৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২১ জুন ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২১ জুন গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী এম এনসুর আলী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘আমাদের এ সংগ্রাম সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। এ ছয় দফাই আমাদের মুক্তির একমাত্র সনদ।’

ঢাকায় এদিন

২১ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান এক সফরে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। সেদিন সন্ধ্যায় সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার কথা তার।

ঢাকা সফররত চার সদস্যের ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের নেতা জিল নাইট বলেন, ‘ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রতিনিয়ত পাকিস্তানের অত্যাচারের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু, সেখানে এ ধরনের কোনো ঘটনার সাক্ষী আমরা হতে পারিনি।’

পাকিস্তানে এদিন

২১ জুন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম লাহোরে জামায়াত কর্মীদের এক সভায় বলেন, ‘পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া আর কোনো বিকল্প সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের হাতে ছিল না। বেআইনি আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক গোলযোগ ১৮৫৭ সালে সংগঠিত বাংলার বিদ্রোহ-আন্দোলনের চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালি ছিল। এখন সেনাবাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই দেশের অবস্থা স্বাভাবিক আছে। এখনো আওয়ামীলীগ ভারতের সহায়তায় দেশের মধ্যে অস্থিরতা ও গোলযোগ চালিয়েই যাচ্ছে। সেনাবাহিনী তা নির্মূলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

ভারতে এদিন

২১ জুন রাজ্যসভায় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে দেওয়ায় রাজ্যসভায় তুমুল বিতর্ক হয়। রাজ্যসভার অনেক সদস্য প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

অনেকে বলেন, শরণার্থী শিবিরের এ পরিস্থিতিতে তাকে কোনোভাবেই শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে দেওয়া ঠিক হয়নি। এতে ভারতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সমালোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ভারত সরকারের মন্ত্রীরাও ছিলেন।

ভারতের শ্রমমন্ত্রী আর কে খাদিলকর রাজ্যসভায় তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও বিবৃতিকে পক্ষপাতমূলক মনে করছি। কারণ তিনি বাস্তব অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পরও তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ভারত সফরের আগে তিনি পাকিস্তান সফর করেছেন। সেখানে তিনি প্রভাবান্বিত হয়েছেন কি না তা দেখার বিষয়। আমরা জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি মিস্টার সমর সেনের কাছে আমাদের একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।’

২১ জুন ভারতের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেশ পাল সিং লোকসভায় বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বন্ধে এবং পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ভারত সরকার কার্যকর নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের আজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে। ভারত সরকার বিভিন্ন দেশে দূত পাঠিয়েছে। দূতরা আন্তর্জাতিক মহলে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি তুলে ধরছেন এবং বিভিন্ন দেশকে অনুরোধ করছেন, তারা যেন তাদের প্রতিনিধি দল পাঠায়। ভারত সরকারের বিশেষ দূতরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা ও মুক্তির বিষয়ে কথা বলছেন।’

শেখ মুজিবুর রহমান শিগগিরই মুক্তি পাবেন আশা প্রকাশ করেন সুরেশ পাল সিং।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের শরণার্থীবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফ্রাংক এল কেলাগ পূর্ব বাংলার শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে মার্কিন সরকারকে ওয়াকিবহাল করার জন্য এবং শরণার্থী শিবির স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণের জন্য ২১ জুন ভারতে আসেন।

এদিন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মার্কিন সরকার এখনো নিরপেক্ষ অবস্থানে। তারা বিষয়টি বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দেখবে এবং তারপর সিদ্ধান্ত নেবে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের কারণে যে শুধু ভারত সরকারই বিপদে পড়েছে তা নয়, এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। অন্যদিকে দেশত্যাগ করা শরণার্থীদের কীভাবে স্বদেশে ফেরানো যায় তা নিয়েও আমরা আলোচনা করব।’

বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিবৃতি

২১ জুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এড ওয়ার্ড হিথি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার ডগলাস হোমের সঙ্গে পৃথক দুটি বৈঠক করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং। 

তিনি এ সময় পূর্ববঙ্গে চলমান গণহত্যা, নিপীড়ন ও পূর্ববঙ্গের বিষয়ে ভারতের অবস্থান জানান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘ভারত এখন শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বিপর্যয়ের মুখে আছে। এ শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কিন্তু, আমরা তো তাদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। তাই সেখানে আগে রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।’

২১ জুন সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব বঙ্গ সংকট নিরসনে নানা কার্যক্রম নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরদার শরণ সিংয়ের সম্মানে এক নৈশভোজেরও আয়োজন করে।

ওই নৈশভোজে সরদার শরণ সিং বলেন, ‘ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে সাহায্য বন্ধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। ব্রিটিশ সরকার এবং ভারত সরকার পূর্ববঙ্গে গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে একযোগে কাজ করবে।’

আলোচনা সভা ও নৈশভোজের অনুষ্ঠান শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সরদার শরণ সিং বলেন, ‘গত ১৫ দিনে আমি বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছি। সবাই এখন পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানে। পূর্ব বাংলায় এই ঘৃণ্য গণহত্যা বন্ধে এবং পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধিতে সহায়তাকারী সব দেশই এখন সহায়তা বন্ধের কথা ভাবছে বলে আমাকে জানিয়েছে। কেউ কেউ এরইমধ্যে সহায়তা বন্ধও করেছেন। পাকিস্তান সরকার গণহত্যাকে  যতই অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চালিয়ে দিক না কেনো, এটি এখন প্রকাশ্য দিবালোকের মতো। সবচেয়ে করুণ ও জঘন্য বিষয় হলো, পাকিস্তান সরকার নানা দেশ থেকে পাওয়া সামরিক সহায়তা পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর গণহত্যা চালানোর কাজে ব্যবহার করছে।’

২১ জুন জাপানের টোকিওতে জাপান ও বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তথা সাহায্যদাতাদের সংগঠন কনসোর্টিয়ামের প্রতিনিধিদলের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত কার্যকরভাবে রাজনৈতিক সমাধান হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তানকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া বন্ধ থাকবে।

এ বৈঠকের আগে কনসোর্টিয়ামের বিশেষ দূত এবং বিশ্বব্যাংকের এশিয়া বিভাগের পরিচালক পিটার কারগিলকে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ও নিপীড়নের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি তার অনুসন্ধানে উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানে আসলেই নির্বিচারে গণহত্যা চলছে।

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

২১ জুন মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার বিজয়পুর ব্রিজের ওপর হানাদার বাহিনীর দুটি গাড়িকে অ্যামবুশ করে। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আট সেনা নিহত হয় এবং দুটি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।

২১ জুন ফেনী নোয়াখালী আঞ্চলিক সড়কে বোগাদিয়া নামক স্থানে নোয়াখালী গেরিলা হেডকোয়ার্টারের একদল মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর দুটি ট্রাককে অ্যামবুশ করে। এ অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর দুটো ট্রাকই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়।

একইদিনে কুমিল্লার আখাউড়া-সিলেট রেলপথে তেলিয়াপাড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায় হানাদার বাহিনী। এ সময় ক্যাপ্টেন নাসিমের অবস্থান লক্ষ্য করে দুই ব্যাটালিয়ন, ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়ার অবস্থান লক্ষ্য করে এক ব্যাটালিয়ন এবং লেফটেন্যান্ট মোরশেদের অবস্থান লক্ষ্য করে এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি সেনা আক্রমণ চালায়। অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে।

এ ছাড়া, ২১ জুন নোয়াখালী-ফেনী সড়কের নোয়াখালীর বজরায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সেনাদের একটি টহলদার দলকে অ্যামবুশ করে মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় দুই পাকসেনা নিহত হয়। দুই জন আহত হয়।