৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৬ মে ১৯৭১ এই দিনে

* বেসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান বলে পাকিস্তানের করাচিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দেওয়া বিবৃতির প্রতিক্রিয়া জানান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। ৩০ মে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খানের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় যে মতৈক্য হয়, ইয়াহিয়া খান তা ঘোষণা করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এর বদলে তিনি বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। তাঁর কথা তাই মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।


* কামারুজ্জামান বলেন, ৯৮ শতাংশের বেশি মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। তাদের সরকারকে প্রশ্ন বা বিচার করার অধিকার মানুষ তাদের দেয়নি।


* ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারে বাংলাদেশের সমর্থনে এক সভায় বক্তব্য দেন বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এর আগের দিন তিনি নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনে ফিরে এই সভায় যোগ দেন।


* সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাবলির বিবরণ দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালিদের সংগঠন ও কর্মতৎপরতার কথাও উল্লেখ করেন। শ্রোতারা ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।


* সুইডেনের সব রাজনৈতিক দল যুক্তভাবে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে তারা অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে।


* ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের স্পিকার জাইচেক বিশ্ব মুসলিম সমাজের কাছে বাংলাদেশকে সহায়তার আবেদন জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যতম প্রধান মুসলিম রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর স্বাধীনতার দাবি উপেক্ষা করতে পারেন না।


* যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিসহ কয়েক প্রভাবশালী সিনেটর বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাঁদের সমর্থন ঘোষণা করে এদিন সিনেটে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালাচ্ছে, তাকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের বৈদেশিক সাহায্যসম্পর্কিত কমিটিও এই দিন পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেয়।


* ভারতের কেন্দ্রীয় পুনর্বাসনমন্ত্রী রঘুনাথ কেশব খাদিলকর দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থীশিবিরগুলোতে কলেরা রোগ মোকাবিলার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত সচেষ্ট হচ্ছে।


* গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আর আর দিবাকর পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ সীমান্তে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন এবং বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।


* এই দিন মুক্তিবাহিনী বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চৌদ্দগ্রাম-মিয়ারবাজার সড়কে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির এক প্লাটুন যোদ্ধা পাকিস্তান সেবাহিনীর ২৭ জনের একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। এ অভিযানে তিনজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।


* মুক্তিবাহিনীর আরেকটি গেরিলা দল কুমিল্লার গোমতী বাঁধের ওপর থেকে বিবিবাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আঘাত হানে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর একটি মর্টার প্লাটুন সিঙ্গারবিলের অবস্থানে অতর্কিত আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।


* পাকিস্তান সরকার ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের জন্য অভ্যর্থনা শিবির খোলার সিদ্ধান্ত নেয়।

* পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচার করে বলে, বাংলাদেশ সরকার এবং এর সামরিক হাইকমান্ডের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। এরা অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যাবে।


* পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ৩০ মে দ্বিতীয় দিনের মতো বরগুনা জেলখানায় বন্দী ১৭ জন বাঙালিকে হত্যা করে।

 

মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার চৌমুহনী-চন্দ্রগঞ্জ রাস্তার ফেনাকাটা পুল এলাকায় এ্যামবুশ করে। পাকবাহিনীর সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাক চন্দ্রগঞ্জ থেকে চৌমুহনী যাবার পথে ফেনাকাটায় পৌঁছলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস শাহাদাৎ বরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘ফেনাকাটা পুলের সংঘর্ষ’ নামে পরিচিত।

তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দপ্তরের উপর পাকবাহিনীর দুই কোম্পানির সৈন্য অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে পাকসেনারা দ্রুত পালাতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক হতাহত হয়।সকালে পাকসেনারা পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি এলাকায় প্রবেশ করে শর্ষিনার পীরের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে। শর্ষিনার পুল থেকে থানা পর্যন্ত এলাকার সমস্ত হিন্দু বাড়ি প্রথমে লুট ও পরে অগ্নিসংযোগ করে এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকসেনাদের অপর একটি দল আলঘারকাঠির দিকে যায়এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়।

পিরোজপুরে পাকহানাদার বাহিনী দুর্নীতি দমন বিভাগের দারোগা হীরেন্দ্র মহাজন (চট্টগ্রাম)সহ ৫ মে বন্দিকৃত এসডিও আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা), ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান(যশোর), এসডিপিও ফয়জুর রহমান (ময়মনসিংহ, লেখক হুমায়ূন আহমেদের পিতা)-কে বলেশ্বর নদীর পাড়ে একত্র করে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে তারা সবাই শহিদ হন।

 

সিলেটের কুলাউড়া থানায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে

সিলেটের কুলাউড়া থানায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে

 

সিলেটের কুলাউড়া থানায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। তাদের নির্মূল অভিযানের শিকার হয় ২শর বেশি নিরীহ মানুষ। এ থানার পৃথ্বিমপাশা নামক এলাকায়ও বর্বররা নিধনযজ্ঞ চালায়। এত শতাধিক মানুষ নিহত হয়।

সিনেটর ওয়াল্টার মন্ডেল মার্কিন সিনেটে বলেন, সাম্প্রতিক ঘূর্নিঝড়ের পর গৃহযুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ভয়ঙ্কর এক দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ অবস্থায় একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারের গৃহীত জরুরি পদক্ষেপই লাখ লাখ মানুষকে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো এবং নির্বাহক মি.জে.আর.বড়ুয়া জেনারেল হামিদ ও গভর্নর টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো বৌদ্ধ পূর্ণিমার পরপরই চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও পটুয়াখালি এলাকা সফর করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে সংগঠিত করবেন বলে জানান। পাকিস্তানি ঘাতকরা কুষ্টিয়ায় নেপালী শ্রমিকসহ স্থানীয় শ্রমিকদের পাইকারীভাবে হত্যা করে।

রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র তথ্য প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চ শেষ রাতকে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও আনুষ্ঠানিকভাবে 'স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র' ঘোষণার সময় নির্ধরণ করেছিলো । তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিমান ও সমুদ্র পথের সংযোগস্থল ঢাকা- চট্টগ্রাম দখলের পরিকল্পনা নিয়েছিলো। কিন্ত্র সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের নির্ধারিত সময়ের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে প্রেসিডেন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সামরিক তৎপরতা শুরু করে এবং ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী মাঝ রাতের আগেই ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালিয়ে দেশকে রক্ষা করে ।

মুখপাত্র আরো বলেন, এ সময় আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্নতার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনীকে তাদের কর্তব্য পালন ও সরকারি কর্তৃত্ব সম্পুর্ণভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান ।