৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৩ জুন ১৯৭১ এই দিনে

* জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ৩ জুন জাতিসংঘে কর্মরত সাংবাদিকদের দেওয়া এক মধ্যাহ্নভোজ সভায় যোগ দেন। এ সময় বাংলাদেশ নিয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। তাঁদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি এবং সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার মানবেতিহাসের চরম এক বিয়োগান্ত ও বিষাদময় ঘটনা। মানুষের ইতিহাসে এই জঘন্যতম কলঙ্কের তুলনা নেই।


* তিনি বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিপীড়নে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অসংখ্য শরণার্থী পালিয়ে চলে এসেছে। তারা এখন ভারত সরকারের সামনে বিরাট এক সমস্যা। তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রয়োজন। শরণার্থীদের নিয়ে ভারত যে সমস্যায় পড়েছে, ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই।


* জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশের ঘটনাবলি এবং শরণার্থী বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লেখা একটি চিঠি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইসাকু সাতো পেয়েছেন। ১ জুন জাপানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ভিনসেন্ট কোরেলো প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠিটি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিচি আইদি ইসাইদের হাতে দেন।


* ইন্দিরা গান্ধী সে চিঠিতে বাংলাদেশের ঘটনাবলিসহ শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা ব্যাখ্যা করে বলেন, ভারত এর জন্য আদৌ দায়ী নয়। চিঠিতে তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।


* ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এদিন লন্ডনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত বাঙালিদের বিষয় নিয়ে ব্রিটিশ সাংসদদের সঙ্গে আলোচনা করেন। হাউস অব কমন্সে এ আলোচনা সভায় জয়প্রকাশ নারায়ণ ব্রিটিশ এমপিদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশে অবস্থার উন্নতির জন্য আপনারা পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করুন।


* পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিংহ নাহার সাংবাদিকদের জানান, কলকাতা ও এর আশপাশে ইতিমধ্যেই ৪০-৫০ হাজারের মতো শরণার্থী এসে পড়েছে। কল্যাণীতেই চার শিবিরে প্রায় এক লাখ শরণার্থী। এ ছাড়া কলকাতার উপকণ্ঠে সল্ট লেক এলাকায় প্রায় ১০ হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। পাঁচ-ছয় দিন আগে দমদম বিমানবন্দরসংলগ্ন গৌরীপুর মাঠে প্রায় ২০ হাজার শরণার্থী আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী সমস্যা বিরাট আকার ধারণ করেছে।


* ব্রিটেনের বামপন্থী সাপ্তাহিক নিউ স্টেটসম্যান ৩ জুন সংখ্যায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাহায্যের আবেদনে যারা সাড়া দেবে, তারা স্বার্থপর। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করলেও মানুষের দুর্দশার অবসান হবে না, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অবসান হতে পারে মাত্র।


* পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এস এম সোলায়মান পশ্চিম পাকিস্তানে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তাঁরা জানান, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে।


* পূর্ব পাকিস্তানের সমমনা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে কাইয়ুম মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।


* ঢাকায় এক সরকারি হ্যান্ডআউটে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি অবৈধ ও গোপন আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধান দিলে বা উদ্ধার করে দিলে কিংবা জমা দিলে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে।


* নারী শিল্পপতি লায়লা খালেদের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পপতিদের একটি প্রতিনিধিদল পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।


* দক্ষিণবঙ্গের ঝালকাঠিতে পাকিস্তানি সেনারা এদিন অনুগত পুলিশের সহায়তায় সুধীর দত্তসহ ১১ জনকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।


* কয়েকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা ঢাকায় যুক্ত বিবৃতিতে মুক্তিবাহিনীকে মোকাবিলা করতে পূর্ব পাকিস্তানের অনুগত নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।


* পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশীয় সহযোগী সমন্বয়ে গড়া বড় একটি দল নিয়ে কয়েকটি নৌকাযোগে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া এবং পয়সার হাটের খাল দিয়ে হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটালীপাড়া ঘাঁটি আক্রমণ করতে রওনা হয়। পথে হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা খালের দুপাশ থেকে তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। এ আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কয়েকজন পুলিশ সদস্য এবং এদেশীয় সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। ইব্রাহিম নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।


* একটি পাকিস্তানি সেনাদল মুক্তিবাহিনীর ৮ নম্বর সেক্টরের লালবাজার সাব-সেক্টরের অধীন একদল মুক্তিযোদ্ধার ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনারা প্রথম পর্যায়ে ভারত সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি দখল করে নেয়। পরে চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আবার পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে ঘাঁটি দখল করে নেন। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

 

 

পাকসেনারা ঝালকাঠিতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। ফাইল ছবি

পাকসেনারা ঝালকাঠিতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। ফাইল ছবি

পুলিশ, লাঠিয়াল রাজাকার ও পাকসেনাসহ প্রায় ৩০০ সদস্যের পাকবাহিনীর একটি দল ১২টি নৌকাযোগে কোটালীপাড়া ও পয়সার হাটের খাল দিয়ে গোপালগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর কোটালীপাড়া ঘাঁটি আক্রমণে এগিয়ে আসে। পথে হেমায়েত বাহিনী, হেমায়েতউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী, খালের দুপাশ থেকে পাকবাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পাকবাহিনীর সমর্থক ২৪ জন লাঠিয়াল রাজাকার ও পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। অপর পক্ষে হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম শহিদ হন।

পাকসেনারা ঝালকাঠিতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। বর্বররা পুলিশের সিআই (সার্কেল ইন্সপেক্টর) শাহ আলম, ওসি (অফিসার ইন চার্জ) সেকেন্দারের নির্দেশে সুধীর দত্তসহ ১১ জনকে পৌরসভার সামনে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ নদীতে ফেলে দেয়। লালবাজার সাব-সেক্টরের অধীনে সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনারা প্রথম পর্যায়ে ঘাঁটি দখল করে নেয়। পরে চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ রচনা করে। এই প্রতিরোধ সংঘর্ষে ২৮ জন পাকসেনা নিহত ও ২০ জন আহত হয়। এই সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী পুনরায় তাদের ঘাঁটি দখল করে নেয়।

নারী শিল্পপতি লায়লা খালেদের নেতৃত্বে শিল্পপতিদের একটি প্রতিনিধি দল সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাঙালিদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের সক্রিয় করতে খান আব্দুল কাইয়ুম খানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন: জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ খান, হানিফ মোহাম্মদ খান, রফিক শাহ, সিন্ধু মুসলিম লীগের সম্পাদক এ এ কোরেশী ও করাচী মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক জিয়া আব্বাস।

ঢাকায় সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান ১৪৯ নং সামরিক আদেশ জারি করেন। এ আদেশে বলা হয়, পনের দিনের মধ্যে শিক্ষকরা কাজে যোগদান না করলে তাদেরকে চাকুরিচ্যুত এবং সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, দেশপ্রেমিক পাকিস্তানী শিক্ষকরা প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বিনয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ পাচ্ছেন। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের নিন্দা করছি। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে প্রদেশের জনগণের কোনো সমর্থন ছিল না এবং নেই।

ঢাকায় সরকারি হ্যান্ডআউটে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের গোপন স্থানের সন্ধান দিলে অথবা উদ্ধার করে দিলে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হবে। মওলানা মুফতি দীন মোহাম্মদ খান, মওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ, মওলানা সিদ্দিক আহমদ, মওলানা মোহাম্মদ ইউনুস, মওলানা মোস্তফা আল-মাদানী, মওলানা আনিসুর রহমান, আলহাজ্জ্ব আব্দুল ওয়াহাব, মওলানা আশ্রাফ আলী, মওলানা আমিনুল হক, ও মওলানা নূর আহমদ এক যুক্ত বিবৃতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (মুক্তিবাহিনী) মোকাবেলা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামপ্রিয় লোকদের সামরিক ট্রেনিং দানের ব্যবস্থা করা এবং দেশপ্রেমিক অনুগত নাগরিকদের নিয়ে ‘মুজাহিদ বাহিনী’ গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানান।