৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

২৩ এপ্রিল ১৯৭১ এই দিনে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৩ এপ্রিল ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৭১ সালের এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্রিটিশ এমপি ডগলাস ম্যানকে নিয়ে বেনাপোল সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি সফর করেন এবং সেখানে তারা একটি বৈঠকে করেন। ২৩ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের জাটিভাঙ্গা গণহত্যা দিবস, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর ও রাজশাহীর তাহেরপুর গণহত্যা দিবস।

১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে মহানন্দা নদীর পাড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ৩৫ নিরীহ বাঙালিকে।

২৩ এপ্রিল, ঢাকাঃ

ঢাকায় কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা এ.এস.এম. সোলায়মান, নেজামে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানী, প্রাক্তন এমএলএ রহিমুল্লাহ চৌধুরী ও আবদুস সোবহান পৃথক পৃথক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা দেশপ্রেমিক জনগণ ও সশস্ত্র সেনাবাহিনী নস্যাৎ করে দিয়েছে। জনগণ মুক্তিবাহিনী ও ভারতের চরদের প্রশ্রয় দিবে না। আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য গর্বিত। ভারতের চরদের হটাতে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা উচিৎ জনগণের।’

পাকিস্তান সরকারের দূতাবাস বন্ধের উদ্যোগঃ

৭১’এর এদিন পাকিস্তান সরকার ২৬ এপ্রিল দুপুর ১২টা থেকে কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের সাবেক ডেপুটি হাই কমিশন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং একই সময়ে ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশন বন্ধে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

বিদেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতিঃ

২৩ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় শ্রমিক দলীয় সদস্য ও অর্থনৈতিক সাহায্য বিষয়ক কমিটির সাবেক সচিব পিটার শোর এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে  পাকিস্তান সরকার যে আচরণ করছে তা বন্য হিংস্র মনোভাবকেও হার মানিয়েছে।  এই গণহত্যা উপেক্ষা করা, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক উদ্যোগ এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে। আমি অনুরোধ করছি শ্রমিক দল যেন পার্লামেন্টে বিষয়টি উত্থাপন করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সব সহায়তা বন্ধ করে গণহত্যা বন্ধে সামরিক প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।’

ঢাকার বাইরে গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধঃ

*  ২৩ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের জাটিভাঙ্গা গণহত্যা দিবস। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও আলবদরেরা। এ নির্যাতন থেকে বাঁচতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া, শুখানপুকুরী, জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিংগিয়া, চণ্ডীপুর, বাসুদেবপুর, মিলনপুর, গৌরীপুর, খামার ভোপলা, ভোপলা, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার পলাশবাড়ী ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার সংখ্যালঘু পরিবার ভারতে আশ্রয় নিতে সীমান্তে পাড়ি জমাচ্ছিলো। তারা সীমান্তে যাওয়ার পথে জাটিভাঙ্গা এলাকায় একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। এসময় মিছিলে যাওয়ার কথা বলে বাধ্য করে নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। নদীর পাড়ে পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের সারিবদ্ধ করে লাইনে দাঁড় করায়। তারপর ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রায় আড়াই হাজারের মতো নিরীহ বাঙালিকে।  

* ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর বাগমারার তাহেরপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর তিনটার দিকে পাকিস্তানি হানাদাররা রাজাকারদের সহযোগিতায় তিনটি সামরিক ট্রাক নিয়ে তাহেরপুর হাটে প্রবেশ করে। এরপর স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হাটের অনেক স্থানে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এসময় তারা ২২ জন নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে ‘হিন্দু এবং ভারতের দালাল’ অভিযোগে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে হাটের তিলিপাড়া এলাকায় অবস্থিত শ্রীনাথ সরকারের বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নলডাঙ্গা রোডের পাশের একটি ডোবায়  নিহত ২২ শহীদকে গণকবর দেওয়া হয়।

* ২৩ এপ্রিল ১৯৭১, শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মিলিটারি অপারেশন শুরু করে। গোমস্তাপুর থানার নিকটবর্তী বাজারপাড়া হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের ৩১ পুরুষকে ধরে নিয়ে আসে এবং পুরো গ্রামে তাণ্ডব চালিয়ে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। বন্দি হিন্দু ব্যক্তিদের থানার পেছন দিকে মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে ১৫ ও ১৬ জনের দুটি সারিতে ভাগ করা হয়। ১৫ জনের প্রথম দলটিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা। এরপর অপর দলটির ১৬ জনকেও একইভাবে গুলি করে হত্যা করে তারা। ব্রাশফায়ারের পরে মরদেহগুলো পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া নির্দেশ দিলে ওই ৩১ জনের মধ্য থেকে অমিল কর্মকার নামে এক ব্যক্তি ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। তখনই তাকেও গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

*  ২৩ এপ্রিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সেনা যশোরের কাগজপুকুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা বেনাপোল কাস্টম কলোনি ও চেকপোস্ট এলাকায় বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেন। এ যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর নায়েক সুবেদার মজিবুল হকসহ ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে হানাদারদের ৫০ জন সেনা নিহত ও বহু সেনা আহত হয়েছিল।

* ১৯৭১ সালের এদিনে রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে পাকিস্তানি হানাদারদের দুইশ সেনা যাত্রা করলে ক্যাপ্টেন কাদের ও লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

* ২৩ এপ্রিল ফেনী পতন হয়। পাকিস্তানি হানাদারেরা ফেনী দখল করলে মুক্তিযোদ্ধারা  ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অনেক স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

* ১৯৭১ সালের এদিন সিলেট শান্তি কমিটির উদ্যোগে নেজামে ইসলাম ও শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকারেরা শহরে মিছিল করে। এই মিছিলে তারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া খান জিন্দাবাদ এবং ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার, সাবধানসহ নানা স্লোগান দেয়। পরে মিছিল শেষে অনুষ্ঠিত সভায় শান্তি কমিটির নেতারা বলেন, ‘ভারতের চর মুক্তিবাহিনীকে উৎখাত করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখতে হবে।’

* আগেরদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কুমিল্লার লাকসাম পরিদর্শন করেন। এসময়  লাকসাম শহরের এক সমাবেশে প্রতিশোধ গ্রহণের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘গত দুদিনে আপনাদের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বেশ ক্ষতি করেছে। আমরাও তাই করব।’ পরে ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারেরা নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে।

* পাকিস্তানী হানাদারেরা ’৭১ এর এদিনে তিস্তা ও লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি থেকে প্রবল গুলিবর্ষণ করতে করতে কুড়িগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। হানাদারদের ভারি অস্ত্রের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেন।

* ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে নওগাঁর মোহনপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলাম, মখরপুর গ্রামের আবদুর রাজ্জাক, দশপাইকার গ্রামের বাচ্চু ও মমতাজউদ্দিন শহীদ হন। বলিহার ইউনিয়নের বাসিন্দা ভারতের লক্ষ্নৌর মরিস কলেজ থেকে সঙ্গীতে স্বর্ণপদকজয়ী নওগাঁর প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ মানিক চক্রবর্তী এবং মাধাইমুরী গ্রামের আলিমউদ্দিন খাঁ মিলন ও আলিম পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন।