৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৩ জুন ১৯৭১ এই দিনে

এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা সমঝোতায় আসতে চান ভালো কথা। আমরাও রাজনৈতিক সমাধান আসুক তা চাই। পূর্ববঙ্গে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য রাজনৈতিক সমাধানের বিকল্প নেই। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববঙ্গের জাতীয় নেতা। পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা চাইলে আগে শেখ মুজিবের সঙ্গেই আলোচনা করতে হবে। আগে তার মুক্তির বিষয়ে পাকিস্তানকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সমঝোতা হলে তবেই ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।’

২২ জুন নিউইয়র্ক টাইমসে ‘পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র প্রেরণ’ শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ প্রতিনিধি ট্যাড সুলচের বিশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। ২৩ জুন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পাঠানো এক তারবার্তায় বলেন, ‘পাকিস্তানে জাহাজভর্তি অস্ত্র পাঠানোতে আমরা মর্মাহত। যুক্তরাষ্ট্র কী দেখছে না বাংলাদেশে কীভাবে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এখনো যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিয়েই যাচ্ছে।’ 

আন্তর্জাতিক মহলে বিবৃতি

২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট পার্টির সিনেটর স্টুয়ার্ড সিমিংটন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পাকিস্তানে দুই জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো পুরোপুরি অবৈধ ও মানবতাবিরোধী। এর দায়ভার অবশ্যই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ওপর বর্তায়। পাকিস্তানকে সামরিক অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে তারা সিনেটকে একবারের জন্যও অবহিত করেননি। এই অস্ত্র পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষদের ওপরেই ব্যবহৃত হবে, এটা তো দিবা সত্যের মতোই।’  

২৩ জুন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যালেক ডগলাস হিউম ব্রিটিশ কমন্স সভায় বলেন, ‘পাকিস্তানে কোনোরূপ রাজনৈতিক সমাধান না আসা পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া সমস্ত ব্রিটিশ অনুদান বন্ধ থাকবে। পুরনো প্রকল্পগুলোর জন্য ব্রিটিশ অনুদান অব্যাহত থাকবে, তবে সেখানে কোনো রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে সাহায্য দান বন্ধ থাকবে।’

২৩ জুন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের নিজ নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য সর্বপ্রথম দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমাধান। আমি ভারত ও পাকিস্তান সফর করেছি। দুই পক্ষই এখন সমাধান প্রত্যাশী। 

২৩ জুন পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী পাকিস্তান সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে মাসব্যাপী বিদেশ সফর শুরু করেন।

ভারতে এদিন

২৩ জুন দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত গলেন স্টোনকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জরুরি ভিত্তিতে দু’দফা তলব করা হয়। এসময় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল ও যুগ্ম-সচিব নরেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। এসময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে কড়া বার্তা দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের পরিণাম ভয়াবহ হবে। এমনিতেই ভারত প্রায় ৬০ লাখ শরণার্থী নিয়ে বিপাকে আছে। পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চলমান। তার ওপর এই অস্ত্র সরবরাহ বিপদ আরও বাড়াবে।’

২৩ জুন ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। এসময় তিনি সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের একটি চিঠি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তুলে দেন। এর আগে, সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউলের সঙ্গে দেখা করে বলেন, পাকিস্তানের অবস্থা যাই হোক না কেন, ভারত সরকারের সঙ্গে সবসময় আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। 

২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শরণার্থীবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগের সঙ্গে দেখা করেন ভারতের পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর। এসময় নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা সংবাদের প্রসঙ্গও উঠে আসে। ভারতের পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ত্র সরবরাহের জন্য হতাশা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে, বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ বলেন, ‘কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদ সঠিক নয়।’

২৩ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ আর মল্লিক কলকাতায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নৈতিক সমর্থন দানের জন্য ভারতীয় জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভারতবাসীদের এই অবদান চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।’

২৩ জুন ভারতের দৈনিক যুগান্তরে ‘মুক্তিফৌজের ভয়ে পাকসৈন্য সদা-সন্ত্রস্ত’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন খণ্ডে মুক্তিফৗজের গেরিলা বাহিনীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর টহলদার দলগুলো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মুক্তিফৗজ কমান্ডের জনৈক উচ্চপদস্থ অফিসার বলেছেন, মুক্তিফৗজ যেকোনো মুহূর্তে আচমকা আক্রমণ চালাতে পারে বলে মনে করে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজকাল যতদূর সম্ভব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করছে। মুক্তিফৗজ যাতে চিনতে না পারে, সেজন্য পাকসৈন্যরা সময় সময় অসামরিক ব্যক্তির ছদ্মবেশে চলাফেরা করে থাকে। সৈন্যবাহিনী যখন সৈন্য ও সরবরাহ নিয়ে নদী পারাপারের জন্য বোট ব্যবহার করে, তখন গেরিলাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নদী ও খালের উভয় তীরে রক্ষী মোতায়েনের ব্যবস্থা করে।’

২৩ জুন দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং গতকাল সন্ধ্যায় এখানে বলেন, গত এক পক্ষকাল হতে যে কয়েকটি দেশ তিনি সফর করেছেন, সেই কয়েকটি দেশের সরকার পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ করার কথা বিবেচনা করছে। দুটি কারণে কয়েকটি রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের কথা বিবেচনা করছে। পাকিস্তান নিজের দোষে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি করেছে, এই অবস্থায় সাহায্যদান সেখানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত: এই রাষ্ট্রগুলো মনে করে যে, বর্তমানে সাহায্য প্রদান করলে সংখ্যালঘু প্রশাসন সেই সাহায্য সংখ্যাগুরুকে দমনের কাজে লাগাবে। বর্তমান পরিস্থিতির ওপর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইয়াহিয়া খান ২২ মে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, এরপরও ২০ লাখ উদ্বাস্তু ভারতে এসেছে। এ থেকে বোঝা যায়, যে পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুরা বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে এসেছে, সেই পরিস্থিতি এখনো বর্তমান। সেখানে এখনো আস্থার সংকট রয়েছে। সুতরাং, বর্তমান অবস্থায় যাদের হাতে বাংলাদেশের আইন ও শৃঙ্খলার ভার রয়েছে, তারা যদি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারে, তাহলেই উদ্বাস্তুদের আবার স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগের শুধু পূর্ববঙ্গেই নয়, সমগ্র পাকিস্তানেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। সুতরাং, তাদের সঙ্গেই একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে হবে, যাতে জনগণের প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করতে পারেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে একটা মীমাংসায় পৌঁছতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বহির্বিশ্বের কর্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানের ওপর সম্ভাব্য সর্বপ্রকার চাপ সৃষ্টি করা। পাকিস্তান সরকারকে সুস্পষ্টভাবে বলা যে, বাংলাদেশে অত্যাচার চালানোর অর্থই জনগণের অধিকারের ওপর অত্যাচার এবং এই অত্যাচার বন্ধ করতে হবে।’

পাকিস্তানে এদিন

২৩ জুন পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য পিপিপি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে কতিপয় সুপারিশপত্র আমরা পেশ করেছি। আশাকরি- প্রেসিডেন্ট বিষয়টি ভেবে দেখবেন।’

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৩ জুন কুমিল্লায় হানাদার সেনাদের চতুর্দিক থেকে এ্যামবুশ করার জন্য চতুর্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানির তিনটি প্লাটুন ইয়াকুবপুর, কুয়াপাইনা এবং খৈনলে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি টহলদার দল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কাছাকাছি এলে মুক্তিযোদ্ধারা সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে আট জন হানাদার সেনা নিহত ও তিন জন আহত হয়।

২৩ জুন মাদারীপুরের নড়িয়ায় দক্ষিণপূর্ব এবং পশ্চিম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয়। আক্রমণ করার পূর্বে শত্রু বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বলা হয়। কিন্তু, তারা আত্মসমর্পণ না করে পাল্টা গুলি ছুড়ে। এসময় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে হানাদার সেনা ও রাজাকারসহ সাত-আট জন নিহত হয়। এখানে সাতটি রাইফেলসহ ৩৫০ রাউন্ড গুলি মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়।

২৩ জুন কুমিল্লায় আপানিয়াপুলে কয়েকজন দালালসহ দুজন হানাদার সেনার ওপর মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সুবেদার শামসুল হক ও হাবিলদার মন্তাজ আক্রমণ চালায়। এসময় দুই হানাদার সেনা নিহত হয় ও দালালরা পালিয়ে যায়।

২৩ জুন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার মহিষকুন্ডিতে এক কোম্পানি হানাদার সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় ২০ জন পাকিস্তানী হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।