৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০৫ মে ১৯৭১ এই দিনে

* বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী হওয়ার পর ৫ মে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান জানায় যে তিনি জীবিত ও সুস্থ আছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আকবর খান করাচিতে সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের আইন অনুসারে বঙ্গবন্ধুর বিচার হবে। সাংবাদিকেরা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চাইলেও সে অনুরোধ রাখা হয়নি।


* যুক্তরাষ্ট্রের চারজন সিনেটরের কাছে পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ডেভিড অ্যাবশায়ারের লেখা একটি চিঠি এদিন ওয়াশিংটনে প্রকাশ করা হয়। ওই সিনেটরেরা পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও রাজনৈতিক সাহায্য সম্পর্কে পররাষ্ট্র দপ্তরে চিঠি লিখেছিলেন। অ্যাবশায়ার সিনেটরদের জানান, চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিমান ও ট্যাংক পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছিল, পাকিস্তান সরকার সেসব অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ব্যবহার করছে। পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এম ২৪ ট্যাংক ও এফ ৮৬ বিমান ব্যবহার করা হয়েছে। এসব অস্ত্র ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।


* ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলসের সাক্ষাৎকার এদিন নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কার বিরুদ্ধে কী কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, তা না জেনে কাউকে মারণাস্ত্র দেওয়া নির্বুদ্ধিতা। অবিলম্বে দুটি ব্যবস্থা নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দরকার হয়ে পড়েছে: ১. মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের অপব্যবহারের জন্য পাকিস্তান সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানানো এবং অবিলম্বে তাদের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া। ২. এশিয়ায় শান্তি ক্ষুণ্ন করায় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। পূর্ব পাকিস্তানের একটি সশস্ত্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বিশাল সংখ্যাগুরুকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করায় যে অভ্যন্তরীণ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তা মীমাংসার জন্য জাতিসংঘের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।


* জাতিসংঘের উদ্বাস্তুসংক্রান্ত হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারতের রাজ্যগুলোতে অসংখ্য উদ্বাস্তু মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাঁদের সংস্থা শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে তারা স্থায়ী উদ্বাস্তুতে পরিণত হোক, সেটা কারও প্রত্যাশা নয়। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে আর কোনো শরণার্থী ভারতে না আসে এবং দেশত্যাগীরা স্বদেশে ফিরে যেতে পারে।


* পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে এদিন এক বৈঠকে ৭ মে বিধানসভায় একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব তোলার সিদ্ধান্ত নেন।

* বিধানসভার অধিবেশন শেষে মুখ্যমন্ত্রীর কক্ষে নেতাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিংহ নাহার, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জয়নাল আবেদিন, বিরোধী দলের নেতা জ্যোতি বসু, সিপিএম নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার, সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখার্জি, সংযুক্ত বামফ্রন্টের আহ্বায়ক সুশীল কুমার প্রমুখ প্রস্তাবটি তৈরি করেন।


* বাংলাদেশ সমন্বয় কমিটির ডাকে এই দিনকে কলকাতায় ‘বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এ উপলক্ষে শহীদ মিনার ময়দানে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্র ‘আমার সোনার বাংলা’ গান গেয়ে সভার সূচনা করেন। সভায় এক প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি ও সাহায্য দেওয়া ভারতের অপরিহার্য কর্তব্য। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ভারতের জাতীয় জীবনে অগ্নিপরীক্ষার মতো। এই অপূর্ব সুযোগ ব্যর্থ হলে ভারতের জাতীয় জীবন ধিক্কৃত হবে। প্রস্তাবটি পাঠ করেন সমর গুহ। সভাপতিত্ব করেন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার। তিনি সভা চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে সভা পরিচালনা করেন শংকর প্রসাদ মিত্র। প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তব্য দেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন, পান্নালাল দাশগুপ্ত, মৈত্রেয়ী দেবী প্রমুখ।


* পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিরোজপুর দখলে নেওয়ার পর মহকুমা প্রশাসক আবদুর রাজ্জাক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান এবং মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদকে এদিন গ্রেপ্তার করে। তাঁরা আর ফিরে আসেননি। শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাবা।


* পাকিস্তানি সেনারা এদিন নাটোর চিনিকলেও গণহত্যা চালায়। গোপালপুর গণহত্যা নামে এই ঘটনাটি পরিচিত।

* সেনাবাহিনীর দল গোপালপুরে এসে চিনিকলের প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করে। সেনারা প্রথমে চিনিকলের প্রধান কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করে। এরপর কর্মচারীদের চিনিকলের ভেতরে একটি পুকুরের সামনে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। চারজন বাদে সবাই মারা যান।


* পাকিস্তানি সেনারা সিলেটের নানিয়াতেও এদিন ২৬ জন নিরীহ মানুষকে নির্যাতনের পর হত্যা করে।

 

বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ কমন্সসভায় বলেন, বৃটিশ সরকারের ধারণা ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের আশ্রয়প্রার্থীদের সমস্যা ক্রমে দুরূহ হয়ে পড়ছে। আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা প্রতিদিন ২০ হাজার করে বাড়ছে। আমি মনে করি, ঢাকার বর্তমান পরিস্থিতি দেখার জন্য সেখানে একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল পাঠানো প্রয়োজন।

জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য ভারত সরকার জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার কারণে দেশত্যাগীদের নিয়ে ভারতে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা মানবিক। ভারতের রাজ্যগুলোতে অসংখ্য উদ্বাস্তু মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা এর স্থায়ী সমাধান প্রত্যাশী। তিনি আরো বলেন, আমরা চাই, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক, যাতে নতুন করে শরণার্থী ভারতে না আসে এবং দেশত্যাগীরা স্বদেশে ফিরে যায়।

‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলস্ বলেন, কার বিরুদ্ধে এবং কি কারণে আমাদের দেয়া অস্ত্র ব্যবহার করা হবে তা না জেনে বন্ধুভাবাপন্ন সরকারগুলোকে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া নির্বুদ্ধিতা। আমার মনে হয়, অবিলম্বে দুটি ব্যবস্থা নেয়া দরকার, এক. মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম অপব্যবহারের জন্য আমাদের উচিত পাকিস্তান সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানানো এবং সাহায্যদান অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া। দুই. আমাদের উচিত নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে এশিয়ার শান্তি ক্ষুন্ন হবার বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। এটা খুবই স্পষ্ট এশিয়ার শান্তি ক্ষুন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের লড়াই সেখানকার ‘ঘরোয়া বিষয়’ নয়। একটি সশস্ত্র সংখ্যালঘু কর্তৃক বিশাল সংখ্যাগুরুকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় যে ‘আভ্যন্তরীণ সমস্যা’ সৃষ্টি হয়েছে তা মীমাংসার জন্য জাতিসংঘের একটি বিশেষ ধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

 

একজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা

একজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা

এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নাটোরে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের জেনারেল ম্যানেজার লে. আনোয়ারুল আজিমসহ ৪২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মিল চত্বরের পুকুর পাড়ে ধরে এনে লাইনে  দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

 

মেজর জলিল বরিশাল পুনরায় মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এমপিএ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও লে. নাসেরকে সাথে নিয়ে দুটি লঞ্চে ৪০ জন যোদ্ধা ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ ভারতের শমসেরনগর থেকে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করেন। কপোতাক্ষ নদের তীরে গাবুরা চরের কাছে লঞ্চ দুটি পৌঁছলে পাকিস্তানি সৈন্যরা গানবোট দিয়ে আক্রমণ করে। এই আকস্মিক আক্রমণে এমপিএ মহিউদ্দিন ও এ্যাডভোকেট সর্দার জালালসহ ২৬ জন যোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে বন্দি হন এবং অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ লঞ্চ দুটি ধ্বংস হয়।

চট্টগ্রামের রামগড় সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক এসডিও আবদুর রাজ্জাক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান ও এসডিপিও ফয়জুর রহমানকে দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনারা গ্রেফতার করে।

 

পাকবাহিনীর নির্যাতন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলছেই সারাদেশে

পাকবাহিনীর নির্যাতন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলছেই সারাদেশে

সিলেটের নানিয়া নামক এলাকায় পাক বর্বরদের পৈশাচিক নির্যাতনে ২৬ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়। ১নং সেক্টরের আওতায় এদিনেই প্রথম ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এই দল গঠনের নেতৃত্ব দেন হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা। এটি পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

 

ঢাকার ধামরাই থানার স্বাধীনতা-বিরোধীরা মোজাম্মেল হককে সভাপতি এবং শমসের আলীকে সেক্রেটারি করে ১০৮ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করে। প্যান মালয়েশিয়া ইসলামিক পার্টি জাতিসংঘ সেক্রেটারি উ থান্টের কাছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয হস্তক্ষেপের নিন্দা করে স্মারকলিপি পেশ করে।

 

৫ ই মে ১৯৭১ মঠবাড়ীয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি কাল দিন

 

লিখেছেন:এমাদুল হক খান
বীর মুক্তিযোদ্ধা

পাকিস্তান আর্মির পদভারে জেলা শহর বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা সহ সমগ্র মাতৃভূমি ধংসস্তুপ ও রক্তে রঞ্জিত। মহকুমা শহরে সময়ের অপেক্ষা মাত্র,বরিশালের মেজর আঃ জলিল ক্যাপ্টেন বেগ সহ সুন্দরবন হয়ে ভারতের পথে এবং পিরোজপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব এনায়েত হোসেন খান সহ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জিয়াউদ্দীন তার বাহিনী নিয়ে সুন্দরবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সংবাদে মঠবাড়ীয়া স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক শহীদ সওগাতুল আলম সগীর ভাই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সহ সভাপতি ডাক্তার মতিউর রহমানের বাসায় বৈঠক করেন এবং দুইটি সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথমত, অস্ত্রধারী সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ব্যতিরেকে প্রশিক্ষনরত মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ রাতে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকবে,কেননা রাত ঝুঁকিপূর্ন এবং দিনে নিয়মিত প্রশিক্ষন নিবে। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা কন্ট্রোল রুম ও কলেজ প্রফেসর হোস্টেল ব্যারাকে অবস্থানরত। তারা উভয়স্থলে সেন্ট্রি বাড়ানো সহ তুষখালী টি এন্ড টি অফিস ও মাঝের পুলে সেন্ট্রি বাড়াবে। মুক্তিযোদ্ধা মজিবুল হক মজনু খা ও মোঃ বেলায়েত হোসেন মঠবাড়ীয়ার টি এন্ড টি অফিস (বর্তমান পৌর ভবনের ওখানে) থেকে,পাক আর্মির ফোন আলাপ শুনে সগীর ভাই কে নিয়মিত অবহিত করবে। এমন ভাবে সতর্কতা ব্যাবস্থা গ্রহন করা হয়, যাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে কোন বেগ পেতে না হয়। শতাধিক আর্মস ধারী মুক্তি যোদ্ধারা সবাই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমন্ট, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর থেকে শক্ত অবস্থানে।
অপরদিকে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে মুক্তিবাহিনীর প্রথম কমান্ডার আর্মির অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার টিকিকাটা নিবাসী ফখরুদ্দীন। সে সঙ্গোপনে মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে থানা সার্কেল অফিসার (সি আই) জালাল আহম্মেদ এ-র সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ নিয়ে সারেন্ডার করার পরিকল্পনা করতে থাকে।
ছগির মিয়া

 ৪ মে রাতে মঠবাড়ীয়া ও বুকাবুনিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যৌথ বৈঠক কবুতরখালী গ্রামে; পাক আর্মীর আগমনে করনীয় নিয়ে। সগীর ভাই গুলিশাখালী নিবাসী নায়েক আঃ লতিফ সহ ৭/৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মোস্তাফা শাহ আলম দুলাল ভাইয়ের বাবা, আনসার কমান্ডার লালু মিয়া, দুলাল ভাই ও আমাকে নিয়ে রাত ৮টার দিকে কবুতরখালী বৈঠকস্থলে উপস্থিত হল।
অন্যদিকে সগীর ভাইসহ আমাদের অনুপস্থিতিতে বিশ্বাসঘাতক  ফখরুদ্দিন তার ষড়যন্ত্রের জাল চুড়ান্ত রুপ দেওয়ার সুযোগ পায়। পিস কমিটির প্রথম সভাপতি মঠবাড়ীয়াকে রক্তপাতাহীন রাখতে কমান্ডার ও সি আই জালালের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করেন কিন্তু এর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের চরম মূল্য দিতে হয়, সে ভাবনার চেয়ে তাদের কাছে বড়ো হয়ে দাড়ায় পাক বাহিনী কে বিনা বাধায় মঠবাড়ীয়ায় স্বাগতম জানানো।

এদিকে কবুতরখালী আলোচনা গভীর রাত পর্যন্ত চলে। আলেচনা মূলত পাক বাহিনীর  আগমনে কি কৌশল অবলম্বন এবং পরবর্তী করনীয়। বৈঠক থেকে ফেরার পথেই ঐ গ্রামে আমাকে সাপে কাটে এবং ভাগ্যগুনে সাপের ওঝার বাড়ি কাছেই থাকায় দুলাল ভাইদের বাড়িতে ওঝাকে ডেকে ঝারফুক সহ লতাপাতা দিয়ে পা বাধে। আমাকে নিয়ে বিপাকে পড়ায় এবং আরো নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সেখান থেকে সবাই আরো দুরবর্তী  গুলিশাখালী আব্দুল বারেস হাওলাদার বাড়ি নিয়ে যায়। বর্তমান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক একে আজাদ এবির বাবা আব্দুল বারেস হাওলাদার।
সকাল বেলা আমাকে ঐ বাড়িতে রেখে সবাই মঠবাড়ীয়ার উদ্দেশ্য যাওয়ার পথে বয়াতির হাটে গিয়ে জানতে পারে,মঠবাড়ীয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের পতন ঘটেছে। ধর পাকড় সহ জয় বাংলার পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উড্ডয়ন করা হয়েছে। দ্রুত সেখান থেকে এসে আমাকে নিয়ে নিরাপত্তার সস্বার্থে ডৌয়াতলা সগীর ভাইয়ের মামাবাড়ি মৃধা বাড়ী আশ্রয় নেওয়া হয়।
সাপে কাটার কারণে হয়তো এ যাত্রা আম্রা বেচেঁ যাই।
ঐ দিন বিকালের মধ্যে গোয়েন্দা মারফত জানতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের সুচনা লগ্নে প্রথম কমান্ডার ফখরুদ্দীনের বিশ্বাসঘাতকতাঁর কারনে ও কিছু টাকার লোভে পড়ে এবং পাক বাহিনীর আগমনের পদধ্বনির পুর্বেই কন্ট্রোল রুম সহ মুক্তিবাহিনীর বিপর্যয় ঘটে এবং পাক দালালদের এদেশীয় পা চাটা কুকুরদের দখলে চলে যায়। ঘটনার বিবরনে জানা যায়,৪ তাং রাতেই ফখরুদ্দীনের সাথে আরো ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নামের কলঙ্ক বর্তমানে হিল্ট্রাকে বসবাসরত দঃমিঠাখালীর আঃ মন্নান, হাবিবুর রহমান  ও তালতলীর জনৈক মুক্তিযোদ্ধা এই কলঙ্কজনক অধ্যায় সম্পন্ন করেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট এক অংশ কলেজ ব্যারাকে ঘুমন্ত। বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের  তুষখালী সহ বিভিন্ন জায়গায় টহলে পাঠিয়ে কন্ট্রোল রুমে তার অনুগত তিন জনকে নিয়ে মালখানায় (কোত খানা) থাকা সমস্ত অস্ত্র অতি ভোরে থানা পুলিশকে হস্তান্তর করে এবং চুক্তি অনুযায়ী থানার খাজানায় থাকা থানা পরিষদের ৮৭ হজার টাকা উত্তলন করেন। সি ও ডেভ বাবু মাখন লাল দাসকে বাধ্য করা হয় টাকা উত্তোলনে এবং কাগজে সাক্ষর  করতে। অথচ টাকা ফখরুদ্দীন গং ও সি আই জালাল বটোয়ারা করে নেয়। এর পরিনতিতে পাক আর্মীর পিরোজপুরের দায়িত্ব প্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এজাজ মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা দেয়ার অপরাধে (যা সম্পুর্ন মিথ্যা এবং বানোয়াট) বাবু মাখন লাল দাস-কে নিজ হাতে পশু ডাক্তারখানার সামনে গুলি করে হত্যা করে। পাশাপাশি আঃ জব্বার ইন্জিনিয়ারের মুসলিম লীগের পান্ডারা পুলিশের সহায়তায় জিয়া উজ্জামান, আনোয়ারুল কাদরী, গণপতি হালদার, গোলাম মোস্তাফা, আঃমালেক,জাকির হোসেন পনুৃ মিয়া স্যার , নুরুল ইসলাম বিএস সি স্যার, ফারুক উজ্জামান, অমল ও বীরেন-কে গ্রেপ্তার করে। এরা সবাই নবীন প্রশিক্ষন রত মুক্তিযোদ্ধা। নুরুল ইসলাম বিএসসি স্যার, জাকির হোসেন পনু স্যার ও ফারুক উজ্জামান-কে মোটা টাকার বিনিময়ে তাদের পরিবার মুক্ত করতে পারলেও বকি ৮ জনকে মুক্ত করতে ব্যার্থ হয়। ৮-ই মে পর্যন্ত তাদের আট জনকে থানা হাজতখানায় রেখে নির্মম ভাবে প্রহার করে রক্তাক্ত করে পিরোজপুরে প্রেরণ করে। ১০মে মধ্যরাতে পিরোজপুরের চানমারী খেয়াঘাটে  পাক আর্মির গুলিতে জোড়ায় জোড়ায় বেধে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

 ওই দিন (৫ মে) সকালে ফকরুদ্দীনের বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদে কলেজে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা নিজ নিজ আর্মস নিয়ে নিরাপদ দুরত্বে সরে যায়। পরবর্তিতে মে মাসের মাঝামাঝি পুলিশের সাথে খণ্ডযুদ্ধে  ফুলঝুরি নিবাসী  দুর্দান্ত সাহসী আঃ রাজ্জাক বিশ্বাস ও আঃমোতালেব শরীফ ৩ জনকে হত্যা করে এবং তাদের মধ্যে আব্দুল মোতালেব শরিফ ঘটনাস্থলেই শাহাদাৎ বরণ করেন এবং আহত অবস্থায় আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস আত্মগোপনে থাকেন এবং ১৭/১৮ মে রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বাড়িতে সমাধিস্থ করতে না পারায় নদীর চরে তাকে সমাধিস্থ করতে বাধ্য হয়।

মজিবুল হক মজনু খাঁ, সাদিকুর রহমান সহ যুব মুক্তিযোদ্ধারা স্ব-স্ব আর্মস নিয়ে নিরাপদ স্থলে চলে যান।

আব্দুর জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের অনুগত ছাত্র সংগঠন টাইগার ফোর্স কে এম লতিফ ইনিস্টিটিউশনে অবস্থিত মঠবাড়িয়ায় নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার গুড়িয়ে দেয় এবং মিষ্টি বিতরণসহ উল্লাস করে।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে এরকম বিশ্বাসঘাতকতা না ঘটলে হয়তো টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী বা ফরিদপুরের হেমায়েতবাহিনীর অনুরুপে মঠবাড়ীয়ার সগীরবাহিনী গড়ে উঠতে পারতো।

আজ এইদিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মঠবাড়ীয়ার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক সওগাতুল আলম সগীর সহ মঠবাড়ীয়ার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ-দের আত্মার শান্তি কামনা করছি।