৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৯ জুন ১৯৭১ এই দিনে

* তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিন ৯ জুন রাজধানী মস্কোতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরণার্থীকে তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত উপমহাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সরকার উদ্বিগ্ন।


* ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সম্পর্কে জার্মানির নেতাদের জানাতে মস্কো থেকে ৯ জুন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বনে পৌঁছান।


* ভারতে যাওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের ব্যাপারে বনে এক রেডিও সাক্ষাৎকারে সরদার শরণ সিং বলেন, পাকিস্তানি সামরিক সরকারের তাণ্ডবের শিকারে পরিণত হওয়া শরণার্থীদের দায়িত্ব বিশ্ববাসীকে বহন করতে হবে। পাকিস্তান সরকারের নীতিই ব্যাপক শরণার্থী পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচার খুন করা হচ্ছে। ভারতে শরণার্থী আগমন অব্যাহত থাকলে তা বন্ধের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে ভারত বাধ্য হবে।


* ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ নিউইয়র্কে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ বিষয়ে একটা রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, আরও নেবে।


* এদিন ব্রিটেনের কমন্স সভায় বিরোধী লেবার পার্টির সাংসদেরা সরকার পক্ষকে নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি পরিবর্তনে বাধ্য করে চার ঘণ্টা ধরে বিতর্ক করেন। লেবার পার্টির সদস্যরা শরণার্থীদের জন্য গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ এবং পাকিস্তান সরকারের নীতির সমালোচনা করেন। লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড উইলসন এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুডিথ হার্ট শরণার্থীদের জন্য ব্রিটেনের সাহায্যের পরিমাণ এবং তা পাঠানোর ক্ষেত্রে গড়িমসিতে হতাশা প্রকাশ করেন।


* ব্রিটেনের বৈদেশিক উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী রিচার্ড উড বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য ব্রিটেন ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে  চিঠি বিনিময় হয়েছে। চিঠিতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গও উল্লেখ করা হয়েছে।


* পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ইয়র্কশায়ারের বার্ডফোর্ড মাঠের বাইরে প্রবাসী বাঙালি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সালাম এই দিন ৭২ ঘণ্টার জন্য অনশন শুরু করেন। মাঠে ইয়র্কশায়ার দলের সঙ্গে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের তিন দিনব্যাপী খেলা চলছিল। মোহাম্মদ সালাম অনশন শুরুর আগে প্রায় ২০০ ছাত্র মাঠের বাইরে উপস্থিত হন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে এবং পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফরের প্রতিবাদে তিনি দুই রাত ও তিন দিন পানি ছাড়া আর কিছু খাবেন না এবং সেখান থেকে নড়বেন না।

 


* যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রাংক চার্চ ও উইলিয়াম স্যাক্সবি যৌথভাবে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য সিনেটে সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা কেবল ভারতের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি, এর ফলে সে ভূখণ্ডে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব এবং তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রাখা উচিত।


* ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এসে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেছিলেন কংগ্রেসের সদস্য কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার। ওয়াশিংটনে ফিরে ৯ জুন তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে আরও সাহায্য দিলে তা হত্যা ও মহামারিকেই সাহায্য করবে। এখন বিশ্বের প্রধান কর্তব্য শরণার্থীদের জায়গা দিতে ভারতকে সাহায্য করা। শরণার্থীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যাই পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পাশবিক অত্যাচারের প্রমাণ।


* যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ভারতকে অতিরিক্ত দেড় কোটি ডলার সাহায্য মঞ্জুর করে।


* ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক অর্গানাইজেশনের মহাসচিব এইচ এইচ মাজুর্কি জাতিম এদিন জাকার্তায় এক বিবৃতিতে ভারতে যাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের সাহায্য করার জন্য মুসলিম রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানদের প্রতি আহ্বান জানান।


* বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান এদিন শিলিগুড়িতে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন।


* দিল্লিতে আদি কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির সাধারণ পরিষদের সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও স্বীকৃতির প্রশ্ন নিয়ে এদিন আলোচনা হয়। সভায় বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাপারে সরকার লক্ষ্যহীন নীতি অনুসরণ করে চলেছে। সভার সভাপতি ছিলেন পার্লামেন্টারি পার্টির চেয়ারম্যান মোরারজি দেশাই।


* কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে শিগগির ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। প্রতিনিধিদলে থাকবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিক এবং আনিসুজ্জামান। প্রথমে তাঁরা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। পরে যাবেন দিল্লি, আগ্রা, আলিগড়, লক্ষ্ণৌ ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে।


* কাউন্সিল মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি খাজা খয়েরুদ্দিন ও সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সংহতি ও আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা উদ্ভাবনের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের সম্মেলন আয়োজনের পরামর্শ দেন।

 

হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্মম অত্যাচার চালাতে থাকে। ফাইল ছবি

হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্মম অত্যাচার চালাতে থাকে। ফাইল ছবি

বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ দুটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় পাঠায়। দলের সদস্যরা তিনটি গাড়ীতে করে এয়ারপোর্ট থেকে ময়মনসিংহ রোড ধরে পাক আর্মির প্রহরায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের গেটের সামনে আসতেই গ্রেনেড ছুঁড়লেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোঁড়া একের পর এক গ্রেনেডে প্রকম্পিত হলো পুরো এলাকা। ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এটাই প্রথম বড় ধরনের ও গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা অপারেশন।

মার্কিন সিনেটে ডেমোক্র্যাট সিনেটর ফ্রাংক চার্চ ও রিপাবলিকান সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি পাকিস্তানে মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য একটি দ্বিপক্ষীয় সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা কেবল ভারতের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি, পাশাপাশি এ সমস্যার ফলে এ এলাকার শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা মনে করি, উদ্বাস্তুদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেখানে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাঠানো এবং উদ্বাস্তুদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা।

ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক অর্গানাইজেশনের মহাসচিব এইচ এইচ মার্জুকি জাতিম জাকার্তায় এক বিবৃতিতে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের সাহায্য করার জন্য মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সরকার প্রধানদের প্রতি আহ্বান জানান। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দুত এবং সহকারী মহাসচিব (জরুরী দায়িত্ব) ইসমত কিত্তানি পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের ত্রাণ চাহিদা নিরূপণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ৫ দিন সফর শেষে নিউইয়র্কের পথে করাচী ত্যাগ করেছেন। পাকিস্তান জাতিসংঘের কাছে ইতিপূর্বে যে ত্রাণ সাহায্য চেয়েছিল তা দেয়ার তিনি আভাস দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ভারতকে অতিরিক্ত দেড় কোটি ডলার সাহায্য মঞ্জুর করে। জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে ইসলামাবাদ থেকে ঢাকা আসেন। স্বাধীনতা বিরোধী আওয়ামী লীগের কিছু পাকিস্তানী দালাল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করে ‘আওয়ামী এ্যাকশন কমিটি’ গঠন করে। এ্যাকশন কমিটির সভাপতি মীর ওয়াইজ মোহাম্মদ ফারুক দেশের সার্বিক অবস্থার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করেন।