৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৪ জুন ১৯৭১ এই দিনে

পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহতভাবে চলছিল। একাত্তরের এদিন দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি দেন বিক্ষোভকারীরা। এতে বলা হয়, অস্ত্র সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানকে উৎসাহিত করছে।


ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শরণার্থীবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ এদিন বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বয়রায় শরণার্থীশিবির দেখতে যান। এ সময় শরণার্থীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্যের প্রতিবাদে আটটি স্থানে তাঁর বিরুদ্ধে এমন বিক্ষোভ হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ফ্রাংক এল কেলাগকে একটি স্মারকলিপি দেন।

স্মারকলিপিতে যুক্তরাষ্ট্রের দুমুখো নীতি বন্ধ করে একটি সঠিক ভূমিকা নেওয়া এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র উপঢৌকন বন্ধ রাখার দাবি জানানো হয়।


ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এদিন সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ভারতের পূর্ব সীমান্তের ঘটনাবলি উল্লেখ করে বলেন, ভারত বিরাট এক সংকট ও বিপজ্জনক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছে। এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্য জোরদার করতে তিনি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আবেদন জানান।


ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এদিন সংসদের দুই কক্ষে (রাজ্যসভা ও লোকসভা) বলেন, মার্কিন অস্ত্রবোঝাই পাকিস্তানগামী জাহাজ দুটিকে মাঝদরিয়ায় থামানোর জন্য ভারত সরকার মার্কিন সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। তিনি জানান, পাকিস্তানকে আর অস্ত্র না দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিশ্রুতি চাওয়া হয়েছে। রাজ্যসভায় দাবি ওঠে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের অস্ত্র ও সেনা পাঠানো বন্ধ করতে নৌ ও বিমান অবরোধের।সাংসদদের এই দাবির ব্যাপারে সরদার শরণ সিং বলেন, ‘এর অর্থ যুদ্ধের কিনারে পৌঁছে যাওয়া। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে বলেছি জাহাজ থামাতে।’

 

ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিকবিষয়ক কমিটি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফরের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে এদিন আবার আলোচনা করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং মন্ত্রিসভায় সহকর্মীদের বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিষয় অবহিত করেন। এ ছাড়া পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সাহায্যের বিষয়টিও পর্যালোচনা করা হয়।


যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে স্বীকার করেন, তিনটি পাকিস্তানি জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিইউয়র্ক থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। সুন্দরবন ও পদ্মা নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানে যাত্রা করেছে বলে নিউইয়র্ক টাইমস যে খবর প্রকাশ করে, পররাষ্ট্র দপ্তর তার সত্যতা স্বীকার করে। অস্ত্রবোঝাই তৃতীয় জাহাজটির নাম কাউখালী। এই জাহাজ ৩ এপ্রিল নিউইয়র্ক ছাড়ে। চার্লস ব্রে আরও বলেন, ২৬ মার্চ পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহের সব লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে কয়েক দিন লেগে যায়। তাই তিনি বলতে পারছেন না, এই লাইসেন্স দিয়েই অস্ত্র জাহাজে বোঝাই করা হয়েছে কি না।


মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফোর্ট জিল ও বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার পরিষদের মহাসচিব ড. রিচার্ডো মলিনা মার্টি এদিন পৃথক বিবৃতিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য বিশ্বশক্তির প্রতি আহ্বান জানান।


ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আববা ইবান এদিন দেশটির পার্লামেন্টে (নেসেট) বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার নীতির দরুন পূর্ব বাংলা থেকে যাঁরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, ইসরায়েল তাঁদের জন্য ভারতকে সাহায্য করতে চায়। বাংলাদেশের ব্যাপারে এই প্রথম ইসরায়েল সরকারিভাবে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করল। শরণার্থীদের জন্য ইসরায়েলের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে ইবান বলেন, বিশেষজ্ঞ, ওষুধপথ্য ও সমাজসেবীদের পাঠিয়ে ইসরায়েল ভারতকে সাহায্য করতে আগ্রহী।


রাওয়ালপিন্ডিতে সরকারিভাবে এদিন জানানো হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ২৮ জুন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এর পরপরই তাঁর ভাষণের বাংলা অনুবাদ প্রচারিত হবে।


পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মুফতি মাসুদ ও পশ্চিম পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক গউস হাজারভি এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও ১৪ জুন দেখা করেছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আরও কয়েকজন রাজনীতিক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন।


পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এদিন জানান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আক্রমণাত্মক নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণের ফলে এই উপমহাদেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রতি যে ক্রমবর্ধমান হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, পাকিস্তান সে সম্পর্কে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ বিশ্বনেতাদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে।


ব্রিটেনের চার সদস্যের সংসদীয় প্রতিনিধিদল চার দিনের সফরে এদিন করাচি থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছায়। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা হলেন আর্থার বটমলি, রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস, জেমস র‌্যামসডেল ও টবি হেসেল। তাঁরা ঢাকায় পৌঁছে পূর্ব পাকিস্তানের (অবরুদ্ধ বাংলাদেশ) সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে বৈঠক করেন।


পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দল এদিন মর্টার, মেশিনগান ও কামানের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর মন্দভাগ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে তাদের সালদা নদীর মূল ঘাঁটিতে চলে যায়।


মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এদিন কুমিল্লার পূর্বে বিবিরবাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কসবার উত্তরে লাতুমুড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। দুই অভিযানে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষতি হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।


ভারতের জলপাইগুড়ির মূর্তি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দল এদিন বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের থুকরাবাড়ি, চাউলহাটি, সোনারহাট ও হেমকুমারী এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রতিটি দলের সদস্যসংখ্যা ছিলেন ৯০। এখান থেকে তাঁরা শুরু করেন পরবর্তী গেরিলা যুদ্ধাভিযান।