৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২০ জুন ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২০ জুন গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন সানডে টাইমস পত্রিকা তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে বলে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে নতুন ধরনের ব্যাপক নিপীড়ন শুরু হয়েছে। পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন এখন নাগরিকদের তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হচ্ছে। মোটামুটিভাবে তিন রঙয়ে। এর মধ্যে যারা কালো তালিকায় আছে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে, ধূসর তালিকায় যারা তাদের আটক করে জেলে বন্দী করা হচ্ছে, এই তালিকায় থাকা অনেককে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলীও করা হয়েছে। এবং সাদা রঙয়ের যারা শুধু তারাই মুক্ত তথা অভিযোগ মুক্ত। যাদেরকে তাদের সন্দেহজনক মনে হচ্ছে, যাদের সঙ্গেই তাদের মতের অমিল হচ্ছে তাদেরকেই হত্যা করতে দ্বিধা করছে না তারা। কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, কুমিল্লা চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, রংপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলার মোট ৩৬ জন বাঙালি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।’

একই দিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সেও অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার দুই প্রতিবেদনেই বলেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এখন বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।

২০ জুন বিকেলে পাকিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন মর্নিং নিউজের সাবেক সহকারী সম্পাদক ও সানডে টাইমসের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস মর্নিং নিউজ পত্রিকা ও সানডে টাইমসে পাকিস্তান সরকারের নামে অবিরাম মিথ্যাচার করেছেন। যে তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই সেই তথ্যও প্রচার করছে। তার পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন গত এক মাসে বাঙালিদের হাতে এক লাখ অবাঙালি নিহত হয়েছিলেন। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস টিক্কা খানের কথা ঠিকমতো বুঝেননি। ১৭৬০০০ বাঙালি সৈন্য ও পুলিশ বিদ্রোহ করেছে। মূলত সেই বিদ্রোহ দমনের জন্যই আমাদের অস্ত্র ধরতে হয়েছে।’

ভারতে এদিন

২০ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জম্মু কাশ্মীর সফর শেষে দিল্লি ফেরার আগে কাশ্মীরের বিমানবন্দরে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় যদি পাকিস্তান গণহত্যা ও নিপীড়ন থামায় তবেই আমরা কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারি। এর আগে আমাদের পক্ষে আলোচনায় আসা সম্ভব না। আর অন্যদিকে আমাদের জন্য কোনটি সুবিধাজনক এবং মঙ্গলজনক তা ভেবেই আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবো। কে কী বলল না বললও তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।’

২০ জুন নব কংগ্রেসের সভাপতি ভি সঞ্জিবায়া ইন্দোর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘শুধু ভারত এখন স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশের কিছুই হবে না। বরং ভারত একটি ফাঁদে পড়বে। যদি বাংলাদেশ বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে পারে তবেই তা তাদের জন্য লাভজনক। এজন্যই বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের জনমত তৈরির বিকল্প নেই।

২০ জুন সফররত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী–শিক্ষাবিদ প্রতিনিধিদলের নেতা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিক দিল্লিতে বলেন, ‘পাকিস্তানের সামরিক সরকার শুধু বাংলাদেশের নয়, পাকিস্তানিদেরও শত্রু। তারা যেদিন এ কথা বুঝতে পারবে, সেদিন স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও ন্যায়ের জন্য তারাও এদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবে। তিনি বলেন, বৃহৎ শক্তিগুলো বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারে চোখ বুজে আছে। বিশ্বের জনগণ ও সরকারগুলো একদিন বুঝবে যে ন্যায় আমাদের পক্ষে।’

২০ জুন জলন্ধরে ভারতীয় নৌ বাহিনীর মহড়া ও সমাপনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, পাকিস্তান বারবার অবৈধভাবে ভারতীয় নাগরিকদের উপর হামলা চালাচ্ছে, চোরাগুপ্তা হামলা চালাচ্ছে। এই অবস্থায় নৌবাহিনীসহ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে, যেকোনো মুহূর্তে আমাদের উপর হামলা এলে আমরা সমুচিত জবাব দিতে পারি।

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের এক মন্তব্যের কয়েক দিন পরে ২০ জুন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খাঁ ভারত সীমান্তে বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর সদরুদ্দীন আগা খাঁ বলেন, ‘পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীরা দেশে ফেরার অনুকূল পরিবেশ না পাওয়া পর্যন্ত এবং সে ধরনের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত স্বদেশে ফিরবে না। আমার কাছে পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী যতক্ষণ পূর্ববঙ্গের মাটিতে থাকবে ততোক্ষণ পর্যন্ত তাদের পক্ষে নিজ ভূমিতে ও স্বদেশে ফেরা সম্ভব না।’ এর কয়েকদিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলায় যা ঘটেছে এবং ঘটে চলে চলেছে মানব ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায়, মানব ইতিহাসের পক্ষে এই কলঙ্ক কখনোই মোছা সম্ভব না।’

২০ জুন ভারতের কমিউনিস্ট নেতা নেতা জ্যোতি বসু বলেন, ‘পূর্ব বাংলার সমস্যা নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমরা যদি আক্রমণ করি তবে পাকিস্তান আমাদের উপরে নির্দ্বিধায় আক্রমণ করবে। এবং বৈশ্বিকভাবে তার ফায়দা লুটবে।’

আন্তর্জাতিক মহলে বিবৃতি

২০ জুন প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলায় পূর্ববঙ্গ থেকে লাখ লাখ মানুষ আজ সর্বস্ব হারিয়ে দেশত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী সেখানে গণহত্যা চালিয়েই যাচ্ছে। সেখানকার জীবন আজ বিপর্যয়ের মুখে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করছে, নিরীহ মানুষের বাড়িঘর লুটপাট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। অর্ধকোটির বেশি মানুষ এখন উদ্বাস্তু হয়ে পার্শ্ববর্তী ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেও মানুষের চাপে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কলেরায় মানুষ মারা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত টিকা, চিকিৎসা সরঞ্জামাদির ভীষণ অভাব।’ তিনি এসময় প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব রজার্সের প্রতি পাকিস্তানকে সব ধরনের মার্কিন সহায়তা বন্ধের আহ্বান জানান। তিনি বলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এমন পৈশাচিক আচরণের পরও মার্কিন প্রশাসন এখনো আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। এটি করুণ এক ট্রাজেডি। অনতিবিলম্বে গণহত্যা বন্ধের জন্য পাকিস্তান সরকারের উপর অতি দ্রুতই চাপ প্রয়োগ করতে হবে।’

পাকিস্তানে এদিন

২০ জুন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো কোয়েটায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের আইন শৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। ভারত বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে। দেশদ্রোহী আওয়ামী লীগ ও কথিত মুক্তিবাহিনীই এই সমস্যার মূল হোতা। তাদের বিচারের মুখোমুখি করাটা এই মুহূর্তে আবশ্যক।’

২০ পাকিস্তানের লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের আমীর গোলাম আযম বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ জানে এবং প্রকাশ্যে দেখছে পাকিস্তানের প্রশাসনে ও উঁচু পথগুলোতে পাকিস্তানের অন্য অঞ্চলের মতো তাদের সমানাধিকার নেই। তাই আওয়ামী লীগ এই বিষয়টি মানুষের সামনে তুলে এনে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তুলে উত্তেজনা ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো বেশিভাগই নিরপেক্ষ। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অনন্য ধর্মাবলম্বী নাগরিকেরা তাদের উদার ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিচ্ছিন্ন হতে চাইলেও প্রকাশ্যে বলার সাহস পাননি। বরং লুকিয়ে রেখেছেন যেন রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন না করা যায়। তার মনে বহু আগ থেকেই বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইচ্ছে ছিল। মূলত ৬ দফার প্রতিটি দাবিই পাকিস্তান ভাঙার অন্যতম ষড়যন্ত্র।’

২০ জুন পেশোয়ারে শহীদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মানের সঙ্গে বৈঠকের পর ন্যাপ ওয়ালী প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মেজর জেনারেল জিলানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘এখনই ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় নয়। পূর্ব পাকিস্তানে এখন স্বাভাবিক অবস্থা নেই। তবে আমি আশা করি অচিরেই তা স্বাভাবিক হবে। ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে দুই পরদেশি একসঙ্গে হতে হবে। আমি যা করছি তা দুই প্রদেশের ঐক্যের জন্যই করছি। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার ব্যাপারে এমএনএ ও এমপিরা এগিয়ে এসেছেন। তবে আমি সংখ্যাটা প্রকাশ্য করব না।’ বেগম আখতার সোলায়মান এই সংবাদ সম্মেলনে বিদেশ সফরের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কথা জানান। এবং বিদেশ সফর যদি হয়েও থাকে পরবর্তীতে সেটি ব্যক্তিগত সফর হবে, রাষ্ট্রীয় সফর নয়।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ

২০ জুন দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ‘পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয় মার্কিন সরকার পাকিস্তান সরকারকে যে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছিল সেই অস্ত্র পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষের উপর ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করে চলমান গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় ‘ইয়োথ ফর বাংলাদেশ’ এর উদ্যোগে কলকাতায় এক বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারা যুদ্ধবিরোধী স্লোগান দেন এবং বলে যে এ মুহূর্তে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের চালান একটি গোপন কূটকৌশল। তা সত্ত্বেও মার্কিন সরকার ঘোষণা করেছে পাকিস্তানে প্রস্তাবিত অস্ত্র সরবরাহ করা হবে। ইয়োথ ফর বাংলাদেশের সভাপতি জনাব মিহির সেন এক বিবৃতিতে নিক্সন প্রশাসনের দু-মুখো কূটনীতি ও হৃদয়হীন পক্ষপাতদুষ্ট মতবাদের নিন্দা করেন।’

২০ জুন বিবিসির এক খবরে বলে, ‘পাকিস্তান সরকার ও দেশটির সামরিক প্রশাসন স্বেচ্ছায় পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি সংবাদদাতাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তবে পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদ সংগ্রহ করতে হলে অবশ্যই পাকিস্তান সরকারের অনুমতি লাগবে।’

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২০ জুন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার চাঁদগাজীর মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটি পতন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গতিবিধি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।