৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৫ জুন ১৯৭১ এই দিনে

এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) মহাসচিব টুংকু আবদুল রহমানকে এক তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে ওআইসিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ধর্মের নামে বাংলাদেশে পাকিস্তান যে নারকীয় কায়দায় গণহত্যা চালাচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি লুটপাট করে পুড়িয়ে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে তার চরম পৈশাচিক ও বর্বরতা। ওআইসির উচিত পাকিস্তানের এমন ঘৃণ্য কার্যক্রমের প্রতিবাদ করা। ওআইসি যদি ইসলামী নীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবতায় বিশ্বাস করে তবে ওআইসি নিঃসন্দেহে এই নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ জানাবে।’

এর আগে সৌদি আরবের জেদ্দায় ২২ ইসলামী দেশের সমন্বয়ে গঠিত ওআইসির সম্মেলনে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির প্রতি সমর্থন জানানো হয়।

২৫ জুন দিল্লিতে ‘পূর্ব বাংলায় চলমান জটিলতা ও সমাধান; শীর্ষক তিন দিনব্যাপী বৈঠক ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বৈঠকের প্রথম দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উদ্বোধন করেন। পরে ইন্দিরা গান্ধী ৫০ জন উর্দু পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী সম্পাদকদের বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও আদৌ কোনো লাভ হবে না। আমাদের বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হচ্ছে। এখানে তো কেবল কিছু মানুষের ভাগ্য জড়িত নয়, বরং একটি গোটা দেশের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। আমরা ইতিমধ্যে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে চেষ্টা চালিয়ে গেছি। আমাদের বেশ কজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও ভারত সরকারের দূতেরা সম্প্রতি বিশ্বের বহু দেশ সফর করেছে। নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করেছে। এই মুহূর্তে আমরা রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা হোক তা চাই। পূর্ব বাংলা থেকে আগত ৬০ লাখের বেশি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। ভারতের সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত ত্যাগ স্বীকার করে যেতে হচ্ছে। আমরা আশাবাদী শিগগির পূর্ব বাংলায় এই নৃশংসতার অবসান ঘটবে।

এসময় সম্পাদকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন ইন্দিরা গান্ধী। এক সম্পাদকের ‘পাকিস্তান দাবী করছে, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তার জন্য ভারত দায়ী!’ প্রশ্নের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন ‘বাংলাদেশের এই অবস্থার জন্য মূলত পাকিস্তান সরকারের ভ্রান্ত নীতি ও তাদের গণহত্যা ও নিপীড়নই দায়ী।

২৫ জুন ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধি দলের চার সদস্য চুয়াডাঙ্গার বেশ কয়েকটি স্থান পরিদর্শন করেন। এদিন সকালে তারা এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ চিনি কারখানা কেরু এন্ড কোং পরিদর্শন করেন।

ঢাকায় এদিন

২৫ জুন পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন জানায় , ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া মানুষদের বরণ করতে পাকিস্তান সরকার প্রস্তুত আছে। ভারত সীমান্তের কাছে শরণার্থীদের বরণ করে নিতে এর মধ্যে ২৩টি অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়েছে।

ভারতে এদিন

২৫ জুন দিল্লিতে কংগ্রেসের সংসদীয় দলের বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, ‘ভারত দিনের পর দিন পূর্ব বাংলার মানুষের দুর্দশা দেখছে। বর্তমানে সীমান্তের নিরাপত্তার অবস্থাও শোচনীয়। ভারতের অর্থনীতি ধসের মুখে পড়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার বিষয়ে ভারত কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।’

২৫ জুন কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব শেহাবউদ্দিন দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চিফ সেক্রেটারি ডোনাল্ড এক্সহার্টকে এক স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে বাংলাদেশ দূতাবসের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার বিষয়ে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হয়।

২৫ জুন এস কে সাদবাতি ও ভাই মহাবীরের নেতৃত্বে জনসংঘের কর্মীরা দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভ শেষে তারা মার্কিন দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

২৫ জুন লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বন্ধে ছাত্র শিক্ষকদের এক প্রতিবাদী সমাবেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক বলেন, ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর শুধু আজ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে তা নয়। তারা গোটা বাংলাদেশে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বর্বরতা চালিয়েছে। গত ২৩ বছর শোষণ করে বাংলাদেশের সমস্ত সম্পত্তি পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করেছে। বাংলার সমস্ত প্রান্তে তারা আজ বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বিশ্বের সমস্ত মানবিক মানুষের কাছে আবেদন জানাই, আপনারা বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন।’

আন্তর্জাতিক মহলে বিবৃতি

২৫ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, পাকিস্তানকে দেওয়া মার্কিন সামরিক সহায়তার দুটো লাইসেন্স মঞ্জুর করা হলেও এখন তা বাতিল করা হয়েছে। গত ৩১ মার্চ একটি লাইসেন্স মঞ্জুর করা হয়েছিল। অপরটি মঞ্জুর হয়েছিল গত ৬ এপ্রিল।

২৫ জুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে দেখা করেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান। এসময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারকে বলেন, ‘শরণার্থীদের জন্য মার্কিন সরকার ভারতকে মোট সাত কোটি ডলার সাহায্য বাড়াবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থীদের জন্য ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার মঞ্জুর করেছিল।

২৫ পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী উইলি সপ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য ভারতকে আরও অতিরিক্ত ৬০ লাখ মার্ক মূল্যের সাহায্য সামগ্রী সরবরাহ করবে পূর্ব জার্মানি।

২৫ জুন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত অস্ট্রিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি। এসময় অস্ট্রিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন অস্ট্রিয়া সরকার পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য ১ লাখ ডলার সহায়তা করবে।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৫ জুন টাঙ্গাইলের নাগরপুরে লাবিবুর রহমান ও সরোয়ার লাল্টুর নেতৃত্বে কাদের বাহিনীর পাঁচ ও এগারো নম্বর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা নাগরপুর থানায় অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত হামলায় পুলিশরা অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ করে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা থানার বেতার যন্ত্র, অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে চলে যায়।

২৫ জুন ময়মনসিংহের ভালুকাতে পাকিস্তানী হানাদারদের সঙ্গে আফসার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক যুদ্ধ হয়। হানাদার বাহিনীর সড়ক পথে গফরগাঁও থেকে ভালুকা আসার পথে আফসার বাহিনী বাধা দিলে ভাওয়ালিয়াবাজুতে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এক টানা ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর হানাদার বাহিনীর অবস্থানে দুটো হেলিকপ্টার থেকে ধলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ছত্রীসেনা নামে। এই যুদ্ধে ৯৫ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

২৫ জুন মৌলভীবাজারে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে বিয়ানীবাজার থানা সার্কেল অফিসে

অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী নিয়ে যায়। একই দিন বিকেলে মুক্তিবাহিনী সমনবাগ চা বাগান কারখানায় ব্যাপক হামলা চালায়। এসময় ৫ রাজাকার ও ১০ প্রহরী নিহত হয়।

২৫ জুন মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ্মীপুরের বাগবাড়ি ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ হামলায় কয়েক জন হানাদার সেনা আহত হয়।

 

শেখ মুজিবুর রহমান

শেখ মুজিবুর রহমান

মুক্তিযোদ্ধারা লাবিবুর রহমান ও সরোয়ার লালটুর নেতৃত্বে কাদের বাহিনীর পাঁচ ও এগার নম্বর কোম্পানি নাগরপুর থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ঝটিকা আক্রমণের মুখে পুলিশরা আত্মসমর্পণ করে। এতে থানার বেতার যন্ত্র, অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে।

ময়মনসিংহে ভালুকার ভাওয়ালীরা বাজুরঘাটে আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর একটানা বিয়াল্লিশ ঘন্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১২৫ জন সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা আফসার উদ্দিনকে ‘মেজর’ উপাধি প্রদান করে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মতিন মর্টারের সাহায্যে পাকসেনাদের লক্ষীপুরের বাগবাড়ি ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ আক্রমণে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। মৌলভীবাজারে মুক্তিযোদ্ধারা হ্যান্ড গ্রেনেডের সাহায্যে বিয়ানীবাজার থানা সার্কেল অফিস আক্রমণ করে। সফল আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে ফিরে আসে।

মৌলভীবাজারে মুক্তিবাহিনী সমনবাগ চা বাগানের কারখানা আক্রমণ করে। এতে ১০ জন প্রহরী ও হানাদার বাহিনীর ৫ জন দালার নিহত হয়। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জেদ্দায় ইসলামী সম্মেলন সংস্থার মহাসচিব টেংকু আবদুর রহমানের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ২২ জাতি ইসলামী সম্মেলনে পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় বক্তৃতাকালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী প্রেরণের আহ্বান জানান।

মুসলিম লীগ প্রধান আব্দুল কাইয়ুম খান দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলেন, “দেশ এক গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই দ্বিধাবিভক্ত মুসলিম লীগকে এক পতাকাতলে সমবেত হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।” কাইয়ুম খান আরো বলেন, “বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকরা বিচ্ছিন্নতাবাদী মুজিবকে পাকিস্তানের সংহতি নষ্টকারী আন্দোলনে সহায়তা করছে।”

 

আফসার বাহিনীর প্রতিরোধযুদ্ধ ॥ ২৫ জুন, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৫ জুন দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিন মুক্তিযোদ্ধারা লাবিবুর রহমান ও সরোয়ার লাল্টুর নেতৃত্বে কাদের বাহিনীর পাঁচ ও এগারো নম্বর কোম্পানি নাগরপুর থানার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ঝটিকা আক্রমণের মুখে পুলিশরা আত্মসমর্পণ করে। এতে থানার বেতার যন্ত্র, অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে। ভালুকা থানার রাজৈ গ্রামের আওয়ামী লীগের কর্মী মোঃ আবদুল হামিদ মিঞার কাছ থেকে একটি রাইফেল ও ৩১ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করেছিলেন আফসার উদ্দিন। মাত্র একটি অস্ত্র নিয়ে ‘আফসার বাহিনী’র পথচলা। প্রতিরোধের শপথ। দেশ মাতৃকার টানে একের পর এক ‘আফসার বাহিনীতে যোগ দিতে থাকেন মুক্তিকামী মানুষ। অল্প সময়ের মধ্যেই সাড়ে চার হাজার অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধার এক বিরাট বাহিনী গড়ে ওঠে। মূলত ২৫০ কোম্পানির সমন্বয়ে বাহিনী গঠন হয়। একে একে ১৫০ যুদ্ধে অংশ নেয় এই বাহিনী। বাহিনী প্রধান আফসার ৭৫ যুদ্ধে অংশ নেন। এ বাহিনীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল একাত্তরের এই দিন। সেদিন ময়মনসিংহের ভালুকার ভাওয়ালীয়া বাজুরঘাটে আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর একটানা বিয়াল্লিশ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১২৫ জন সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা আফসার উদ্দিনকে ‘মেজর’ উপাধি প্রদান করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মতিন মর্টারের সাহায্যে পাকসেনাদের লক্ষ্মীপুরের বাগবাড়ি ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ আক্রমণে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। মৌলভীবাজারে মুক্তিযোদ্ধারা হ্যান্ড গ্রেনেডের সাহায্যে বিয়ানীবাজার থানা সার্কেল অফিস আক্রমণ করে। সফল আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। মৌলভীবাজারে মুক্তিবাহিনী সমনবাগ চা বাগানের কারখানা আক্রমণ করে। এতে ১০ জন প্রহরী ও হানাদার বাহিনীর ৫ জন দালাল নিহত হয়। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জেদ্দায় ইসলামী সম্মেলন সংস্থার মহাসচিব টেংকু আবদুর রহমানের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ২২ জাতি ইসলামী সম্মেলনে পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক অখ-তা রক্ষার প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় বক্তৃতাকালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী প্রেরণের আহ্বান জানান। মুসলিম লীগ প্রধান আব্দুল কাইয়ূম খান দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশ এক গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই দ্বিধাবিভক্ত মুসলিম লীগকে এক পতাকাতলে সমবেত হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ স্বাধীন বাংলা বেতারের বরাতে জয়বাংলার ১ম বর্ষ ৭ম সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যে বর্বরোচিত ও সুপরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে তারই অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাদের সমর্থকদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এই নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ পিতামাতাও রেহাই পায়নি। গত সাতদিন চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে প্রায় ১৫০ জন পাক হানাদার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে এবং বহু স্থান থেকে পাকসেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জানিয়েছে। সমগ্র পূর্ব রণাঙ্গনে গেরিলাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজারে বহু পাকসেনা হতাহত হয়েছে। এদিকে মর্টার ও মেশিনগানসহ আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ২০০ জন পাকসেনাকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা গত ১৯ জুন সিলেট সেক্টরে একটি এলাকায় পাক-হানাদারদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে ১৩ জন পাকসেনা খতম করেন এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৩ জন পাকসেনাকে আটক করেছেন। এর আগেরদিন প্রচ- সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী সিলেটের কয়েকটি স্থানে আক্রমণ চালিয়ে ২২তম রেজিমেন্টের একজন সৈন্যকে আটক করেছেন। মুক্তিবাহিনী রংপুরে বজরাপাড়ায় পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের নাজেহাল করে ছেড়েছেন। এই আক্রমণে অনেক খানসেনা হতাহত হয়েছে। সেই দিনই পাকসেনারা মৃত সৈন্যদের লাশ ও আহত সৈন্যদের নওগাঁয় নিয়ে যায়। এই আক্রমণে একজন অফিসারসহ দুজন পাকসেনাকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা গ্রেফতার করেছেন। কয়েকদিন আগে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা ঠাকুরগাঁওয়ের কাছে মর্টার ও মেশিনগান থেকে মুক্তি ছাউনির ওপর আচমকা গুলি চালায়। গত দুই সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে অধিকসংখ্যক গাড়ি ও সৈন্য নিয়ে পাকসেনাদের চলাফেরা করতে দেখা যায়। কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে মেহেরপুর এলাকায় এক দুঃসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী কমপক্ষে ৩০ জন পাকসেনাকে খতম করেছেন, সেখানকার কুতুবপুরে মুক্তিবাহিনী খানসেনাদের ওপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ১০ জন খানসেনাকে হত্যা করেন। .... হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের খবরে বলা হয়েছে, ভারতীয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ আজ এক বার্তায় সতর্ক করে বলেন, যদি পূর্ববাংলার রাজনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান না হয় তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। সিঙ্গাপুরে এক প্রেস কনফারেন্সে তিনি বলেন, বড় শক্তিধর দেশগুলোর উচিত পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা এড়ানোর জন্য সেখানে রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে চাপ দেয়া। তিনি বলেন- জেলে থাকা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের উচিত রহমান সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় বসা।