৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৪ জুন ১৯৭১ এই দিনে

১৪.০৬.১৯৭১

 

বাঙালি শরণার্থী স্রোতের মতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যাচ্ছে। ফাইল ছবি

বাঙালি শরণার্থী স্রোতের মতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যাচ্ছে। ফাইল ছবি

এদিন নিউজউইকের ’অনিশ্চিত আশ্রয়’ শিরোনামের রিপোর্টে বলা হয়, লাখে লাখে, বাঙালি শরণার্থী স্রোতের মতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যাচ্ছে। তাদের অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করার চেষ্টার ফলশ্রুতিতে শুরু হওয়া পাশবিক দমননীতি থেকে পালিয়ে, ব্যাধি এবং অপরিচ্ছন্নতার মাঝে তারা এক অনিশ্চিত আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। 

গতসপ্তাহে, নিউজউইকের টনি ক্লিফটন কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে প্রতিবেদনে বলেন, ইতোমধ্যেই, ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের আকাশ ভারি এবং ধূসর হয়ে উঠেছে, আসন্ন বর্ষাকালের পূর্বাভাস দিচ্ছে, যা কি-না যে কোনো সময়ে ফেটে পড়তে পারে। এ বছরের বর্ষা অবধারিতভাবেই অতিরিক্ত প্রলয় ঘটাবে, প্রায় ৪০ লাখ পাকিস্তানীর আতঙ্ক বহু গুণে বাড়িয়ে দেবে। ভারতীয় সরকারী কর্মচারীরা অত্যাশ্চর্যভাবে শরণার্থীদের জন্য খাদ্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করে আসছে, কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টা ধুয়ে মুছে যাবে যদি এমনকি বর্ষার ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিও হয়। আর যদি ভারি বর্ষণ হয়, তাহলে আসন্ন বন্যা এমন এক বিপর্যয় ঘটাতে পারে যার তুলনা করা যেতে পারে সেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে যেটি মাত্র গত বছরই পূর্ব পাকিস্তানে ৫ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। অসংখ্য শরণার্থী যাদের অনেকেই বিভিন্ন রোগে শোকে আক্রান্ত! যখন তারা পালিয়ে ভারতে চলে আসে, তখনও শরণার্থীরা নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কলেরা। 

যখন প্রথম দলগুলো, সীমান্ত পার হয়ে আসে, চিকিৎসকরা তাদের কলেরার প্রতিষেধক দেন, কিন্তু এখন বাঙালিরা এমন সংখ্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে ভারতে আসছে যে তাদের সবাইকে প্রতিষেধক দেয়া সম্ভব নয়। ইতোমধ্যেই কলেরার প্রকোপ মহামারি আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে, প্রায় ২০০০ শরণার্থী মারা গেছে এবং সমানসংখ্যক মৃতপ্রায় হয়ে হাসপাতালে বা রাস্তার পাশে পড়ে আছে।

পাক সেনাদের একটি দল কুমিল্লা থেকে নয়াবাজার হয়ে চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধারা নয়াবাজারের কাছে তাদের এ্যামবুশ করে। এ অভিযানে পাক সেনাদের ৩০ জন সৈন্য হতাহত হয় এবং তাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয় ও তারা পিছু হটে। মুক্তিবাহিনীর ১৬ জন যোদ্ধার একটি দল কুমিল্লার বুড়িচং থানার ওপর আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৮ জন নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন আহত ও একজন নিখোঁজ হয়। এতে বুড়িচং থানা শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকা, কুমিল্লা যাবার গোপন পথ নিরাপদ হয়।

গোপালগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর চলবল ঘাঁটির ওপর পাক হানাদারবাহিনী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট এই তিনদিক দিয়ে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের নিকটবর্তী রামশীল গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং এর ভিতর দিয়ে গৌরনদী থানার বাসাইল গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। পথে বান্দাবাড়ি খালের কাছে হেমায়েত বাহিনীর সাথে পাকসেনাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। দীর্ঘ যুদ্ধের পর হানাদারবাহিনী পিছু হটে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মকবুল শহীদ হনএবং হেমায়েত আহত হন। অপরদিকে পাকবাহিনীর ৫০-এর অধিক সৈন্য নিহত হয় এবং ১৮ জনসৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। এ যুদ্ধের পর হেমায়েতবাহিনী কোদালধোয়া গ্রামে তাঁদের ঘাঁটি স্থানান্তর করে।

এদিন সূর্যোদয়ের ২ ঘণ্টা আগে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ২৫ থেকে ৩০ জন সৈন্যের একটি দল চারটি ট্যাংকসহ আদিত্যপুর গ্রামে এসে পৌঁছায়। আধাঘণ্টার ভেতর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীরা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পুরো গ্রাম ঘিরে রেখে লাউডস্পীকারে ঘোষণা দেয় যে শান্তি কমিটির স্থানীয় শাখা গঠন করতে এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের ড্যান্ডি (আইডেন্টিটি কার্ড) কার্ড বিতরণ করবে। বন্দুকের সামনে জোড় করে হিন্দুদের ঘর থেকে বের করে আদিত্যপুর সরকারি স্কুলের সামনে সমবেত করা হয়। ৬৫ জনকে বেঁধে শুটিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়। স্থানীয় রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা শেষে পাকিস্তানি দখলদারবাহিনীর ক্যাপ্টেন গুলির নির্দেশ দেয়। সৈন্যরা বন্দীদের উপর গুলি চালালে ৬৩ জন নিহত হন। মৃতের ভান করে দুজন বেঁচে যান। এরপর রাজাকাররা গ্রামে লুটপাট চালায় এবং পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রামের নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

স্থানীয় রাজাকার ও দালালেরা ঝালকাঠির বেশাইন খান গ্রামের আশেপাশের অঞ্চলে পাকবাহিনীর ত্রাস মানিকবাহিনীর (স্থানীয় ক্ষুদ্র মুক্তিযোদ্ধাদল) গোপন ক্যাম্পের সংবাদ পেয়ে পাকসেনাদের জানালে পাকসেনারা ভোরে মানিকবাহিনীর গোপন ঘাঁটিতে আভিযান চালায়। তারা মানিক, রতনসহ ২৪ জনকে আটক করে এবং ঘটনাস্থলে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে। মানিক রতনসহ ৮ জনকে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে এলে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন আজমত তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

আবদুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে কয়েকশ’ মুক্তিযোদ্ধার একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থানার ভদ্রঘাট গ্রামে। এদিন রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা সেই গ্রাম ঘেরাও করে গুলিবর্ষণ করে এবং গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। এখানে গুলি করে হত্যা করা হয় ১৯ জনকে। মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থানার ভদ্রঘাট ও ধামকোল গণহত্যা নামে পরিচিত।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান করাচিতে বলেন, ‘বর্ষা মওসুমে সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের ফলে উদ্ভুত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকার সম্পূর্ণ তৈরি।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্ন সমাধানের আগে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখতে হবে। প্রদেশের পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত এবং দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। অনুপ্রবেশকারীরা সীমান্তে কিছু পুল উড়িয়ে দিয়েছে এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করছে।’ তিনি শান্তি কমিটির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটা মোটেও রাজনৈতিক সংগঠন নয়। শান্তি কমিটির সাচ্চা পাকিস্তানিরা দুস্কৃতকারীদের হাত থেকে দেশ বাঁচানোর জন্যে আমাকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।’

ঢাকা পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের ২১০ টি হিন্দু নামে নামাঙ্কিত রাস্তার নাম পাল্টে মুসলিম নাম দেয়। লালমোহন পোদ্দার রোডের নাম হয় আবদুর করিম গজনবী রোড, হরিচরণ রোডের নাম হয় মোহাম্মদ বিন কাশেম রোড। এভাবে শাঁখারী বাজার হয়ে যায় গুলবদন, কিষাণ ব্যানার্জী হয় আলীবর্দী, নবীন চাঁদ হয় বখতিয়ার খিলজী আর কালীচরণ রোড হয় গাজী সালাউদ্দিন রোড, ইত্যাদি।

জাতীয় পরিষদের সাবেক নেতা খান আবদুস সবুর ঢাকায় বলেন, বাংলাদেশ নামের প্রতিশ্রুত সশস্ত্র প্রলোভনে সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া খাঁটি পাকিস্তানিরা এখন নরক যন্ত্রনা ভোগ করছে। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এস বি জামান পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণকে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

 

সিলেটের বালাগঞ্জের আদিত্যপুর ও বুরুঙ্গা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৪ জুন ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন বিখ্যাত মার্কিন ম্যাগাজিন নিউজ উইক ’অনিশ্চিত আশ্রয়’ শিরোনামে টনি ক্লিফটনের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। 

এই রিপোর্টে বলা হয়, 'পূর্ব বাংলা থেকে আগত লাখ লাখ শরণার্থী স্রোতের মতো সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে ঢুকছে। অন্যদিকে তাদের অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করার চেষ্টার ফলশ্রুতিতে শুরু হওয়া পাশবিক দমননীতি থেকে পালিয়ে, ব্যাধি এবং অপরিচ্ছন্নতার মাঝে তারা এক অনিশ্চিত আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। এক সপ্তাহ আগে নিউজ উইকের প্রতিবেদক টনি ক্লিফটন সীমান্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে প্রতিবেদনটি লিখেছেন। তিনি সেই প্রতিবেদনে বলেন, 'ইতোমধ্যেই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আকাশ ভারী এবং ধূসর হয়ে উঠেছে, আসন্ন বর্ষাকালের পূর্বাভাস দিচ্ছে, যে কোনো সময় বিরামহীনভাবে প্রবল বর্ষণ হতে পারে। আর এ বছরের বর্ষা অবধারিতভাবেই ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করবে। প্রায় ৪০ লাখ পাকিস্তানির আতঙ্ক বহু গুণে বাড়িয়ে দেবে। অন্যদিকে ভারতীয় সরকারি কর্মচারীরা দিনের পর দিন কী দারুণভাবে শরণার্থীদের জন্য খাদ্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করে আসছে। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টা ধুয়ে মুছে যাবে যদি এবার বর্ষায় স্বাভাবিক বৃষ্টিও হয়। আর যদি ভারী বর্ষণ হয়, তাহলে তো বন্যা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যেমনটি গত বছর হয়েছে। গত বছরই তো পূর্ব পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। অসংখ্য শরণার্থী নানা রোগে শোকে আক্রান্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছেন। এখানেও শরণার্থীরা নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে, যার মধ্যে কলেরা অন্যতম। যখন শরণার্থীদের প্রথম দলগুলো, সীমান্ত পার হয়ে এসেছিল তখন চিকিৎসকরা তাদের কলেরার টিকা দিয়েছিলেন কিন্তু এখন ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙালি শরণার্থীরা ভারতে প্রবেশ করছে। এমন অবস্থায় তাদের সবাইকে টিকা দেয়া সম্ভব নয়। ইতোমধ্যেই কলেরার প্রকোপ মহামারী আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে, প্রায় ২০০০ শরণার্থী মারা গেছে এবং বহু শরণার্থী হাসপাতালে বা রাস্তার পাশে পড়ে আছে।’

ঢাকায় এদিন  

১৪ জুন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান করাচিতে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের ফলে উদ্ভুত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার সম্পূর্ণ তৈরি আছে। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্ন সমাধানের আগে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখতে হবে। প্রদেশের পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত এবং দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। অনুপ্রবেশকারীরা সীমান্তে কিছু পুল উড়িয়ে দিয়েছে এবং ধ্বংসাত্মক কাজ করছে।’ তিনি শান্তি কমিটির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এটি মোটেও রাজনৈতিক সংগঠন নয়। শান্তি কমিটির সাচ্চা পাকিস্তানিরা দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে দেশ বাঁচানোর জন্যে আমাকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে।’

১৪ জুন ঢাকা পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের ২১০টি হিন্দু নামে নামাঙ্কিত রাস্তার নাম পাল্টে মুসলিম করে। লালমোহন পোদ্দার রোডের নাম হয় আবদুর করিম গজনবী রোড, হরিচরণ রোডের নাম হয় মোহাম্মদ বিন কাশেম রোড। এভাবে শাঁখারী বাজার হয়ে যায় গুলবদন, কিষাণ ব্যানার্জী হয় আলীবর্দী, নবীন চাঁদ হয় বখতিয়ার খিলজী আর কালীচরণ রোড হয় গাজী সালাউদ্দিন রোড।

১৪ জুন জাতীয় পরিষদের সাবেক নেতা খান আবদুস সবুর ঢাকায় বলেন, 'বাংলাদেশ নামের প্রতিশ্রুত সশস্ত্র প্রলোভনে সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া খাঁটি পাকিস্তানিরা এখন নরক যন্ত্রনা ভোগ করছে।'

১৪ জুন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এস বি জামান পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণকে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ 

১৪ জুন দৈনিক যুগান্তর ’মেহেরপুরে পাকবাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য খতম’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলে, 'মুক্তিফৌজ গতকাল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম খন্ডে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি ফৌজের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। মেহেরপুরের অদূরে তারা পাক ফৌজের এক প্লাটুন সৈন্য খতম করে দিয়েছে। সীমান্তের অপর পার থেকে এখানে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, ভারতের গোদা ঢ্যাঙ্গার বিপরীত দিকে ভোমরার কাছে এবং পেট্রাপোলের বিপরীত দিকে বেনাপোলের নিকটে যুদ্ধ অব্যাহত আছে। তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিফৌজ মেহেরপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালী সিমান চৌকি দখল করে নিয়েছে। ঐ অঞ্চলে মর্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে তারা পাক ফৌজের এক প্লাটুন সৈন্য খতম করে দিয়েছে। আহত কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যকে তাদের সাথীরা সরিয়ে নিয়ে গেছে। খবরে প্রকাশ, পাক সৈন্যরা এখান থেকে প্রায় এক শ’ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের প্রাগপুর এলাকায় ২৫টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এবং পাঁচজনকে হত্যা করেছে।'

১৪ জুন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যত’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, 'পশ্চিম পাকিস্তানে শরণার্থীদের ভয়াবহ দুরবস্থা, পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যবাহিনীর কাজ এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় আসার সিদ্ধান্ত নষ্ট হওয়ার বিষয়গুলোতে এখন বিশ্ববাসীর মনোযোগ নিবদ্ধ হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বিচ্যুতি হতে পারে না।' 

ভারতে এদিন 

১৪ জুন সার্ভেন্ট অফ ইন্ডিয়া সোসাইটির সভাপতি ড. কে এ কুনযরু ‘আমাদের করণীয়’ শীর্ষক একটি সভা আহ্বান করে বলেন, 'পূর্ব বাংলার ঘটনা প্রবাহকে ১৯৫৬ সালের হাঙ্গেরিয়ান সঙ্কটের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। যখন হাঙ্গেরিয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের দেশ ত্যাগ করতে হচ্ছিল তখন জাতিসংঘ এবং আমেরিকা উভয়ই সঙ্কট নিবারণে উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছিল।'

১৪ জুন ভারতের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সুরেন্দ্র পাল সিং লোকসভার অধিবেশনে বলেন, 'পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সরকারের নৃশংস আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে চীন ভারতের প্রতি শত্রু মনোভাব অবলম্বন করেছে, ভারত তার প্রতিবাদ জানায়নি। তবে পূর্ব বাংলার ব্যাপারে ভারত সরকারের মনোভাব চীনের দূতকে জানানো হয়েছে।'

১৪ জুন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান পাকিস্তান সফর শেষে ভারতের দিল্লিতে পৌঁছান। এদিন তিনি ভারতের পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকরের সঙ্গে বৈঠক করেন।

১৪ জুন ভারতের সংযুক্ত সমাজবাদী দলের নেতা রাজনারায়ণ বারানসিতে সাংবাদিকদের বলেন বাংলাদেশকে এখনো স্বীকৃতি না দেয়া ও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সহায়তা না করা ভারত সরকারের বিরাট ভুল। এতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমি এই ভুল সংশোধনের দাবিতে প্রয়োজনে অনশন করব।বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিবৃতি, বৈঠক

১৪ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংহ কানাডার অটোয়ায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী মাইকেল শার্পের সঙ্গে এক বৈঠক করেন। এই বৈঠকের আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বের দেশগুলোকে এবং জাতিসংঘকে শরণার্থীদের বিষয়ে কোনো না কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। পূর্ব বাংলার অবস্থা এখন শোচনীয়। এটি এখন আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। ভারত পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির জন্য যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তা কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলেই হবে। বৈঠকে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'পাকিস্তান সরকারের কাছে আমরা আশা করি পাকিস্তান সরকার ও তাদের প্রশাসন শিগগিরই অচলাবস্থা থেকে সমস্ত কিছু স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ নেবে।'

১৪ জুন মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবদুল রাজাক হুসেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

আদিত্যপুর গণহত্যা

১৪ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিলেটের বালাগঞ্জের আদিত্যপুর গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন ৬৩ জন মানুষ।

এদিন সূর্যোদয়ের ২ ঘণ্টা আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫ থেকে ৩০ জন সৈন্যের একটি দল চারটি ট্যাংকসহ আদিত্যপুর গ্রামে এসে পৌঁছায়। আধা ঘণ্টার ভেতর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পুরো গ্রাম ঘিরে রেখে লাউডস্পিকারে ঘোষণা দেয় 'শান্তি কমিটির স্থানীয় শাখা গঠন করতে হবে। এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের ড্যান্ডি (আইডেন্টিটি কার্ড) কার্ড বিতরণ করা হবে।'

এসময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘুম থেকে তুলে বন্দুকের মুখে আদিত্যপুর সরকারি স্কুলের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাদের লাইনে দাঁড় করানো হয়। সমবেত করা হয়। অতঃপর স্থানীয় রাজাকার আব্দুল আহাদ চৌধুরীর সাথে আলোচনা শেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন গুলির নির্দেশ দেয়। গুলি চালালে ৬৩ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। বেঁচে ফেরেন মাত্র দুজন। গণহত্যার পর পাকিস্তানি বাড়ি বাড়ি ঢুকে লুটপাট শেষে গান পাউডার দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

বেশাইন খান গণহত্যা

ঝালকাঠির বেশাইন খান গ্রামের রেজাউল করিম আজাদ ২৪ জন তরুণকে নিয়ে মানিক বাহিনী নামের একটি বাহিনী গঠন করেন। এ দল মানিক বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। মানিক ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র ও সংসদের সাধারণ সম্পাদক । তার ছোট ভাই কীর্তিপাশা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সাইদুল করিম রতন ছিল তার অন্যতম সহকারী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতনে হাজার হাজার হিন্দু আটঘর কুড়িয়ানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।মানিক বাহিনী তাদের সহযোগিতা করে এবং তাদের পরিত্যক্ত ঘরবাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল।

১৩ জুন স্থানীয় রাজাকার ও দালালেরা ঝালকাঠির বেশাইন খান গ্রামের আশেপাশের অঞ্চলে হানাদার বাহিনীকে মানিকবাহিনীর গোপন ক্যাম্পের সংবাদের কথা জানালে ১৪ জুন ভোরে মানিক বাহিনীর গোপন ঘাঁটিতে অভিযান চালায় হানাদার বাহিনী। এসময় তারা মানিক, রতনসহ ২৪ জনকে আটক করে এবং ঘটনাস্থলেই ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে। মানিক রতনসহ ৮ জনকে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে এলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন আজমত তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

ভদ্রঘাট ধামকোল গণহত্যা 

১৪ জুন আবদুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থানার ভদ্রাঘাট গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করে। এদিন রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা এই গ্রাম ঘেরাও করে নির্বিচারে গুলি চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন ১৯ জন মানুষ। গণহত্যার পর হানাদার বাহিনীর বাড়িঘরে লুটপাট চালিয়ে গান পাউডার দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। 

১৪ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল কুমিল্লা থেকে নয়াবাজার হয়ে চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধারা নয়াবাজারের কাছে তাদের অ্যামবুশ করে। এ অভিযানে হানাদার বাহিনীর ৩০ জন সেনা হতাহত হয় এবং তাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয় ও তারা পিছু হটে।

১৪ জুন মুক্তিবাহিনীর ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কুমিল্লার বুড়িচং থানার ওপর আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৮ জন সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন আহত ও একজন নিখোঁজ হয়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা বুড়িচং থানা শত্রুমুক্ত করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকা, কুমিল্লা যাওয়ার গোপন পথ নিরাপদ করেন।

১৪ জুন গোপালগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর চলবল ঘাঁটির উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট দিয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে হানাদার সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের নিকটবর্তী রামশীল গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং এর ভেতর দিয়ে গৌরনদী থানার বাসাইল গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। পথে বান্দাবাড়ি খালের কাছে হেমায়েত বাহিনীর সাথে হানাদার বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয়। কয়েক ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধের পর হানাদারবাহিনী পিছু হটে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মকবুল শহীদ হন এবং হেমায়েত উদ্দিন আহত হন। অন্যদিকে পাকবাহিনীর ৫০-এর অধিক সেনা নিহত হয় এবং ১৮ জন সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। এ যুদ্ধের পর হেমায়েতবাহিনী কোদালধোয়া গ্রামে তাদের ঘাঁটি স্থানান্তর করে।