৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৭ মে ১৯৭১ এই দিনে

* বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অব্যাহত চাপের মুখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৭ মে এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেন। দিল্লিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে তা বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল হবে না।


* বৈঠকে বিরোধী দলের দুজন বাদে বাকি সবাই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। বিরোধী দলের সব নেতার কথা শোনার পর ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি থাকলেও স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আরও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, স্বীকৃতি দেওয়া ব্যাপারে ভারত ভীত নয়।


* বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী এই আভাস দেন যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারত তার অভিমত ব্যাখ্যা করে শিগগিরই বিভিন্ন দেশে সাংসদদের প্রতিনিধিদল পাঠাবে। বিরোধী দলের নেতাদের তিনি জানান, ত্রাণকার্য সম্পর্কে কী করা যায়, তা নিয়ে কথা বলার জন্য তিনি আবার তাঁদের সঙ্গে আলাদা করে বসবেন।


* বিরোধী দলের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ইন্দিরা গান্ধী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক বসেন। বিরোধী নেতাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিষয়ে তিনি তাঁদের জানান। এ বৈঠকেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রসঙ্গে আলোচনা হয়, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।


* সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিনের সঙ্গে এই দিন দেখা করতে যান সেখানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর। তাঁকে তিনি বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং ভারতে ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সংকট নিয়ে আলোচনা করেন।


* পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় রাজ্যের বিধানসভায় এই দিন বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি, অস্ত্রশস্ত্রসহ সব ধরনের সাহায্য দেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করলে সেটি গৃহীত হয়।

* প্রস্তাবের ওপর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন দলের ২৭ জন সদস্য বক্তব্য দেন। স্পিকার অপূর্বলাল মজুমদার বাংলাদেশের শহীদদের স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালনের জন্য অনুরোধ করেন।


* কলকাতা পৌরসভাও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। পৌরসভার অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করেন মেয়র শ্যামসুন্দর মজুমদার।


* ভারতের ৪৪ জন বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মানুষের আর্ত ক্রন্দনে সাড়া দেওয়ার জন্য বিশ্ববিবেকের কাছে আবেদন জানান। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. রাও, নুরুল হাসান, সাংবাদিক ফ্রাঙ্ক মোরেস প্রমুখ।


* ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) পশ্চিমবঙ্গ শাখা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পাঠানো এক স্মারকলিপিতে বলে, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দেরি হলে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদেরই বিপদে ফেলা হবে না, ভারতেরও ক্ষতি হবে।


* ভারত সফরে আসা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক প্রতিনিধিদলকে এদিন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিব টি এন কল জানান, বাংলাদেশি শরণার্থীর সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ভারত সীমান্ত বন্ধ করে দিতে পারত, কিন্তু মানবিক কারণে করেনি।


* তিনটি ব্রিটিশ সংস্থা অক্সফাম, ওয়ার অন ওয়ান্ট এবং ক্রিশ্চিয়ান এইডের পক্ষ থেকে ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষ বিমান ৫০ হাজার পাউন্ড ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এদিন কলকাতায় আসে।


* পাকিস্তান সরকার জানায়, দেশের চলমান পরিস্থিতির অবনতি রোধে ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি জারি করা হয়েছে।

* পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে ক্ষতিকর এবং জনগণের মধ্যে ভীতি, হতাশা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার মতো কিছুর প্রকাশ এখন থেকে নিষিদ্ধ। সংবাদপত্রগুলোকে সংবাদ প্রকাশের আগে সেন্সর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর বৈধ করিয়ে নিতে হবে। বিধি লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।


* সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে কবি শেখ আয়াজকে আটক করা হয়। রাজনৈতিক আবহাওয়া ‘দূষিত করার’ অভিযোগে গোলাম জিলানি ও জি এম সৈয়দকেও গৃহবন্দী রাখা হয়।


* বাংলাদেশে সামরিক অভিযান শুরুর পর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বিশ্বব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটন যাত্রা করেন।


* পাকিস্তানে নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত এয়ার মার্শাল সুতোপো ঢাকায় গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর সরকারের একাত্মতা প্রকাশ করেন।


* পাকিস্তানি সেনারা এই দিন রণদাপ্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।


* পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল মৌলভীবাজার জেলার রাজনগরের হিন্দুপ্রধান গ্রাম পাঁচগাঁওয়ে স্থানীয় দালালদের সহায়তায় হানা দেয়। তারা গ্রামের লোকজনকে একটি পুকুরের সামনে জড়ো করে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাযজ্ঞে ৫৯ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।

৭ মে মির্জাপুরে গণহত্যা দিবস

 

৭ মে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক বাহিনী এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় মির্জাপুরের নিরীহ জনতার ওপর ন্যাক্কারজনক হামলা চালিয়ে বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ ও লুটতরাজ করে।

নিরীহ জনতার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে মির্জাপুর হানাদার মুক্ত ও স্বাধীন হলেও সেদিনের ভয়াবহ দৃশ্যের কথা মনে করে আজও মির্জাপুরবাসী শিউরে উঠে। যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে মির্জাপুর স্বাধীন হয় স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হলেও তাদের স্মরণে নির্মিত হয়নি আজও কোনো স্মৃতিফলক।

৩ এপ্রিল ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গোড়ান-সাটিচড়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পরাজিত হবার পর মির্জাপুর সদরে এসে ঘাঁটি গাঁড়ে। এদেশীয় দোসর আর রাজাকার আলবদরদের সহযোগিতায় পাক সেনারা মির্জাপুর সদরের আন্ধরা সাহাপাড়া, কুতুববাজার, পুষ্টকামুরী, বাইমহাটি, সরিষাদাইর ও পালপাড়ায় ঢুকে অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং গণহত্যা চালায়।

৭ মে ১৯৭১ সাল ছিল শুক্রবার। সেদিন ছিল মির্জাপুরে হাটবার। হাটে যখন প্রচুর লোক সমাগম ঠিক তখনই স্থানীয় রাজাকার মাওলানা ওয়াদুধ পাক সেনা ক্যাপ্টেন আইয়ুব খানের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন পাকিস্তানী সেনা নিয়ে মির্জাপুরে প্রবেশ করে। মুহুর্তের মধ্যে হাট জনশুন্য হয়ে পড়ে। পরে পাক সেনারা সদরের আন্ধরা সাহাপাড়া, কুতুববাজার, পুষ্টকামুরী, বাইমহাটি, সরিষাদাইর ও পালপাড়ায় ঢুকে অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং গণহত্যা চালায়। 

ওই সব এলাকার শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরকে হত্যা করে বংশাই ও লৌহজং নদীতে নিক্ষেপ করে বলে সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অতুল চন্দ্র পোদ্দার (৯০) ও ঝৃষিকৃষ সাহাসহ (৭৮) অনেকেই জানায়।

নরঘাতকরা উপমহাদেশের প্রখ্যাত দানবীর কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা ও তার একমাত্র পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে না পেয়ে রাজাকার আলবদর বাহিনী নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে তাদের ধরে নিয়ে যায়। আজও তাদের কোনো খোঁজ মিলেনি।