৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৯ মে ১৯৭১ এই দিনে

* বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২৯ মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার করার আগে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনার সুযোগ নেই। একমাত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয় নিয়েই উভয় সরকারের মধ্যে কথা হতে পারে, অন্য কোনো বিষয়ে নয়।


* যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এক চিঠিতে সতর্ক করে বলেন, পুরো উপমহাদেশ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে। অন্তত ৩৫ লাখ শরণার্থী পূর্ব বাংলা থেকে এরই মধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এডওয়ার্ড কেনেডি তাঁর চিঠিতে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষ্ক্রিয়তার নিন্দা করেন।


* যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী এদিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের কাছে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাৎকারের বিবরণ পেশ করেন। সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।


* ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ২৯ মে দিল্লিতে বলেন, অসংখ্য বাঙালি যখন দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, তখন পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে ঘরোয়া বিষয় বলে দেখাতে চাইছে। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ খুবই দুঃখজনকভাবে বাঙালিদের সাহায্য করার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে প্রয়াসী হয়েছে।


* ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর এদিন কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনপ্রধান হোসেন আলীর কাছে এক লাখ টাকার একটি চেক দেন।


* যেসব পূর্ব পাকিস্তানি হুমকিতে বা চাপে পড়ে ভিটেমাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে আসতে আহ্বান জানান পাকিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র।


* পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় পিপলস পার্টিই এখন দেশের বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। পিপিপি শিগগিরই উভয় অংশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পাবে। আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব তাদেরই ওপর অর্পিত হয়েছে।


* ভুট্টো আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা হস্তান্তরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যুদ্ধে ভারতীয় ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ভারতীয়দের হাতে পাকিস্তানিরা মার খাচ্ছে। তাদের রক্ষা করা পাকিস্তানের কর্তব্য।


* পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পুনর্বিন্যাসে এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। বাকি সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহর আলী, এ এফ এম আবদুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আবদুল বারী, ড. মকবুল হোসেন ও ড. সাইফউদ্দিন জোয়ারদার এবং জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরোর পরিচালক ড. হাসানুজ্জামান।


* পটুয়াখালীতে জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল বরগুনা জেলখানায় বন্দী ৫৫ জন বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।


* বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় এই দিন মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমিল্লার উত্তরে রঘুরামপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহলরত দলকে অ্যামবুশ করে। দলটির বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা সালদা নদীর পশ্চিম শিবপুর, বাজরা ও সাগরতলায় পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এ অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের মেজর দুররানি নিহত এবং বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। পাকিস্তানিদের কিছু প্রতিরক্ষা বাংকারও ধ্বংস হয়। লাকসামে মুক্তিযোদ্ধারা রেল যোগাযোগের ক্ষতিসাধন করেন। এ ছাড়া তাঁরা সদর থানার ভাটপাড়া এবং সিঙ্গারবিল এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করেন।


* এ ছাড়া এই দিনে আরও কয়েকটি অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা হামলা চালান। বৃহত্তর চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা একটি পেট্রলপাম্পে গেরিলা হামলা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করেন। উত্তরবঙ্গের নওগাঁর হরতকীডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীদের ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়কে করতোয়া নদীর সেতু ভেঙে দিয়ে অগ্রবর্তী পাকিস্তানি বাহিনী দলকে অমরখানায় আটকে দেন এবং তেঁতুলিয়া থানা মুক্ত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।

 

সীমান্ত পাড় হয়ে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী লাখ লাখ মানুষ।ফাইল ছবি

সীমান্ত পাড় হয়ে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী লাখ লাখ মানুষ।ফাইল ছবি

সুবেদার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কুমিল্লার উত্তরে রঘুরামপুর- এ পাকবাহিনীর একটি টহলদার দলকে এ্যামবুশ করে। প্রচন্ড যুদ্ধের পর পাক পেট্রোল-পার্টির একজন অফিসার ও ২৫ জন সৈন্যের সবাই নিহত হয়।

ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি সৈন্যরা কুমিল্লার শালদা নদীর পশ্চিম শিবপুর, বাজরা ও সাগরতলায় পাকসেনাদের অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অভিযানে পাকবাহিনীর ৩১ তম বালুচ রেজিমেন্টের মেজর দুররানী নিহত ও ২৭ জন সৈন্য হতাহত হয় এবং অনেক প্রতিরক্ষা বাঙ্কার ধ্বংস হয়।

মুক্তিবাহিনীর একটি টহলদার দল কুমিল্লার বটপাড়ায় পাকসেনাদের দুটি গাড়ির ওপর এ্যামবুশ করে। এতে গাড়ি দুটি ধ্বংস হয় এবং ৪ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার সিঙ্গারবিল এলাকায় পাকসেনাদের ওপর এ্যামবুশ করে। এ আক্রমণে ৬ চন পাকসেনা নিহত হয়। পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়কে করতোয়া নদীর ব্রীজ ভেঙে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন নজরুল ও সুবেদার কাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে এবং পাকিস্তানি অগ্রবর্তী বাহিনীকে অমরখানায় আটকে দিয়ে তেঁতুলিয়া থানা মুক্ত রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

বরিশালের গৌড়নদী থানার বাটরা বাজারে হেমায়েত বাহিনীর অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। গোপালগঞ্জের কোটালপিাড়ার রাজপুরে এর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার করার আগে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো আলোচনা হতে পারে না। একমাত্র বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়েই উভয় সরকারের মধ্যে আলোচনা হতে পারে, অন্য কোনো বিষয়ে নয়। বাংলার সীমান্ত পাড় হয়ে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ লাখ ৮৮ হাজার ৩ শত ৫০ জন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নয়াদিল্লীতে বলেন, অসংখ্য বাঙালি যখন দেশত্যাগ করে ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে তখন পাকিস্তান সরকার পূর্ববঙ্গের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে তাদের ঘরোয়া বিষয় হিসেবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর করতে চাইছেন। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে বাঙালিদের সাহায্য দানের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। বিশ্ববাসী কি নিরস্ত্র, নিরপরাধী শিশু ও মহিলাদের হত্যা করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অনুমতি দেবেন? নিশ্চয় কখনো তা হতে পারে না।

পাকিস্তান সরকার জনৈক মুখপাত্র রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, দেশত্যাগী প্রকৃত পূর্ব পাকিস্তানিরা স্বদেশে ফিরে এলে তাদের স্বাগত জানানো হবে এবং পুনর্বাসন করা হবে। ঢাকায় সামরিক গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খান প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পুনর্বিন্যাস-কল্পে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যারা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড.মোহর আলী, এ.এফ.এম. আবদুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আবদুল বারি, ড. মকবুল হোসেন, ড. সাইফউদ্দিন জোয়ারদার ও জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরোর পরিচালক ড. হাসানুজ্জামান।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড. এ ভুট্টো দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের কর্মীদের সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতীত জনগণের সমস্যবলী সমাধান হতে পারে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বেআইনী ঘেষিত হবার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব আমাদের ওপরিই অর্পিত হয়েছে। সমস্যার সমাধান আমাদেরকেই করতে হবে।’ দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতা-বিরোধীরা শান্তি কমিটি গঠন করে। কমিটিগুলো হচ্ছে, নোয়াখালী সদর-গোলাম মোস্তফা, ফেনী মহকুমা-খাজা আহমদ, চাঁদপুর মহকুমা-এম.এ আলম, হাজিগঞ্জ থানা- আনোয়ার হোসেন, মতলব থানা-ড.আব্দুল হক ও কচুয়া থানা-আব্দুল মজিদ।