্বাবধানে নেভাল কমান্ডো ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাইকৃত প্রথম ব্যাচের ১২০ কমান্ডো পশ্চিমবঙ্গের পলাশী ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল, কমপক্ষে ৯-১০ ঘণ্টা সাঁতার, পানির ওপরে ও নিচে সাঁতার, উপকূলে সাঁতার, অতিরিক্ত ওজন ও মাইনসহ সাঁতার, ফিনসহ ও ফিন ছাড়া সাঁতার, রাতে শব্দহীন সাঁতার, অপারেশন, কৌশল, বিস্ফোরণ প্রশিক্ষণ, গ্রেনেড ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার প্রশিক্ষণ ও নিরস্ত্রভাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ।

নয়াদিল্লীতে কানাডার পার্লামেন্টারি ৩ জনের প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশ ও শরণার্থী প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেন। এর আগে কানাডীয় পার্লামেন্টের এ তিন প্রভাবশালী সদস্য বাংলাদেশ থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া সর্বহারা শরণার্থীদের অবস্থা এবং বাংলাদেশে পাক বর্বরতার নমুনা দেখার জন্য শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে দেশে ফিরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তারা বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান’- এই নামে কোন রাষ্ট্র-রাষ্ট্রাংশের অস্তিত্ব আর নেই। বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য।  
কানাডার ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির মি. জর্জের লাচসি সাংবাদিকদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে অন্যায় কিছু করেননি। শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের পর কানাডীয় প্রতিনিধিগণ বলেন, এটা এখন পরিষ্কার যে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। তারা বলেন, এটা এই শতাব্দীর সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়।

ভেনিজুয়েলার কারাকাস থেকে প্রকাশিত খ্রিস্টিয়ান বিশ্বের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য রিলিজিয়ন’ পত্রিকায় বলা হয়, পাকিস্তানি হানাদাররা বাংলাদেশে যে নারকীয় বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছে তা দেখলে যীশুখ্রিস্ট নিজেও ভয়ে শিউরে উঠতেন।

ভারতের দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের রিপোর্টে বলা হয়, পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র চালানের প্রতিবাদে বাংলাদেশের ছাত্র এবং নারীদের একটি গ্রুপ শুক্রবার কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেট ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে করে। এদিন সন্ধ্যায় কংগ্রেস নেত্রী পূরবী মুখার্জি, পশ্চিমবঙ্গ সাংসদ গীতা মুখার্জি, বিপ্লবী রেনুকা রায়ের নেতৃত্বে কয়েক শ’ নারী মার্কিন কনস্যুলেটের সামনে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি এ বিক্ষোভের আয়োজন করে। তারা একটি স্মারকলিপি মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনের কাছে হস্তান্তর করেন যেখানে পাকিস্তানকে আর কোন অস্ত্র সহায়তা না দিতে অনুরোধ করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে একটি রাজনৈতিক সমাধানে সাহায্য করার আবেদন জানায়।

অস্ট্রেলীয় এমপি লেন এস রিড করাচী সফর শেষে ৫ দিনের এক সফরে ঢাকা এসে পৌঁছান। পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানি কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাক সেনাবাহিনীর অবস্থানসমূহ পরিদর্শন করেন। সেখানকার সামরিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় শান্তি কমিটির দালালরা নিয়াজীকে আশ্বস্ত করে যে, চট্টগ্রামে দুস্কৃতকারীদের আক্রমণের সকল স্থল ও নৌপথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দুস্কৃতকারীদের সম্পূর্ণরূপে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।