৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

১৬ মে ১৯৭১ এই দিনে

* ভাসানীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির (ন্যাপ) প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানসহ বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের দাবি সম্পর্কে কারও মনে কোনো সন্দেহ থাকলে তাঁরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে গণভোট করে দেখতে পারেন। বাংলার শতকরা ৯৯ জনের বেশি মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাবেন। ভারতের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৬ মে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মাওলানা ভাসানী এ কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি রাশিয়া ও চীনসহ সব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে ইয়াহিয়া সরকারের স্বৈরাচারের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন।


* বাংলাদেশের যেসব এলাকা সরকারের আওতায় ছিল সেসব জায়গায় বাংলাদেশ সরকার তার প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু করার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, নওগাঁয় তিনটি পুলিশি থানা চালু করা হয়েছে। সেখানে কাজ চালানোর জন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা, তিনজন করে ইন্সপেক্টর, সাব–ইন্সপেক্টর, সুবেদার ও কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি অঞ্চলে থানা স্থাপন করা হবে বলে তিনি জানান।


* বাংলাদেশ সরকার এই দিন থেকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক মানুষের জন্য যুব শিবির কর্মসূচি চালু করে।


* প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ভারত অন্য দেশের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন শেষে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সীমান্ত এলাকা থেকে শরণার্থীদের অন্য রাজ্যে স্থানান্তরের ব্যবস্থা হচ্ছে। ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমনে জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছে। সমস্যা বিরাট। বিদেশ থেকেও সাহায্য প্রয়োজন, কিন্তু যা আসছে তা পর্যাপ্ত নয়।


* ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলেই শরণার্থীরা ফিরে যাবেন। তবে সেটা কবে সম্ভব হবে, তা বলা যাচ্ছে না।


* কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকর পুনায় বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে ক্রমাগত শরণার্থী আসতে থাকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছে।


* কলকাতা সাহিত্য আলোচনা কেন্দ্র বাংলাদেশের সাহায্যার্থে কলকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হোস্টেলে এক মুশেয়ারার আয়োজন করে। মুশেয়ারার উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শান্তিস্বরূপ ধাওয়ান, সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত উর্দু কবি সাজ্জাদ জহির। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কাইফি আজমী, ফিরাক গোরকপুরী ও প্রীতিশ নন্দী এতে যোগ দেন। উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশের সাহায্যে তাঁরা ২৫ হাজার টাকা দেবেন।


* বাংলাদেশের সাহায্যার্থে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে কলকাতায় এই দিন সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ ছবিটি প্রদর্শিত হয়।


* ঢাকায় ৫৫ জন অধ্যাপক, শিক্ষক, লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিক ১৬ মে একটি যুক্ত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, মার্চ মাসে দেশের প্রতিষ্ঠিত বৈধ সরকারকে অমান্য করার কাজ চলছিল। নির্বাচনে জনগণের কাছ থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ম্যান্ডেট পেয়ে চরমপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিতে পর্যবসিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এ সময় শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে অপব্যবহার করা হয়।


* বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসেবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার বাঙালিদের আয়ত্তের মধ্যেই এসে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক তখনই চরমপন্থীরা জাতীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলল। পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত বর্তমান সরকার অবস্থা অনুকূল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় বিবৃতিদাতারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপের বিরোধিতা ও নিন্দা প্রকাশ করেন।


* একটি পাকিস্তানি সেনাদল এই দিন সকালে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার যোগীশো গ্রামে পৌঁছায়। গ্রামে মিলিটারি আসার খবরে আতঙ্কিত জনগণ জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিল। সেনারা লুকিয়ে থাকা লোকদের ধরে যোগীশো প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে হত্যা করে।


* পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দল রাজশাহীর বোয়ালমারী স্টেশনের কাছে হাসামদিয়া গ্রামে ১৩ জন সংখ্যালঘুকে হত্যা করে। পরে একে একে রামদিয়া, পোয়াইল, ময়েনদিয়া, শ্রীনগর ও রাজাপুর গ্রামেরও আরও ২০ জনকে হত্যা করে।

 

 

 

 

11 ১৬ মে ১৯৭১ সাল। পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ছয়টি গ্রামের ৩৩জন গ্রামবাসীকে। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় ঘরবাড়ী। যা হাসামদিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। বোয়ালমারী উপজেলায় একসাথে এত মানুষকে হত্যা এটিই প্রথম। এ নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর থেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছে পরিবারের সদস্যরা। যদিও আজো নিহতরা পায়নি শহীদের মর্যাদা কিংবা সরকারীভাবে নির্মিত হয়নি স্মৃতি রক্ষায় কোন স্তম্ভ।

হাসামদিয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের গ্রাম। ফলে ওই এলাকায় সকল বাচ্চু রাজাকারের প্লান মতই অপারেশন চালাতো আর্মিরা। ১৬ মে ১৯৭১। রেলগাড়ীতে আসেন পাক-আর্মিরা। বোয়ালমারী ষ্টেশন থেকে বহর নিয়ে মার্চ করেন হাসামদিয়ার দিকে। এরপর হাসামদিয়া গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে হত্যা করে ১৩ জন সংখ্যালঘুকে। পরে একে একে রামদিয়া, পোয়াইল, ময়েনদিয়া, শ্রীনগর ও রাজাপুর গ্রামের আরো ২০ জনকে হত্যা করা হয়। আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয় তহাদের ঘরবাড়ীসহ ময়েনদিয়াবাজার। নারকীয় এ গণহত্যার শিকারদের স্মৃতি ধরে রাখতে বেসরকারীভাবে স্থানীয়দের উদ্যোগে হাসামদিয়ায় শাহ-জাফর টেকনিক্যাল কলেজের মাঠে নিহতদের স্মরণে নাম ফলক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া সরকারীভাবে আজো নেয়া হয়নি কোন উদ্যোগ।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, পাক-বাহিনীর আসার সংবাদে বন-জঙ্গলে পালিয়েও রক্ষা করা যায়নি প্রাণ। চোখের সামনে স্বজনের হত্যার দৃশ্য দেখের প্রতিবাদের সাহস ছিলনা কারো।
তারা বলেন, কারো স্বামী, কারো ভাই, কারো দেবরসহ স্বজনদের হত্যার পর থেকেই মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে পরিবারের অন্য সদস্যদের। সহযোগীতা বলতে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো এক হাজার টাকাই পেয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা।
সেদিনে কথা মনে করে আজো শিউরে ওঠেন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সদস্যরা। তাদের দাবী এত কিছুর পরেও আজো মেলেনি শহীদ পরিবারের স্বিকৃতি।