৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৫ জুন ১৯৭১ এই দিনে

* ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির একটি প্রতিনিধিদল ৫ জুন কলকাতায় সফরে আসা দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। প্রতিনিধিদলকে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি তাঁরা সব সময় বিবেচনা করে দেখছেন। তবে শুধু স্বীকৃতিতেই বিশেষ কোনো লাভ হবে না। প্রতিনিধিদলে ছিলেন জয়নাল আবেদীন, অমিয় দাশগুপ্ত, নির্মল বসু প্রমুখ। তারা শরণার্থীদের সাহায্য এবং অন্য ব্যবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় একটি উপকমিটি গঠন করে কলকাতায় তার প্রধান কার্যালয় করতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।


* বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য ইন্দিরা গান্ধী এই দিন রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও আলাদাভাবে বৈঠক করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাসহ উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারাও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।


* আলোচনা শেষে ইন্দিরা বলেন, শরণার্থীদের সব দায়িত্ব কেন্দ্রের। এই গুরুতর ঘটনার ফলাফল গুরুতর হতে বাধ্য। সারা বিশ্বের এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া এখনো পর্যাপ্ত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।


* ভারতের সরকারি মুখপাত্রের তথ্য থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও মালদহ জেলায় এর প্রকোপ প্রচণ্ড। ৩ জুন পর্যন্ত ৩ হাজার শরণার্থী কলেরায় মারা গেছেন।


* সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি এক বিবৃতিতে জানান, পশ্চিম পাকিস্তানের বিপ্লবী নেতা তারিক আলী বাংলাদেশের বিপ্লবকে এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাব্য দিক নিরূপণের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতায় তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এবং বিপ্লবী মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ইয়াহিয়া খানকে চীনের সমর্থনের বিষয়ে প্রকাশ্যে নিন্দাও করেন তিনি।


* ৫ জুন ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় রেহমান সোবহানের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে তিনি মুজিব–ইয়াহিয়া আলোচনার পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, সম্ভবত ১ থেকে ৬ মার্চের মধ্যে পূর্ববঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের পরিকল্পনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় আগের দিন প্রকাশিত এক নিবন্ধে রেহমান সোবহান পাকিস্তানে বিদেশি সাহায্য বন্ধ রাখার পক্ষে যুক্তি দেন।


* নিউইয়র্ক টাইমস এই দিন সিডনি শনবার্গের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সিডনি শনবার্গ লেখেন, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হিসাবে কলেরায় মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৬০০ হলেও বাস্তবে সংখ্যাটি সম্ভবত ৫ হাজার ছাড়িয়েছে।


* bপাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম টেস্ট ম্যাচের তৃতীয় দিনের খেলা শুরুর আগে প্রায় তিন হাজার প্রবাসী বাঙালি এজবাস্টন মাঠে বিক্ষোভ করেন। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলা উপলক্ষে এই দিনের বিক্ষোভ ছিল বৃহত্তম। বিক্ষোভে অনেক নারীও ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদে রক্তরঞ্জিত কুশপুত্তলিকা হাতে নিয়ে মাঠের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই প্রতিবাদ দর্শক ও সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।


* জাতিসংঘ জানায়, পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের ত্রাণদলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজি হয়েছেন। আগের দিন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত ও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ইসমত কিতানি রাওয়ালপিন্ডিতে আলোচনার সময় ইয়াহিয়া খান তাঁর সম্মতির কথা জানান।


* নেদারল্যান্ডস ও অস্ট্রেলিয়া ওষুধ, ত্রাণসামগ্রীসহ পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য অর্থসাহায্য দেওয়ার ঘোষণা দেয়।


* ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ এই দিন ২৩ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করে। এ আদেশে ঘোষণা করা হয়, কোনো সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তির চাকরির শর্তে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও সামরিক কর্তৃপক্ষ বা প্রাদেশিক সরকার দেশ কিংবা দেশের বাইরে যেকোনো স্থানে তাকে পাঠাতে পারবে।


* মাগুরায় শ্রীপুরবাহিনী বা আকবর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি থানার রামদিয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম সহযোগী চাঁদ খাঁর বাড়িতে অভিযান চালায়। তাঁরা চাঁদ খাঁ এবং তার সহযোগীদের খতম করতে সক্ষম হন। পরদিন (৭ জুন) স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিবাহিনীর এই সফল অভিযানের খবরটি প্রচার করে।


* মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে বাধা দিতে লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে জমজমা রেলওয়ে সেতু ধ্বংস করে দিয়ে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।


* মহামায়া বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটি সড়কসেতু ধ্বংস করে পাকিস্তানি বাহিনীর সড়কপথে চাঁদপুর-কুমিল্লা যাতায়াত বিচ্ছিন্ন করে।

পশ্চিম বঙ্গে কলেরায় মৃতের সংখ্যা ৩৬০০, কিন্তু বাস্তবে সংখ্যাটি আরো বেশি, সম্ভবত ৫০০০ ছাড়িয়ে। ফাইল ছবি

পশ্চিম বঙ্গে কলেরায় মৃতের সংখ্যা ৩৬০০, কিন্তু বাস্তবে সংখ্যাটি আরো বেশি, সম্ভবত ৫০০০ ছাড়িয়ে। ফাইল ছবি

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদাহ, বশিরহাট ও বনগাঁর বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে মহামারি আকারে কলেরা দেখা দেয় এবং বেশ কয়েকজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। এদিন নিউইয়র্ক টাইমসে সিডনি শনবার্গ এক প্রতিবেদনে জানান, ‘সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গে কলেরায় মৃতের সংখ্যা ৩৬০০, কিন্তু বাস্তবে সংখ্যাটি আরো বেশি, সম্ভবত ৫০০০ ছাড়িয়ে। বাঙালিরা প্রতিবেশি আর যে তিনটি রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আকবর হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শ্রীপুরবাহিনী বা আকবরবাহিনী মুক্তিযোদ্ধারা  ৫ জুন রাজবাড়ি মহকুমার বালিয়াকান্দি থানার রামদিয়াতে পাকবাহিনীর অন্যতম সহযোগী চাঁদ খাঁর বাড়িতে প্রথম অভিযান চালায়। আকবরবাহিনীর যোদ্ধারা সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বিহারী চাঁদ খাঁ ও তার সহযোগীদেরকে খতম করতে সক্ষম হন। পরের দিন ৭ জুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই বাহিনীর সফল অভিযানের খবরটি প্রচার করা হয়।

ঢাকায় সামরিক শাসক ২০ নং সামরিক আদেশ সংশোধন করে ২৩ নং সামরিক আদেশ জারি করেন। এ আদেশে ঘোষণা করা হয়, “যদি কোনো সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তির চাকরির শর্তে অন্তর্ভূক্ত নাও থাকে তথাপি এ আদেশ বলে সামরিক কর্তৃপক্ষ বা প্রাদেশিক সরকার দেশ কিংবা দেশের বাইরে যে কোনো স্থানে তাকে পাঠাতে পারবে। এ আদেশ গত ২৫ মার্চ থেকে সবার জন্য অবশ্য পালনীয় হবে।”

সুবেদার পাটোয়ারীর মুক্তিযোদ্ধাদল পাকবাহিনীর লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে জমজমা রেলওয়ে সেতু ধ্বংস করে দিয়ে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা মহামায়া বাজারের কাছে আরেকটি সড়ক সেতু ধ্বংস করে পাকবাহিনীর সড়কপথে চাঁদপুর-কুমিল্লা যাতায়াত সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

সোহরাওয়ার্দী কন্যা বেগম আখতার সোলায়মান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে টেলিভিশনে একটি সাক্ষাৎকার দেন। বেগম আখতার সোলায়মান বলেন, “অধিকাংশ আওয়ামী লীগের সদস্যই আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনার কথা জানতেন না।” তিনি বলেন, “আমরা জানি জনগণ নির্বাচনের সময় অধিকতর শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ পাকিস্তান গড়ে তোলার লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলো।” ছয় দফার ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ছয়-দফা হচ্ছে অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবিমাত্র। এ থেকেই আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের অধিকাংশ সদস্য এক ও অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী।”

পশ্চিম পাকিস্তান মুসলিম লীগের সেক্রেটারি জেনারেল খাজা মোহাম্মদ সফদর চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও খুলনা সফর করে শান্তিবাহিনী গঠনের ভূয়সী প্রশংসা করেন।পাকিস্তান মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান খান আবদুল কাইয়ুম খান এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের  নিশ্চিহ্ন করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আবারও প্রমাণ করেছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈন্যদল তারা।