৭১ এর এই দিনে | mssangsad.com

৭১ এর এই দিনে

০২ এপ্রিল ১৯৭১ এই দিনে

* ভোরের সূর্যের কোমল আলো ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। নতুন এক সকালে ঘুম ভেঙেছে পৃথিবীর। তবে বিশ্বের এক কোণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে একটি জাতির আরেকটি দিন বেশি বাঁচা। নতুন এক দেশ গড়তে লড়াই করে যাচ্ছে তারা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ গণহত্যার পর পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিকে একেবারে শেষ করে দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে।  

* সারাদেশে চলছে তাদের হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচার।  উদ্ভ্রান্তের মতো মানুষ ছুটছে শহর থেকে গ্রামে। গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। কেউ কেউ বর্ডার পার হয়ে ঢুকে যাচ্ছে ভারতে। জীবন বাঁচাতে চলছে অজানার উদ্দেশ্যে ছুটে চলা। প্রতি মুহূর্ত কাটছে মৃত্যু ভয়ে। এদিন ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট এর পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার পর ঢাকা নগরীর বেঁচে যাওয়া মানুষজন পালানোর স্থান ও প্রথম নিরাপদ আশ্রয়স্থল রূপে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত জিঞ্জিরার দিকে যাত্রা করে।

* জিঞ্জিরা ও এর আশেপাশের অঞ্চলগুলো ছিল তখন প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। তাই সেগুলো আগে থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক চিহ্নিত ছিল। যখন ঢাকা থেকে পালিয়ে সবাই সেখানে একত্র হতে থাকে, তখন পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নেয়। তারা ১ এপ্রিল মধ্যরাতের পর থেকে অর্থাৎ ২ এপ্রিল ভোর থেকে জিঞ্জিরায় সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে এবং কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। 

* পাকিস্তানরা ঐদিন গভীর রাতেই বুড়িগঙ্গার অন্য পাড়ের মিটফোর্ড হাসপাতাল অধিকার করে এবং চিকিৎসালয় সংলগ্ন মসজিদের ছাদ থেকে আনুমানিক ৫টায় ফ্লেয়ার ছুড়ে গণহত্যা আরম্ভ করার জন্য সংকেত প্রদান করে। প্রায় আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫ টা থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে একটানা নয় ঘণ্টা চালিয়ে যায় এবং দুপুর ২.৩০ এ হত্যাযজ্ঞ শেষ করে। তারা ঘরবাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী ষাট জন লোককে একসঙ্গে একই সারিতে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এ গণহত্যায় আনুমানিক সহস্র বা তার চেয়ে অধিক সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

* ভোরবেলা মিটফোর্ড হাসপাতালের (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) ছাদে দাঁড়িয়ে সভ্যতার জঘন্যতম পৈশাচিকতা দেখতে দেখতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রশিদের মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল— ঢাকা থেকে ২৫ তারিখের পর যে বাঙালিগুলোও পালিয়েছিল, সবগুলোকে আজকে এই জিঞ্জিরায় খতম করে দেয়া যাচ্ছে! এমনিতেই বুড়িগঙ্গার তীরে এই জিঞ্জিরা, কালিন্দী আর শুভ্যাডা এলাকায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস বেশি; তার ওপর প্রায় এক লাখ মানুষ পালিয়ে এসেছে ঢাকা থেকে। আজকে এইগুলারে এইখানেই পাকিস্তানের নামে পুইতা ফেলা হবে। মনে মনে ভাবে ব্রিগেডিয়ার রশিদ হয়তো ভেবেছিল, ‘শুক্রবারের এই পবিত্র দিনটিতে এই পাকিস্তানের শত্রু ইন্ডিয়ার দালালগুলারে ঝাড়েবংশে শেষ করতেছি, জেনারেল টিক্কা খান আমার ওপর খুশি না হইয়া এইবার যাইব কই!’

* বেলা বাড়তে বাড়তে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকতে থাকে গ্রামগুলোতে। একের পর এক বাড়িতে ঢুকেই ব্রাশফায়ার। মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে বুটের নিচে পিষতে থাকল কয়েকজন, নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকল লোলুপ হিংস্রতায়। বাড়িগুলো ততক্ষণে পুড়ছে আগুনে। রাস্তা, পুকুর পাড়, ক্ষেত, বাগান- যাকে যেখানে পেল, সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলতে থাকল। মেয়েদের অনেককে তুলে নিয়ে গেল উচ্চপদস্থ অফিসারের জন্য ‘তোফা’ হিসেবে।

* মান্দাইল গ্রামে ৬০ জনকে এক লাইনে দাড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করার পর বেয়নেট দিয়ে গলা আর পেট চিরে দেয়া হয়। যেন নিশ্চিত হয় সবার মৃত্যু। কালিন্দ গ্রামের এক বাড়িতে ১১ জন হিন্দু নারীকে পাশাপাশি ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো, ধর্ষণ শেষে বেয়োনেট দিয়ে মোরব্বার মত খোঁচাল কিছুক্ষণ। তারপর রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবখানে।

* ওদিকে বুড়িগঙ্গার তীরে তখনো হত্যার মহোৎসব চলছেই। বাচ্চারা যেমন খেলার ছলে টিপে টিপে পিঁপড়া মারে, ঠিক তেমনি পাকিস্তানিরা যাকে ইচ্ছা গুলি করছে, যাকে ইচ্ছা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। মাথার ওপর হেলিকপ্টারের রোটোর ব্লেডের কট কট শব্দ, অবিরাম গুলিবর্ষণ হচ্ছে সেখান থেকেও। মাঝে মাঝেই ফ্লেইম থ্রোয়ার থেকে তীব্র আগুনের হলকা এসে নীচে বিস্তৃত প্রান্তরে প্রাণ হাতে ছুটতে থাকা অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে দিচ্ছে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকা মানুষ পুড়তে পুড়তেই ছুটছে, একসময় ছুটতে ছুটতে নিস্তেজ হয়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। কখন যেন কান্না থেমে গেছে নাফিজার, দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। দেখছে রক্তের হোলি খেলা। চোখে অবাক অবিশ্বাস। দুঃস্বপ্নও কি এতটা ভয়াবহ হয়, হতে পারে!

* সেদিনের সেই নির্বিচার গণহত্যার স্বীকারোক্তি এক পাকিস্তানি দিয়েছিলে এভাবে—

“we were told to kill hindus and kafirs (non-believers in God). One day in June, we cordoned a village and were ordered to kill the kafirs in that area. We found all the women reciting from the Holy Quran and the men holding special congregational prayers seeking God’s mercy. But they were unlucky. Our commanding officer ordered us not to waste any time”( confession of a Pakistani Soilder)।

 

* জিঞ্জিরা গণহত্যার পরদিন, ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরার গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং দেশের অন্যান্য মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য হত্যার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এরকম—

‘Action against miscreants at Jinjira’; অর্থাৎ ‘জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ’।

 

* তৎকালীন পিটিবি (পাকিস্তান টেলিভিশন) ওই দিন (২ এপ্রিল) রাতের খবর প্রচার করে-

‘বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে।’