৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৯ এপ্রিল ১৯৭১ এই দিনে

* ভারতের রাজস্থান রাজ্যের বিধানসভার সরকার ও বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন সদস্য ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেন। তাঁরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি দাবি জানান। বিধানসভার প্রস্তাবে অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ইয়াহিয়া খানের জুলুম থেকে বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করা হয়।


* ভারতের নয়াদিল্লিতে সিপিআই নেতা হীরেন মুখার্জি বলেন, পূর্ববঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত লোকসভার অধিবেশন ডাকা প্রয়োজন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ভারতে ঢুকে ভারতীয় নাগরিক হত্যা করছে, তখন কোনো সংসদীয় রাষ্ট্র সংসদ বন্ধ রাখতে পারে না।


* পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সভাপতি অজয় মুখোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং দুর্গত মানুষের প্রয়োজন ওষুধ, খাদ্য, বস্ত্র, নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও অর্থ। এসব প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে আসার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।


* পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কয়েক শ বাঙালি মুসলমান বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের হোসেন আলীকে সংবর্ধনা জানাতে কলকাতায় আসেন। তাঁরা হাওড়া থেকে মিছিল করে সার্কাস অ্যাভিনিউর মিশনে আসেন। আঞ্জুমানে মহসিনিয়াত এই মিছিল ও সংবর্ধনার আয়োজন করে।


* বাংলাদেশের সমর্থনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিনে ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়।


* লন্ডনে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ: লন্ডনে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাঙালিরা বিক্ষোভ করেন। তাঁরা বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ জানান। বিক্ষোভকারীরা ‘খুনিরা ফিরে যাও, যুদ্ধ বন্ধ করো’-এ রকম বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করেন। পাকিস্তান ক্রিকেট দল অনুষ্ঠানে পৌঁছানোর আগেই বিক্ষোভকারীরা সেখানে হাজির হন। ক্রিকেট দলের সদস্যরা পৌঁছানোর পর পুলিশ তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।


* সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে জাতিসংঘের সাহায্য করার ব্যাপারটি পাকিস্তান সরকারের ওপর নির্ভর করে।


* পাকিস্তানি তৎপরতা: রেডিও পাকিস্তান এদিন জানায়, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি চিঠি পেয়েছেন। ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র এ তথ্য জানালেও চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু বলেননি।


* ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ১ মে থেকে ফুলবাড়িয়া ও শাহজাহানপুর রেল কলোনি এবং সচিবালয় এলাকায় বসবাসকারী লোকদের সরে যেতে নির্দেশ দেয়। আরেক ঘোষণায় শহরের সব দেয়াল থেকে রাজনৈতিক স্লোগান মুছে ফেলতে বলা হয়।


* পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান গত দুই দিন ময়মনসিংহ, যশোর ও খুলনায় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি ও স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন বলে এই দিন রেডিওর এক খবরে বলা হয়।


* যশোর জেলার বয়রায় থাকা পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তের খুব কাছে থেকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীকে (বিএসএফ) লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় দুই পক্ষে অনেকক্ষণ পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি সেনারা উত্তরাঞ্চলের হিলি সীমান্তেও ভারতীয় সীমানার ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ করে।


* পাকিস্তানি সেনারা এদিন ভারতের সীমান্তসংলগ্ন রামগড়ের কাছে হেঁয়াকুতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। লড়াইয়ের প্রথম দফায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিকেলে দ্বিতীয় দফায় দুই ঘণ্টা প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা চিকনছড়ায় সরে যান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রামগড় দখলের জন্য শুভপুর, নারায়ণহাট ও করেরহাট এলাকা দিয়ে ত্রিমুখী অভিযান চালায়।


* পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই দিন ফেনী দখল করে। সিলেট দখলের খবরও এদিন শোনা যায়।

নিউইয়র্ক থেকে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগকারী বাঙালি দূতাবাস কর্মকর্তা মাহমুদ আলির তারবার্তা পাঠান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। তারবার্তা পেয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমেরিকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে সম্মত করাতে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশ থেকে মার্কিন সাহায্য কর্মকর্তা ডা. জন ই. রড-এর লেখা চিঠি সিনেটর উইলিয়াম সেক্সবি সিনেটে পাঠ করে শোনান। তাতে মার্কিন সিনেটে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রডের লেখা ওই চিঠিটি ছিল ২৫ মার্চ থেকে ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যার একটি বাস্তব চিত্র। বৃটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলীয় সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে এক বিবৃতিতে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ববঙ্গের মাটি চায় কিন্তু জনগণকে নয়। তারা বাংলাভাষী জনগণের সংখ্যা হ্রাস করার নীতি হিসেবে সেখানে সামরিক তৎপরতা ও গণহত্যা শুরু করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা সম্পর্কে আমার লেশ মাত্র সন্দেহ নেই।

কুমিল্লার বড়কামতায় পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুই দফায় প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। দু’বারই পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাস্ত হয়। এ যুদ্ধে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘বড়কামতার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আসাদ আহমদ বায়রনের নেতৃত্বে একদল গেরিলা নবাবগঞ্জ মহকুমার শিবগঞ্জ থানাধীন পাগলা নদীর তীরে কানপুরে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে তিনজন পাঞ্জাবি সৈন্য ও দশজন রাজাকার এবং দালাল নিহত হয়। ক্ষুদে গেরিলাদের পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করে নাম-না জানা এগার বছরের একটি বালক। এ যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘কানুপুরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত হয়ে আছে।

পাকবাহিনীর একটি দল করেরহাট-হিয়াকুল হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। অপর একটি দল শুভপুর ব্রিজ এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালায় এবং অন্য আর একটি দল গুইমারা হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে মেজর জিয়া, মীর শওকতকে রামগড় চলে আসতে নির্দেশ দেন।

নায়েক সফি তার সেকশন নিয়ে সোনাইমুড়ি আউটার সিগনালে এ্যামবুশরত অবস্থায় পাকবাহিনীর তিনটি গাড়ি অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দু-তিন ঘন্টাব্যাপী গুলিবিনিময় হয়। এতে পাকবাহিনীর একজন সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয় এবং গাড়ি তিনটি অকেজো হয়। পাকবাহিনীর গুলিতে একটি ছেলে ও একজন বৃদ্ধ মারা যায়।

দেশের উত্তরাঞ্চলের হিলি সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে দিনব্যাপী প্রচন্ড গোলাবিনিময় হয়। পাকবাহিনী হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এলাকায় প্রবেশ করে। এসেই হানাদাররা নির্বিচারে হত্যা করে শতাধিক যুবক, ছাত্র ও বৃদ্ধকে। সিলেটের সুরমা ও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বর্বর পাকবাহিনী সংঘটিত হত্যাকান্ডে ৩০ জন চা শ্রমিক নিহত হয়।

 

হিলি সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে দিনব্যাপী প্রচন্ড গোলাবিনিময় হয়

হিলি সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে দিনব্যাপী প্রচন্ড গোলাবিনিময় হয়

রংপুর সেনানিবাসের কাছে ঘাঘট নদীর তীরে ১২৫ জন বাঙালী ইপিআর যোদ্ধাকে নির্মমভাবে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। পাক হানাদাররা সৈয়দপুরগামী একটি ট্রেনের কামরায় ২৫ জন বাঙালি যাত্রীকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। ঢাকায় সামরিক সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে ১ মে থেকে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে কলোনি, সেক্রেটারিয়েট এলাকা ও শাহজাহানপুর কলোনি এলাকায় বসবাসকারী লোকদের উৎখাতের নির্দেশ দেয় ।

 

সামরিক সরকার এক ঘোষণায় শহরের সকল দেয়াল থেকে রাজনৈতিক স্লোগানসমূহ মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়। কারণ দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ঐতিহাসিক স্লোগানসমূহ। করাচী প্রেসক্লাবে মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেন, যে সব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার জন্য সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিল এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে শিগগিরই ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেছিল সেসব দলকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত।