৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৮ জুন ১৯৭১ এই দিনে

* মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা দল রাজৈর থানার অন্তর্গত তাহেরহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। অতর্কিত হামলায় ১০ জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায় এবং তারা তাহেরহাট থেকে পিছু হটে।


* ময়মনসিংহের ভালুকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভাওলিয়া বাজুরঘাট ঘাঁটিতে কাদেরিয়া বাহিনীর ৬ষ্ঠ কোম্পানির তিন মুক্তিযোদ্ধা গ্রেনেড হামলা চালায়। হামলায় ৭ পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ১১/১২ জন আহত হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ দেশের বিভিন্ন স্থানে।  ফাইল ছবি

মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ফাইল ছবি

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং-এর মস্কো সফরকালে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামে নৈতিক সমর্থন ও সহযোগিতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফেনীতে সেলোনিয়া নদীর তীরে মুক্তিবাহিনীর ভান্দুরা রেলস্টেশন ঘাঁটিতে পাকসেনারা ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান ত্যাগ করে বেলোনিয়া মূল প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে চলে আসে। অপর দিকে পাকসেনারা আনন্দপুর পর্যন্ত এগিয়ে এসে সেখানেই দৃঢ় অবস্থান নেয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক ক্ষতির স্বীকার হয়।

ঢাকায় এক নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, তোফায়েল আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান ও পিপলস পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমানের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করে। বিচারে ৫ জনের প্রত্যেককে ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড প্রদান এবং তাদের সম্পত্তির শতকরা ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।

বগুড়ার জাতীয় পরিষদ সদস্য হাবিবুর রহমান এক বিবৃতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (মুক্তিবাহিনী) সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি একজন খাঁটি পাকিস্তানী হিসেবে দেশের সেবা করে যাবেন। সময়মতো পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করায় তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে অভিনন্দন জানান।

বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলোক ডগলাস হিউম লন্ডনে বলেন, নতুন অর্থনৈতিক সাহায্য প্রকল্পে সম্মত হবার আগে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বৃটেন পাকিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তবে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক সমাধান চাপিয়ে দিতে পারি না।

রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটির লন্ডন হেড কোয়ার্টারে প্রদত্ত ভাষণে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, সংবাদপত্র খুললেই আপনারা দেখতে পাবেন পূর্ব বাংলার নাগরিকরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে কিন্তু এসবের কারণ কী? কোথায় এ হত্যাযজ্ঞের সূচনা? এই মানবিক লাঞ্ছনার জন্য দায়ী কে? তিনি বলেন, আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের প্রত্যাশা আর আকাঙ্ক্ষার অপূর্ণতা এবং রাজনৈতিক শাসন ও অর্থনেতিক শোষণে দীর্ঘদিন ধরে জর্জরিত ছিল। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে জনগণ ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের কথা মনে রেখেই। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ভোট দেয়। কারণ তারা বৈদেশিক বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়ে ৬ দফার দাবিতে প্রদেশের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিল, যাতে অভিন্ন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিকে স্বীকার করে দুটি অঞ্চলই হাতে হাত ধরে এক পাকিস্তানের শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে। 

বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেন, ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ করার ব্যাপারটাকে ইয়াহিয়ার মন্ত্রণাদাতারা ভালো চোখে দেখেনি। সামরিক একনায়কেরা বুঝতে পেরেছিল জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় এসে গেছে। এই উপলব্ধিতেই তারা মাত্র ৩০টি আসন পাওয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোকে নিজেদের দলে টেনে নিল। ভুট্টো ঘোষণা করলেন ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন তিনি বয়কট করবেন। চাপের মুখে ইয়াহিয়া পরিষদ অধিবেশন বাতিল করলেন। শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে হরতালের কর্মসূচি দিলেন। পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগোষ্ঠী তার আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দিল। কেননা, পূর্ব বাংলার জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের আইনসম্মত শাসক হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

বিচারপতি চেীধুরী বলেন, এই পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে তার সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। শেখ মুজিব তা গ্রহণ করেন। আর শেখ সাহেব যখন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন, তখন জাহাজ ভর্তি অস্ত্র ও পাকসেনা পাঠানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। তারপর ঘটলো ইতিহাসের বর্বরতম ঘটনা। যার শুরু বৃহস্পতিবার ২৫ মার্চের রাতে। আমার ছাত্র ও অধ্যাপকরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও এ্যাপার্টমেন্টে ঘুমিয়ে আছে, পুরো ঢাকা শহর নিদ্রামগ্ন-সেনাবাহিনী নেমে এল পথে, নির্বিচারে হত্যা করলো ছাত্র ও অধ্যাপকদের। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণ জেগে উঠেছে। আওয়াজ তুলেছে স্বাধীনতার। নতুন এক দেশের অভ্যুদয় হয়েছে, তা আজকের বাংলাদেশ। কোনো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিক বা কৌশলগত কারণে না দিক, বাস্তবতা হলো ইয়াহিয়ার বাহিনী ঢাকাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। এই বাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করেছে সমগ্র জাতি। কারো পক্ষেই বাংলাদেশকে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বাধীন রাখা সম্ভব নয়। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এভাবে বন্দি রাখা যাবে না। 

আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার ও পাকসেনা পূর্ব বাংলা নিয়ন্ত্রণ করছে’ তা মোটেই সত্যি নয়। সংখ্যালঘূর নিয়ন্ত্রণে জনগণকে আতঙ্কিত করে কখনো কোনো দেশ চালানো যায় না। পূর্ব বাংলার জনগণ জানে পাকিস্তানের এই শাসন, পাক সেনা এই আস্ফালন আর বেশি দিন টিকবে না। আমরা এখন ভালোভাবেই জানি, উপনিবেশ থেকে আমরা আমাদের স্বাধীনতার মর্যাদাকে আয়ত্ত করতে যাচ্ছি। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, জীবনযাপন, সংস্কৃতি ও ভাষায় আমরা স্বতন্ত্র। আমাদের জনগোষ্ঠী আলাদা। জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতে নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার আমাদের আছে।

 

৮ জুন ১৯৭১, দ্য স্ট্রেইটস টাইমস, মালয়েশিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনঃ



সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কদাচিত্ অন্য রাষ্ট্র জড়িয়ে থাকে—পূর্ব পাকিস্তান সংকটের বেলায়ও। ৪০ লাখ শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছে। অনেক শরণার্থী-শিবিরে কলেরা মহামারি দেখা দিয়েছে—এ পর্যন্ত মৃত্যু আট হাজার। কলকাতায়ও এই মহামারি ছড়িয়ে পড়তে পারে—এই আশঙ্কায় ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত ‘সিল’ করে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা অনুভব করেছে। এতে শরণার্থীর ০ে

স্রাত বন্ধ হওয়ার বা কলেরার বিস্তার রোধের কোনো গ্যারান্টি নেই।

নয়াদিল্লি এ পরিস্থিতি সামাল দিতে অক্ষম। আর এ নিয়ে তারা কোনো রাখ-ঢাক করেনি। মিসেস ইন্দিরা গন্ধী তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ছয়টি দেশে সফরে পাঠিয়েছেন, যাতে বৃহত্ শক্তিগুলোকে বোঝাতে পারেন যে পূর্ব পাকিস্তান সংকট সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, এমনকি উপমহাদেশের শান্তির জন্যও হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। পশ্চিমের সংবাদপত্র এবং ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক নেতাদের ধন্যবাদ যে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় কিছু সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেছে। অক্সফাম কলেরা নিরোধ টিকা পাঠিয়েছে; সাহায্য-সহযোগিতা মিশন নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়াল এয়ারফোর্স অপেক্ষা করছে। ওয়াশিংটনও ভারতে পরিবহন উড়োজাহাজ পাঠাচ্ছে, যাতে প্রয়োজনে সীমান্ত এলাকা থেকে সুবিধাজনক জায়গায় শরণার্থী পরিবহন করা যায়। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের ট্র্যাজেডি ঠেকানোর মতো পর্যাপ্ত সাহায্য কি ভারত ও পাকিস্তান পাবে? উত্তর পাওয়া যাবে বর্ষা মৌসুমের আগামী সপ্তাহগুলোতে।

পাকিস্তান ব্যাপক সহায়তার আবেদন জানিয়েছে, তবে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল সতর্কভাবে সাড়া দিচ্ছে। গত ঘূর্ণিঝড়ের পর যে সাহায্য পাঠানো হয়েছে, তার সঠিক ব্যবহারে পাকিস্তানের অসামর্থ্য এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাসমূহকে অবাধে কাজ করতে দিতে সরকারের অনিচ্ছা—পাকিস্তানের ব্যাপারে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি এবং সামরিক প্রশাসকদের মধ্যে গভীর শত্রুতার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

এখন পাকিস্তান তার নিষ্ঠুর অভিপ্রায় কিছুটা ত্যাগ করেছে বলে মনে হচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের দুজন প্রতিনিধি জাতিসংঘ ত্রাণ কর্মসূচির দাপ্তরিক ব্যবস্থা সমন্বয়ের জন্য ঢাকায় যাচ্ছেন। এখন সময়ই হচ্ছে মুখ্য নিয়ামক। নৌযান ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ স্থানে পৌঁছানো যাবে না। চট্টগ্রাম বন্দরে এখনো কাজের পরিবেশ ফিরে আসেনি। দ্রুত একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর জন্য ইসলামাবাদকে প্রভাবিত করতে হবে—নতুবা ভারতে শরণার্থী হিসেবে চলে যাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং যারা সেখানে রয়েছে, তাদের থেকে যেতেই হবে।

পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে, তাকে আর অভ্যন্তরীণ বিষয় বলার সুযোগ নেই। পূর্ব পাকিস্তান ইতিমধ্যেই একা কুলিয়ে উঠতে পারার ভণিতা ছেড়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছে। পুরো বিষয়টি ভারতের জন্য যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে, তার হুমকিও ভয়াবহ।