৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০২ জুলাই ১৯৭১ এই দিনে

02.07.1971

 

 

কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ

 

কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ। ফাইল ছবি

কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ। ফাইল ছবি

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ বৃটিশ টেলিভিশন রিপোর্টারদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশে একটি লোকও জীবিত থাকা পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে। বাংলাদেশ থেকে পাকসেনা খতম করে তবে থামব। নিজ পরিবার সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অন্যান্য বহু পরিবারের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আমি নিজের চোখেই দেখেছি। নিজের কথা চিন্তা করার অধিকার এখন আর আমার নেই। বাংলাদেশই আমার পরিবার।

ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা এদিনে ৬৫ লাখ ৪১ হাজার ৪শ’ ৪৬ জনে পৌঁছায়। বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা চালানোর সুযোগ করে দেয়ার প্রতিবাদে পাকিস্তান কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।

মো. হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল কুমিল্লার লাটুমুড়ায় পাকহাদারদের অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ১২ জন সৈন্য নিহত ও ৪ জন আহত হয়। জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি পুলিশ ও রেঞ্জারদের অবস্থান মতলব থানা আক্রমণ করে। এতে ৫ জন পুলিশ নিহত ও ৭ জন আহত হয়। অপরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন।

সুনামগঞ্জ শহরের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকবাহিনীর একটি টহলদার দলের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর এই অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনাদের পুরো দল নিশ্চিহ্ন হয়।

সিনেটর চার্লস এ্যাথিয়ান ও সিনেটর বেডফোর্ড মোর্সে পাকিস্তানে নতুন করে সমরাস্ত্র সরবরাহের লাইসেন্স প্রদান বন্ধ এবং মঞ্জুরীকৃত লাইসেন্স বাতিল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উভয় পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পাকিস্তান সরকার বাণিজ্য সংক্রান্ত ছাড়া সব ধরনের বেসরকারী পর্যায়ের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করে দেয়।

সিরিয়া ও গাম্বিয়া পাকিস্তানের অখন্ডতার স্বপক্ষে তাদের পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করে। তাহরিক-ই-ইশতেকলাল পার্টি প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সপ্তাহব্যাপী সফর শেষে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বলেন, পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য আগামী তিনমাস সঙ্কটপূর্ণ। সরকারকে জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়া মিটিয়ে দিতে হবে। কে সরকার গঠন করবে তা বড় সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে আদৌ কোনো সরকার গঠন করা যাবে কিনা এবং দেশের গণতন্ত্র টিকবে কিনা।

আখাউড়ায় স্বাধীনতা বিরোধীদের এক সভায় জামায়াত নেতা আব্দুল খালেক বলেন, “তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা দুষ্কৃতকারীরা দেশকে ধ্বংস করতে চায়। এরা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুস্তানের প্রচারণা ও কুমতলব মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ এনেছে।”

কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকার আমির তেহেরি এসময়ে বাংলাদেশে সপ্তাহব্যাপী সফর করেন, সফরকালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গবর্নর ও পাকবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সাক্ষাৎকার নেন। আমির লিখছেন, তিনি (টিক্কা খান) সেনাবাহিনীর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চরম পর্যায়ে চলছিল তখন ঢাকায় আসেন। তিনি বিস্তৃতভাবে হাসেন, সামান্য স্নায়ুবিক উত্তেজনা আছে এবং তীব্র বেগে কথা বলেন। তিনি ঢাকার কেন্দ্রে তার প্রাসাদে আমাদের গ্রহণ করলেন। আমি প্রশ্ন করার পরে টিক্কা খান জবাবে বলেন, “আমি এখানে ঘটনা চরম আকার ধারণ করার পরে এসেছি। আমাকে দুটি জিনিস করতে বলা হয়েছে: প্রথমত, সেনাবাহিনীর ঐক্য ধরে রাখা এবং দ্বিতীয়ত মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আরও আলোচনার জন্য দরজা খোলা রাখা। 

রাষ্ট্রপতি আমাকে পরিষ্কার বলেছেন যে, কোনো পরিস্থিতিতেই যেন আমি আলোচনার সব সম্ভাবনা বন্ধ না করে দেই। কিন্তু এটা আমার বুঝতে সময় লাগেনি যে, মুজিব দেশভাগের জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে গেছেন। তার দল এবং বন্ধুরা সেই পথেই এগোচ্ছিল। তা সত্ত্বেও, আমি শেষ মুহূর্তের আগে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেইনি। আমরা সবাই চেয়েছি একটি সুরাহা হোক। নির্বাচনী প্রচারণার সময়, মুজিব প্রকাশ্যে এবং বেসরকারীভাবে বলেছিল যে, ছয় দফা কর্মসূচী নির্বাচনের পরে বোঝাপড়া করে নেয়া যাবে। ওই পদক্ষেপে দেশ মূলত আলাদাই হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও আমরা মুজিবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেইনি। পরে দুটি নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে মুজিব প্রকাশ্যে বলেছে যে, ছয় দফার সঙ্গে কোনো আপোস হবে না। এটা বলে সে চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারপর তিনি একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করলেন যখন আমরা এখানে আছি।

তিনি ঢাকায় ন্যাশনাল ব্যাংক বন্ধ করলেন এবং তার দায়িত্ব অন্য একটি ব্যাংক-কে দিলেন। তিনি পাকিস্তানি ব্যাংক নোট স্ট্যাম্পড করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলে দেন যে, তিনি জাতীয় পরিষদে যোগ দেবেন না, যদি সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা থাকেন। তিনি দুটি পরিষদ চাইলেন। উপরন্তু, তিনি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করতে থাকেন এবং বলেন, তিনি আমাদের সবার বিচার করবেন। তার এজেন্ট এর মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্য ও অফিসারদের বলেন সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ ত্যাগ করতে। যেহেতু তিনি একটি নিজের প্যারামিলিটারি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। 

বরাবর আমরা আশা করেছি যে, তিনি বুঝতে পারবেন যে সেনাবাহিনী তাকে পাকিস্তান বিভক্ত করার অনুমতি দেবে না। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্কল্পকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি প্রেস, রেডিও এবং পূর্ব পাকিস্তানের টেলিভিশনকে বলেছিলেন পাকিস্তানের কোনো সংবাদ সম্প্রচার না করতে এবং আমরা যে তথ্যই দেই না কেন সেগুলো প্রচার না করতে। তারপর সব সরকারি ভবন ও ব্যাংক থেকে পাকিস্তানী পতাকা সরানোর আদেশ দেন। একটি অনুষ্ঠানে তার সমর্থকরা পাকিস্তানি পতাকা এবং জিন্নাহর সব ছবি পুড়িয়ে ফেলে। আপনি কল্পনা করতে পারছেন যে, আমাদের ধৈর্যের সীমা ছিল না। যখন পাকিস্তান দিবস আসল মুজিব ও তার সমর্থকরা তাকে ‘বাংলাদেশ দিবস’ বলল।”