৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২০ মে ১৯৭১ এই দিনে

* স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২০ মে বলেন, প্রবাসী সরকারই বাংলাদেশের জাতীয় সরকার। বাংলাদেশের জনগণ ৯৮ শতাংশ ভোট দিয়ে যে দলকে নির্বাচিত করেছেন, তাঁরাই সেখানকার জাতীয় দল। সুতরাং আওয়ামী লীগের বাইরে আর কাউকে নিয়ে সরকার গঠনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।


* সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, সরকার তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভাসানী ইয়াহিয়া খানকে যে চ্যালেঞ্জ করেছেন, সেটা সরকারেরও কথা।


* বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, যে যুদ্ধ চলছে, তা ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এই সংগ্রাম ইসলামসহ সব ধর্মের মূল্যবোধ ও শিক্ষাকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করার; শোষণমুক্ত, সুষম ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের। বাংলাদেশকে যাঁরা মাতৃভূমি বলে মানেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, তাঁদের ধর্ম যা–ই হোক, তাঁরা ভাই।


* বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি অধ্যাপক রেহমান সোবহান এই দিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে অন্তত আড়াই লাখ লোক নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনী যাদের হত্যা করেছে এবং করছে, তাদের বেশির ভাগই নিরস্ত্র ও নিরীহ সাধারণ মানুষ। সেনারা অনেক গ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা নাপাম বোমা ব্যবহার করছে।


* পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখার সভাপতি নূর মোহাম্মদ খান ও সাধারণ সম্পাদক নজমুল হক নান্নু এক বিবৃতিতে বলেন, বিশ্বজনমত ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা কেন? বিবৃতিতে তাঁরা বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাতিসংঘের কাছে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার আবেদন জানান।


* বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ২০ মে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী জি এম সাদিক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দুই লাখ টাকার চেক পাঠান। চেকের সঙ্গে এক চিঠিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনের সামান্য প্রতীক হিসেবে এ অর্থ পাঠানো হলো।


* পশ্চিমবঙ্গে আশ্রিত শরণার্থীদের বিষয়ে দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অর্থমন্ত্রী তরুণকান্তি ঘোষের নেতৃত্বে চার মন্ত্রীর একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যাবনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তাঁরা রাজ্য সরকারের বক্তব্য পেশ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করেন এবং তাঁর সাম্প্রতিক সীমান্ত এলাকা সফরের বিবরণ দেন।


* পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ সেন জানান, সমিতির পক্ষ থেকে বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিন শ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ দ্য ট্রুথ নামে একটি সচিত্র বই পাঠানো হয়েছে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ এবং লাখ লাখ নিরস্ত্র মানুষের হত্যাকাণ্ডের সচিত্র তথ্য বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে।


* পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনটিতে বনগাঁ সীমান্ত লঙ্ঘন করে আবার ভারতীয় এলাকায় গোলা ছুড়লে দুজন সীমান্তরক্ষী আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনাজপুরের বালুরহাট সীমান্তে ভারতীয় এলাকাতেও এই দিন গোলাবর্ষণ করে।


* জাতিসংঘ মহাসচিবের আবেদনে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারকে পাঁচ লাখ ডলার দেয়।


* যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস বে ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও দূত এম এম আহমেদকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র–পাকিস্তান নতুন কোনো চুক্তি হবে না। পাকিস্তান তার উন্নয়ন পরিকল্পনা সংশোধন না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সাহায্যের নতুন আর কোনো চুক্তি করবে না।


* বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে মিসর সফররত ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ দেশটির প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন, কিন্তু সাদাত তাঁকে সাক্ষাৎ দেননি। দুই দিনের চেষ্টার পরও সাক্ষাৎ না পেয়ে কায়রো থেকে তিনি ইতালির উদ্দেশে রওনা হন।


* রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হাতবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ আরেক ঘোষণায় ১ জুলাইয়ের মধ্যে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাজে যোগ দেওয়ার এবং ২ আগস্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু করার নির্দেশ দেয়।


* পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ও তাদের অবাঙালি সহযোগীরা খুলনার ডুমুরিয়ায় চুকনগর বাজারে সমবেত বহু হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করে। সেখানে এই দিন ১০–১২ হাজার মানুষ নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা পাকিস্তানিদের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ভারতে যাওয়ার লক্ষ্যে চুকনগরে সমবেত হয়েছিল।


* পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল দেশীয়দের সহায়তায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার গালিমপুর গ্রামেও শিশু–কিশোরসহ ৩০–৩২ জন হিন্দুধর্মাবলম্বীকে হত্যা করে। এরপর তাদের কাছ থেকে সোনা, টাকাসহ অন্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে। শেষে গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা গ্রামের দুজন নারীকেও জিম্মি করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দলের আক্রমণে এদিন নলুয়া চা–বাগানে ২০ জন নিরীহ চা–শ্রমিক নিহত হন।


* পাকিস্তানি সেনারা এই দিন কুষ্টিয়ার বল্লভপুর মিশনারি গির্জা লুট করে ঘাঁটিতে ফেরার সময় তাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

 

bb

 

ইতিহাস:

শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি চুকনগর গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ২০ মে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুলনার ডুমুরিয়ার ছোট্ট শহর চুকনগরে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা নির্মম এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। অতর্কিত এ হামলা চালিয়ে মুক্তিকামী ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে তারা।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারদের করা গণহত্যার একক বৃহত্তম ঘটনা চুকনগর গণহত্যা দিবস মঙ্গলবার।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চুকনগরের গণহত্যা এক কালো অধ্যায় রচনা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা যে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তারও এক নীরব সাক্ষী হয়ে আছে আজকের চুকনগর।

ওই দিন যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ পুরুষ হলেও বহু নারী ও শিশুকেও হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। অনেক শিশু মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছিল, সে অবস্থায়ই চলে ঘাতকের কামান। ঘাতকের বুলেট মায়ের বুকে বিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন মা, কিন্তু অবুঝ শিশু তখনও মায়ের স্তন মুখের মধ্যে রেখে ক্ষুধা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।

এমনই কতো ঘটনা যে সেদিন ঘটেছিল, তার সঠিক ধারণা পাওয়া আজ কঠিন।

এলাকার প্রবীণেরা জানান, পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশের খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের একটি জনগোষ্ঠী জীবন বাঁচানোর তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময় বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনা, ফরিদপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ভারতে যাবার উদ্দেশে রওনা হন। ভারতে যাবার জন্যে তারা ট্রানজিট হিসেবে বেছে নেন ডুমুরিয়ার চুকনগরকে। ১৯ মে রাতে সবাই চুকনগরে এসে পৌঁছান। পরদিন সকালে সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ার বিভিন্ন সীমানন্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার জন্য চুকনগরে সমাবেত হন তারা। সেখানে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। হাজার হাজার মানুষ চুকনগরের পাতোখোলা বিল, কাঁচাবাজার চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, কালী মন্দিরসহ বিভিন্ন শশ্মানে আশ্রয় নেন।

সারা রাত নির্ঘুম রাত কাটে শরণার্থী হতে যাওয়া এসব মানুষের। সকালে বিশ্রাম সেরে ভাত রান্না শুরু করেন তারা। কেউ চিড়ে-মুড়ি ও অন্যান্য শুকনো খাবার দিয়ে শরীরে চলার শক্তি সঞ্চার করে নিচ্ছলেন।

কিন্তু ২০ মে সকাল ১০টার দিকে তিনটি ট্রাকে করে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা চুকনগর বাজারের ঝাউতলায় (তৎকালীন পাতখোলা) এসে থামে। তাদের সঙ্গে ছিল হালকা মেশিনগান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। সাদা পোশাকে মুখঢাকা লোকজনও আসে। দুপুর ৩টা পর্যন্ত তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে। হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় অনেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই ডুবে মারা যান। লাশের গন্ধে ভারি হয়ে যায় চুকনগর ও এর আশপাশের বাতাস। মাঠে, ক্ষেতে, খালে-বিলে পড়ে থাকে লাশ আর লাশ।

বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শেষে এসব স্থান থেকে লাশ নিয়ে নদীতে ফেলার কাজ শুরু করেন স্থানীয়রা।
চুকনগরের ফসলি জমিগুলোয় আজও পাওয়া যায় সেদিনের শহীদদের হাড়গোড়, তাদের শরীরে থাকা বিভিন্ন অলঙ্কার। চুকনগরে সেদিন কতো লোক জমায়েত হয়েছিলেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। অনেকের ধারণা লক্ষাধিক।